১৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ২০ লাখ লোক কর দেন
সৌরভ চৌধুরী,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় বাজেট ছিল প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা(১৯৭২ -৭৩ অর্থবছর) আর চলতি বাজার মূল্যে জিডিপি’র পরিমান ছিল ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ঐ অর্থবছরে মোট কর রাজস্ব আদায় করেছিল ১৬৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। কর বহির্ভূত রাজস্ব পেয়েছিল ১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। মোট রাজস্ব ও জিডিপি’র অনুপাত ছিল ৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ১৯৭৩Ñ৭৪ অর্থবছরে চলতি বাজার মূল্যে জিডিপি’র পরিমান ছিল ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি ২০ লাখ টাকা, সরকারের কর রাজস্ব প্রাপ্তির পরিমান ছিল ২৮৮ কোটি টাকা আর রাজস্ব খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭০ দশমিক ১৪ শতাংশ। গত ২০১১ -১২ অর্থবছরে এসে চলতি বাজার মূল্যে জিডিপি’র পরিমান ৯লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে আর মোট রাজস্ব প্রাপ্তির পরিমান ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে যার মধ্যে কর রাজস্ব প্রাপ্তির পরিমান ছিল ৯৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর এখাতে প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ২০০৯-১০ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে সেই ১৯৭৩-৭৪ সালে রাজস্ব খাতে যেখানে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭০ দশমিক ১৪ শতাংশ, ২০১১-১২ অর্থবছরে এসে কমে প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশে দাড়ালো।
অনেকের কাছে হয়তো অবাক মনে হতে পারে যদিও বাস্তবতা সেটাই। জাতীয় বাজেটের আকার ক্রমেই বড় হচ্ছে, বিশাল অংকের বাজেট, রাজস্ব আদায়ের পরিমানও বাড়ছে তবে রাজস্ব প্রবৃদ্ধির হার কমছে। অর্থাৎ যে পরিমান রাজস্ব পাওয়ার কথা ছিল তা আমরা পাচ্ছি না।
ভাবতেও অবাক লাগে যে ১৫ কোটির বেশি এদেশের জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র প্রায় ২০ লাখ লোক সরকারকে কর বা রাজস্ব দেন। দেশে কালোটাকা জিডিপির ৮১ শতাংশ যা টাকার অংকে এক লাখ ৭৭ হাজার কাটি টাকা। এই বিপুল পরিমান টাকা বা অর্থ অর্থনৈতিক মূল কর্মকান্ড থেকে বাইরে আছে।
আর সরকারও এই টাকার কোন ’ট্যাক্স পাচ্ছেন না। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে এই বিপুল পরিমান টাকা যদি অর্থনৈতিক মূলধারায় থাকতো তাহলো দেশের উন্নয়ন হতো, কর্মসংস্থানের সুযোগ হতো আর সরকারও অনেক টাকা রাজস্ব পেতো। আর যারা সাদা টাকার মালিক তাদের মধ্যেই ক’জন সরকারকে ট্যাক্স দেন? ট্যাক্স ফাঁিক বাংলাদেশে যেন একটি ক্যালচার হয়ে দেখা দিয়েছে। গত ২০১১-১২ অর্থবছরে যারা সরকাকে ট্যাক্স দিয়েছেন তাতের মধ্যে দুই কোটি টাকার মালিক দেখানো হয়েছে মাত্র সাড়ে চার হাজার জন।
এটা কি আদৌ সম্ভব? রাজধানী ঢাকায় বেসকারি ভবন আছে ৬০/৭০ লাখ। আবাসিক ও বানিজ্যিক এক একটি ভবনের দাম কম পক্ষে ৫ থেকে দেড়শ কোটি টাকা পর্যন্ত। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় ও জেলা শহরেও রয়েছে হাজার হাজার বিশাল ভবন যেগুলোর দাম কোটি কোটি টাকা। এমতাবস্থায় গোটা দেশে মাত্র সাড়ে চার হাজার লোক দুই শত কোটি টাকার মালিক এটা ভাবতে অবাক লাগারতো কথাই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন (২০০৯-১০) থেকে রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো। প্রতিবেদনে ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট করদাতার সংখ্যা দেখানো হয় ১৮ লাখ ৫৭ হাজার৮০৯ জন। এরমধ্যে কোম্পানী করদাতা ৫৩ হাজার ৫৯১ ও ব্যক্তি করদাতা ১৭ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৭ জন। ফার্মের মালিক করদাতার সংখ্যা দেখানো হয় ১১ হাজার ২৭ এবং অন্যান্য করদাতার সংখ্যা ৭৯ হাজার ৫০৪ জন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ লোক করের আওতায় এসেছে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ের পরিমান বাড়ছে ঠিকই তবে এখাতে প্রবৃদ্ধিতো বাড়ছে না।
বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে জিডিপি’র পরিমান ছিল চলতি বাজার মূল্যে ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি ২০ লাখ টাকা আর রাজস্ব প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭০ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে চলতি বাজার মূল্যে জিডিপি,র পরিমান দাড়ায় ৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৭৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা আর রাজস্ব প্রবৃদ্ধির পরিমান কমে এসে দাড়ায় ১৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে চলতি বাজার মূল্যে জিডিপি’র পরিমান ছিল ৯ লাখ ১৪ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা আর রাজস্ব প্রবৃদ্ধির হার দাড়ায় ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে। প্রবৃদ্ধির এই হার অবশ্যই হতাশাজনক। বাংলাদেশের প্রতিবেশি যেসব দেশ আছে সেগুলোতে রাজস্ব আদায়ের হার অনেক বেশি।
নেপাল ও ভুটানের মত দেশে এই হার ২৫ শতাংশের বেশি। ঐসব দেশে কর বা রাজস্ব ফাকি দেয়ার প্রবনতা কম যতটা না আমাদের দেশে। আমি যখন লন্ডনে এই বিষয়ে পিএইচডি করতে যাই তখন অনেক গবেষক, অর্থনীতিবিদের সাথে কথা হয়। তার আমাদের দেশের রাজস্ব আদায়ে অবস্থা সম্পর্কে জানতে পেরে অবাক হন। তাদের অনেকেই বলেন, তোমরা আর্থ-সামাজিক খাতে যে সব কারণে পিছিয়ে আছোর তার অন্যতম হচ্ছে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে দুর্বলতা। তারা যেমন রাজস্ব আদায় ব্যবস্থায় আধুনিকতার আনার কথা বলেছিলেন, তেমনি বেশি গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন স্বউদ্যোগের কথা। তাদের ভাষায় একটি দেশে সচেতন নাগরীকের দায়িত্ব হচ্ছে রাজস্ব দিতে সক্ষম হলে নিজের উদ্যোগে সরকারকে রাজস্ব বা কর দেয়া। আমাদের দেশে কর ফাকির প্রবন
তা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এই কর ফাঁকির কারণে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক খাতে অনেক পিছিয়ে আছে। বাড়ছে রাজস্ব ঘাটতি, আর সরকারের দায়-দেনা। দেশি-বিদেশি খাত থেকে ঋণ করে রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে হয়। আর রাজস্ব ঘাটতিতো বেড়েই চলছে। গত ২০১১-১২ অর্থবছরেরও দেখা গেছে যে রাজস্ব ঘাটতি ৫ শতাংশের বেশি ছিল যা আগের বছর ছিল ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। বৈদেশিক ঋণ বা অর্থ সহায়তা অনেকটা কমে আসছে নানা কারণে যার ফলে সরকারকে অভ্যন্তরীণ ঋণের উপর নির্ভরতা বাড়াতে হচ্ছে। সরকার ঋণের চাপ থেকে বের হয়ে আসতে পারছেনা। না পারার অন্যতম কারণ রাজস্ব আদায় কম হওয়া। তবে সরকার রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। নানা সীমাবন্ধতার মধ্যেও সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সরকারের আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর। এদুটি খাত থেকে সরকারের মোট আয়ের শতকরা ৮০/৮২ শতাংশ সংগৃহীত হয়। অবশিষ্ট আয় আসে কর-বহির্ভুত খাত থেকে যেগুলো হচ্ছে নানা ধরনের ফি, মাসুল ইত্যাদি। বর্তমান সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন যা কিছুটা হলেও ইতিবাচক ভুমিকা পালন করছে।প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থায় কমপক্ষে ২৫টি পদক্ষেপ নিয়েছেন। প্রায় সমান সংখ্যক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে পরোক্ষ কর ব্যবস্থায়। মূল্য সংযোজন কর ব্যবস্থা সহজীকরণ ও সরলীকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও আরো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কর রাজস্ব অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধির প্রধান উৎস। যার ফলে সরকারকে এখাতের উপর বেশি জোর দেয়া প্রয়োজন বা দিতে হচ্ছে। তবে তার জন্য প্রয়োজন লাগসই রাজস্বনীতি। যদিও বাংলাদেশের মতো উন্নয়শীল দেশে কর রাজস্ব নীতি নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন একটি কঠিন কাজ।
উন্নয়ত দেশগুলোতে তাদের মোট রাজস্বের বেশির ভাগই আসে স্থানীয় পর্যায় থেকে, আর বাংলাদেশে বেশি রাজস্ব আসে আমদানি পর্যায় থেকে। মূল্য সংযোজন কর রাজস্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এখন প্রধান ভুমিকা পালন করছে। আর সরকারও এর উপর বিশেষ ভাবে নির্ভর হয়ে পড়ছেন। মূল্য সংযোজন কর মূলতঃ একটি রেয়াতভিত্তিক কর ব্যবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশে দলিলভিত্তিক পণ্য/সেবা বিনিময়ের ব্যাপ্তি খুবই কম থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলো উপকরণ কর রেয়াত নিতে পারে না। যদিও সরকার এই অসুবিধা কমিয়ে আনার জন্য এরই মধ্যে কতিপয় সেবার ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন কর আরোপের জন্য সংকোচিত মূল্য ভিত্তির ব্যবস্থা করেছেন। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রয়েছে নানা ধরনে সমস্যা। প্রয়োজন দক্ষ জনবলের অভাব, অবকাঠামোগত সমস্্য, আধনিক প্রযুক্তির অভাব। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যারা কর বা রাজস্ব দিতে সক্ষম তাদের উদার মাসসিকতার অভাব। ১৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ২০ লাখ লোক কর দেন। এটা কি করে সম্ভব? কর দিতে সক্ষম এমন বিশাল জনগোষ্ঠি করের আওতার বাইরে।