আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ঈদ হোক সকলের জন্য আনন্দময়!

আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ঈদ হোক সকলের জন্য আনন্দময়!

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সময় তার পরিসর দিয়ে আমাদের জীবনকালকে ঘিরে রেখেছে। সে ধারাবাহিকতায় আমাদের জীবনে দিন আসে দিন যায়। কাল থেকে কালান্তর এভাবেই চলে আসছে। কিন্তু আমাদের জীবনের সকল দিনই একই সমান বা প্রকৃতির আসে বা যায় না। একঘেয়েমি কাটিয়ে জীবনকে বৈচিত্রময়, আনন্দঘন ও অর্থবহ করতে এ ধারাবাহিকতার মধ্যে কিছূ ব্যতিক্রম প্রয়োজন হয়। আর সে বিষয়টিকে সামনে রেখেই ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় দু‘টি দিনকে ঈদ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ইসলাম ফিতরাত বা স্বভাব ধর্ম হওয়ায় মানুষের জীবনের এই দিকটিকেও উপেক্ষা করেনি; বরং গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছে। ঈদ-উল-আযহা মুসলিম জীবনে এমনি একটি অন্যতম দিন। দেশ-কাল-পাত্রভেদে মুসলিম সমাজে এই দিনটি ধর্মীয়-সামাজিক উত্সবের দিন হিসেবে সূচনাকাল হতে অদ্যাবধি পালিত হয়ে আসছে। মূলত: এটি একটি আত্ম-ত্যাগের উত্সব, নির্মল সামষ্টিক আনন্দ লাভ আর একে অন্যের সহমর্মী হওয়ার অপূর্ব সুযোগ, নিজ নিজ দায়িত্ব কর্তব্য পালন ও অধিকার প্রাপ্তির এক সার্বজনীন ব্যবস্থা। অন্যান্য জীবনাদর্শ হতে ইসলামের স্বাতন্ত্রে এটি একটি অন্যতম দিক। ইসলাম এ উত্সবকে ঘিরে আনন্দকে শুধু তার অনুসারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি; বরং মুসলিম সমাজের অমুসলিম সদস্যদেরকেও শরীক করেছে। এখানে কেবল আনন্দ ভাগাভাগিই করা হয়নি, দেয়া হয়েছে সমাজের অসহায় ও দরিদ্রজনের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ারও শাশ্বত ও চিরন্তন নির্দেশনা। সাথে সাথে এ দিনটি কাছের ও দূরের মুসলিম উম্মাহর সদস্যগণের মধ্যে একতা ও সংহতি প্রকাশের সেতুবন্ধক হিসেবে কাজ করে। প্রকারান্তরে এই উত্সব যেন মুসলিম উম্মাহকে তার অতীত ও ভবিষ্যতের সদস্যগণের মধ্যে এক যোগসূত্র এনে দিয়েছে। সে অর্থে এটি একটি সার্বজনীন ও কালোত্তীর্ণ উত্সবের রূপ লাভ করেছে। কালপরিক্রময়ায় দিনটি উদযাপনে স্থানভেদে সামান্যতম মৌলিক কোন পার্থক্য সৃষ্টি হয়নি, উদ্দেশ্য লক্ষ্য এক ও অভিন্ন রয়েছে-যা বাস্তবসম্মতও বটে।

জানা যায়, আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর পূর্বে মুসলিম জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-এর সন্তান হাবিল ও কাবিলের মধ্যে বিবাহকে কেন্দ্র করে বিবাদ দেখা দিলে হযরত আদম (আঃ) তাদেরকে কোরবানী করার আদেশ দেন। তখন থেকেই কোরবানীর প্রচলন শুরু হয়। তবে সে সময় কোরবানীর নিয়ম ছিল ভিন্ন। ভেড়া, দুম্বা, শস্য বা গম ইত্যাদি কোরবানীর জন্য পেশ করা হতো। যার কোরবানী কবুল হতো আল্লাহপাকের হুকুমে আকাশ থেকে অগ্নি এসে তা ভস্মীভূত করে দিত। যারটা কবুল হতো না তারটা এমনি পড়ে থাকতো। মূলত, কুরবানী আরবী শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে অতিশয় নিকটবর্তী হওয়া। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় কোরবানী বলা হয় ঐ নির্দিষ্ট জন্তুকে যা একমাত্র আল্লাহপাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে নির্দিষ্ট সময়ে একমাত্র আল্লাহর নামে জবেহ করা হয়। কোরবানীর প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে কোরবানী আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর অতুলনীয় ত্যাগের স্মৃতি বহন করে। কোরবানীর দ্বারা মুসলমানগণ ঘোষণা করে যে, তাদের কাছে আপন জানমাল অপেক্ষা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মূল্য অনেক বেশি। কোরবানীর মাধ্যমে ত্যাগ ও উৎসর্গের দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করাই উদ্দেশ্য। এর দ্বারা আল্লাহপাক মানুষের আন্তরিকতা যাচাই করেন। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছেঃ “কখনই আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না এগুলোর গোশত ও রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া”(সূরা হজ্জ আয়াত-৩৭)। কে কত টাকা খরচ করে পশু ক্রয় করেছে, কার পশু কত মোটা, কত সুন্দর, আল্লাহপাক তা দেখেন না বরং তিনি দেখতে চান কার অন্তরে কতটুকু তাকওয়া বা পরহেজগারী আছে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত, দীর্ঘ হাদীসে প্রিয় নবী (সাঃ) ঘোষণা করেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহপাক তোমাদের শরীর ও চেহারা-সুরতের দিকে লক্ষ্য করেন না, কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের দিকে।” (মুসলিম শরীফ)। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আল্লাহতায়ালা মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কে অনেকবার পরীক্ষা করেছেন। সকল পরীক্ষায় তিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন। একরাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহপাক তাকে ইঙ্গিত করেছেন প্রাণধিক পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে কোরবানী করতে। বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র সন্তান হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর অপেক্ষা অধিকতর প্রিয় আর কি হতে পারে। তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে কোরবানী করবেন। তখন তিনি হযরত ইসমাঈল (আঃ) বললেন, যা পবিত্র কোরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ “হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি জবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কি?” সে হযরত ইসমাঈল (আঃ) বলল, “হে পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহ চাহেতো আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” (সূরা সফফাত আয়াত-১০২)। ছেলের সাহসিকতাপূর্ণ জবাব পেয়ে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) অত্যন্ত খুশি হলেন। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ছেলের গলায় ছুরি চালান। তখন হযরত জিব্রাইল (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে বেহেশত হতে একটা দুম্বা নিয়ে রওয়ানা হলেন। তার মনে সংশয় ছিল পৃথিবীতে পদার্পণের পূর্বেই হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যবেহ কাজ সম্পূর্ণ করে ফেলবেন। তাই জিবরাইল (আঃ) আকাশ হতে উচ্চৈস্বরে ধ্বনি দিতে থাকেন “আল্লাহু আকবার”। আওয়াজ শুনে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার”। পিতার মুখে তাওহীদের বাণী শুনতে পেয়ে হযরত ইসমাঈল (আঃ) বলে উঠলেন আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিলহামদ”। আল্লাহর প্রিয় দুই নবী এবং হযরত জিবরাইল (আঃ)-এর কালামগুলো আল্লাহর দরবারে এতই পছন্দনীয় হলো যে, কিয়ামত পর্যন্ত এই কথাগুলো ৯ই জিলহজ্ব ফজর থেকে আসর পর্যন্ত বিশেষ করে ঈদুল আযহার দিনে বিশ্ব মুসলিমের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকবে। আল্লাহপাকের অসীম কুদরতে হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর পরিবর্তে কোরবানী হয়ে গেল একটি বেহেস্তী দুম্বা। কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ)। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কালামে ঘোষণা করেন, “তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা একটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি ইসমাঈল (আঃ)-এর পরিবর্তে দিলাম জবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু।” (সূরা সাফফাত আয়াত-১০৪-১০৭)। বর্ণিত আছে যে, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) উপরোক্ত গায়েবী আওয়াজ শুনে হযরত জিবরাইল (আঃ)কে একটি বেহেস্তী দুম্বাসহ দেখতে পান। এ জান্নাতী দুম্বা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে দেয়া হলে তিনি আল্লাহর নির্দেশে পুত্রের পরিবর্তে সেটি কোরবানী করলেন। আর তখন থেকেই শুরু হলো কোরবানীর মহান বিস্ময়কর ইতিহাস। যা অন্ততকাল ধরে সুন্নতে ইব্রাহীম হিসেবে বিশ্বের সকল মুসলমানের কাছে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।

কোরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কোরবানীর তাৎপর্য ও ফজিলত সম্পর্কে বহু হাদীস পাওয়া যায়। হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা কতিপয় সাহাবী প্রিয় নবী (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল!, কোরবানী কি? প্রিয় নবী (সাঃ) বললেন, তোমাদের (জাতির) পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর সুন্নত। পুনরায় প্রশ্ন করা হলো, এতে আমাদের জন্য কি আছে? রাসূলে পাক (সাঃ) বললেন, কোরবানী গরু ও বকরীর প্রতিটি পশমে নেকী রয়েছে। তখন সাহাবায়ে কেরাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে ভেড়া ও দুম্বার ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? তিনি উত্তরে বললেন, ভেড়া ও দুম্বার পশমেও ছওয়াব আছে। (আহমাদ, ইবনে মাযাহ, মিশকাত-১২৯)। অন্য এক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, কোরবানীর পশু পুলসীরাতের উপর তোমাদের বাহন হবে। তাই তোমরা মোটা তাজা পশু কোরবানী কর। তারগীব নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে একবার হযরত নবী করিম (সাঃ) স্বীয় কন্যা ফাতেমাকে (রাঃ) ডেকে বললেন “হে ফাতেমা! তুমি তোমার কোরবানীর জন্তুর নিকট যাও কেন না কোরবানীর জন্তু জবেহ করার পর রক্তের ফোঁটা মাটিতে পড়ার সাথে সাথে তোমার যাবতীয় গোনাহ মাফ হয়ে যাবে।” হযরত ফাতেমা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! এটা কি শুধু আমার জন্য? প্রিয় নবী (সাঃ) জবাব দিলেন “এটা সকল মুসলমানের জন্য”। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয় নবী (সাঃ) এরশাদ করেছেন, আদম সন্তান কোরবানীর দিন যেসব নেকীর কাজ করে থাকে তন্মধ্যে আল্লাহতায়ালার নিকট সবচেয়ে পছন্দীয় আমল হলো কোরবানী করা। কেয়ামতের দিন কোরবানীর পশু তার শিং, পশম ও খুরসহ উপস্থিত হবে এবং কোরবানীর রক্ত জমিনে পড়ার পূর্বেই তা আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে যায়। অতএব, তোমরা এ পুরস্কারে আন্তরিকভাবে খুশী হও। (তিরমিযী, ইবনে মাযাহ্‌, মিশকাত-পৃ-১২৮)। কোরবানী করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা। এ জন্যই প্রাণী জবেহ করার বিধান প্রবর্তিত হয়েছে। এ বিধানকে অমান্য করে কেউ যদি কোরবানীর পশুর মূল্য দান করে দেয় অথবা তার পরিবর্তে খাদ্য-শস্য, কাপড় ইত্যাদি গরীবকে দান করে দেয় তবে তার দ্বারা আল্লাহপাকের এই হুকুম পালন করা হবে না। এমনকি প্রতিটি পশমের বিনিময়ে যে সওয়াবের কথা রয়েছে তা থেকে বঞ্চিত হবে। এ হাদীসে এরশাদ হয়েছে “যে ব্যক্তি সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও কোরবানী করল না সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে”। যার উপর যাকাত ফরজ হয়েছে তার উপর কোরবানী করা ওয়াজিব। তবে যাকাত এবং কোরবানী ওয়াজিব হবার জন্য নিসাব পরিমাণ সম্পদ কোরবানীর দিবসের আগের চব্বিশ ঘন্টা সঞ্চিত থাকাও জরুরী নয়। বরং জিলহজ্ব মাসের নবম তারিখের আসরের সময় যদি নিসাব পরিমাণ মাল কারো হস্তগত হয় তাহলেই তার উপর কোরবানী ওয়াজিব হয়ে যাবে। এমনকি ১০ জিলহজ্ব থেকে ১২ জিলহজ্ব এই তিন দিনের যেকোন একদিন মালিক হলেই কোরবানী ওয়াজিব হবে। তাছাড়া নিম্নের শর্তগুলো পাওয়া গেলেই কোরবানী ওয়াজিব হবেঃ

(ক) কোরবানীর দিন নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া। কাজেই গরীবের উপর কোরবানী ওয়াজিব নয়। (খ) সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া। (গ) স্বাধীন হওয়া। (ঘ) মুসলমান হওয়া। (ঙ) প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া। (চ) মুকিম বা স্থায়ী হওয়া। মহিলাদের নিজস্ব সম্পদ নিসাব পরিমাণ হলে ব্যক্তিগতভাবে তার উপর কোরবানী ওয়াজিব হবে।

কি কি পশু দ্বারা কোরবানী করা যাবে এবং কি ধরনের হতে হবে তা ইসলামী শরীয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। যথাঃ গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া এবং দুম্বা দ্বারা কোরবানী করা যেতে পারে। এছাড়া অন্য জন্তু যত মূল্যবানই হোক বা সুস্বাদুই হোক, পশুই হোক আর পাখিই হোক কোরবানী দুরস্ত হবে না। যেমন হরিণ বা অন্য কোন জন্তু, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি দিয়ে কোরবানী করলে জায়েজ হবে না। যেহেতু কোরবানীর জন্তুটি আল্লাহপাকের মহান দরবারে পেশ করা হয়ে থাকে এ জন্য এটি একটি উৎকৃষ্ট ধরনের মোটা তাজা সুস্থ সবল এবং সকল প্রকার ত্রম্নটিমুক্ত হতে হবে। হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, প্রিয় নবী (সাঃ) আমাদেরকে নির্দেশ করেছেন যে, আমরা কোরবানীর পশুর চোখ ও কান ভালভাবে পরীক্ষা করে নেই এবং এমন পশু কোরবানী না করি যার কানে ছিদ্র আছে (তিরমিযী শরীফ)। বস্তুত, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) মহান আল্লাহপাকের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের যে অনুপম আদর্শ স্থাপন করেছেন তা যেমন অতুলনীয় ঠিক তেমনিভাবে চির অনুস্মরণীয়। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আজ পৃথিবীতে লক্ষ কোটি মুসলমান হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর মহান আত্মত্যাগের আদর্শকে অনুসরণ করে মহান আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের জন্য নিজেদের জানমাল কোরবান করছে। সাথে সাথে নিজের সর্বস্ব পর্যন্ত কোরবানী করার বাস্তব শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। যার বাস্তব প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায় প্রতিটি মুমিন মুসলমানের গৃহে কোরবানীর দিনে।

এ দিনটি একদিকে যেমন একটি নির্মল আনন্দঘন, অপরদিকে তা একে অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগরুক, আপন মহিমায় ভাস্বর। এ দু‘টি ধারা মিলেই এটি পবিত্ররূপ লাভ করেছে রাসূলূল্লাহ (সা.)  মদীনায় হিজরাতের পর মদীনাবাসিকে উত্সব পালনের নির্দেশনা প্রদানকালে। এর পর থেকেই এ দু‘টি উত্সব অদ্যাবধি মুসলিম দেশ ও সমাজে পালিত হয়ে আসছে। এ দিনটিকে ঘিরে আচরিত আচরণের ইতিহাস সুপ্রাচীন, ঐতিহ্যমণ্ডিত ও মহিমান্বিত; অনাগতকালের সমগ্র মানবজাতির জন্য তা শিক্ষাপ্রদ ও কল্যাণকর; মুসলিম উম্মাহর মাঝে ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির নিয়ামক। কিন্তু বাস্তব অবস্থা মুসলিম উম্মাহ আজ শতধাবিভক্ত। এ দু‘টি উত্সব প্রতি বছর আসে এবং চলে যায়। কথা ছিল এ থেকে তারা ত্যাগ ও কুরবাণীর মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হবে, মানবতার কল্যাণ কাজে নিজেদেরকে ব্যাপৃত করবে, পরস্পর ঐক্য ও সংহতির পথে সুদৃঢ় হবে। বাস্তব অবস্থা কী তা আমরা সকলেই অবহিত। আমরা অর্থে কেনা বা পালিত পশু জবেহ করে কুরবানী দিতে শিখেছি; কিন্তু মনের পশুটিকে জীবনে একটি বারও কুরবানী দিতে শিখিনি। সে কারণে কুরবানী করার প্রকৃত উপকার ব্যক্তি জীবনে দেখতে পাচ্ছি না। আর ইসলামের এ সুমহান শিক্ষা হতে দূরে অবস্থানের কারণেই তাদের আজকে এ পরিণতি। সুতরাং নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই উম্মাহর মুক্তি ও কল্যাণ যে শিক্ষার মাধ্যমে এসেছিল; আমাদেরকে আবার সে দিকেই ফিরে যেতে হবে। সে বিশ্বাস ও শিক্ষাকে ধারণ করলেই আবার হৃত গৌরব ফিরে আসবে- ইতিহাস  আমাদেরকে সে শিক্ষাই দেয়।

পরিশেষে বলা যায়, ঈদ-উল-আযহা আমাদের জীবনে আনন্দ উৎসবের সাথে সাথে ধর্মীয় অনুভূতি ও  দায়িত্ববোধ জাগরিত করে। সামষ্টিক জীবনে একে অন্যের প্রতি দায়িত্বশীল ও সহমর্মী হতে শেখায়। প্রাত্যহিক জীবনের একঘেয়েমী আর অবসাদ দূর করে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে, প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাওয়ার অপূর্ব সুযোগ এনে দেয়। আমাদের সমাজে এই দু‘টি উত্সবকে ঘিরে যে কর্ম চাঞ্চল্য ও প্রথার সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক উন্নয়ন ধরে রাখা ও নিবিড় করার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বর্তমান সময়ের কর্মব্যস্ত মানুষেরা নানা ব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে এ উৎসবে নিজ নিজ নাড়ীর টানে যেভাবে স্বজনদের কাছে ফিরে যায়, তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মুসলিম সমাজেও খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। কালে কালে এটি আমাদের গৌরবময় ধর্মীয়-সামাজিক কৃষ্টিতে পরিণত হয়েছে। শুধু দেশে এই ছোট্ট গন্ডিতে নয়, এই বিশ্বায়নের যুগেও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের দেশের মানুষেরা এ দিনে স্বজনদের কাছে আসতে সামর্থের মধ্যে চেষ্টা করে থাকে। বিশেষ করে ঈদ-উল-আযহা আমাদেরকে সামাজিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ অপেক্ষাকৃত বেশি করে এনে দেয়। তাই মুসলিম উম্মাহর জীবনে ঈদুল  ফিতর ও আযহা তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বস্তুত ঈদুল আযহার মাধ্যমে আত্মদান বা পশুদান-এর উদ্দেশ্য হলো মহান আল্লাহর প্রেমে একজন প্রকৃত মুমিন তার সর্বাধিক প্রিয় বস্তু কুরবানী করতে পারে কিনা তারই পরীক্ষা এবং সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য পরিশুদ্ধ আত্মায় মহান আল্লাহর মহাপবিত্র প্রেমের প্রয়োজন। যে বিষয়ে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, মুমিনদের সর্বাধিক প্রেম হবে আল্লাহরই জন্য’(২ঃ১৬৫)। উক্ত প্রেম অর্জনের জন্য আত্মার পরিশুদ্ধির প্রয়োজন। আর আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য মানুষের মধ্যে যে পশুগুলো বা পাশবিক শক্তি আছে, তাকেই কুরবানী দিতে হয়। তাই ঈদুল আযহার পশু কুরবানীর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে বিরাজমান পশু শক্তি, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি রিপুগুলোকেই কুরবানী দিতে হয়। আর হালাল অর্থে অর্জিত পশু কুরবানীর মাধ্যমে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়। কারণ, পশু বা পশুর গোশত বা চামড়া কোনটাই আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই এবং তা দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টিও অর্জন করা যায় না, বরং এর মাধ্যমে যে তাকওয়া বা আল্লাহর প্রতি ঐকান্তিক প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটে- তা দিয়েই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ করা যায়। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হয়, দূর হয় মনের সকল কালিমা। মানুষ তথা সৃষ্টির অকল্যাণ হয় এমন কাজের কথা তখন চিন্তাও করা যায় না। এ সৃষ্টি প্রেমের মাধ্যমে লাভ করা যায় স্রষ্টার প্রেম, এমনি অবস্থায় মনে আসে অনাবিল শান্তি ও আনন্দ, যা মানব জীবনের পরম কাম্য। তাহলে বুঝা গেল, ঈদুল আযহা বা কুরবানীর আনন্দ বলতে পশু কুরবানীর সাথে সাথে মানুষের মধ্যে যে অশুভ পশু শক্তি রয়েছে তাকে কুরবানী বা বিসর্জন দিতে পারার কারণেই এই আনন্দ। তাই ভেবে দেখতে হবে, আমরা ঈদুল আযহার এ মহাপবিত্র লগ্নে আমাদের কুপ্রবৃত্তিগুলোকে ত্যাগ করতে পেরেছি কি? কুরবানীর অপর আনন্দ হলো আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হওয়া এবং ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে মানব তথা সৃষ্টির কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা। ত্যাগের মহিমায় মুসলিম উম্মাহ তথা মানব জাতিকে নতুন করে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই প্রতিবছর আমাদের জন্য আনন্দের বারতা নিয়ে আসে ঈদুল আযহা। এই পবিত্র লগ্ন আমাদেরকে প্রতিবছর স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ত্যাগের মহিমায় ধন্য হয়ে প্রকৃত মানবিক গুণাবলী অর্জন করার মাধ্যমে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মহাশান্তি লাভ করার সুযোগ হয়তো কারো কারো জীবনে আর নাও আসতে পারে। কারণ আল্লাহতা’য়ালা মানুষকে এ পৃথিবীতে নির্ধারিত সময়ের জন্যেই পাঠিয়েছেন। এ সময়ের যেদিন পরিসমাপ্তি ঘটবে, সেদিন কোন শক্তিকেই এ সময় বৃদ্ধি করার ক্ষমতা দেয়া হয়নি। সুতরাং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই জীবনের উদ্দেশ্য সাধন করতে হবে। না হয় জীবন অবসান ক্ষণে কান্নাকাটি বা অনুনয়-বিনয় কোনই কাজে আসবে না। এ সম্পর্কেও আল্লাহতা’য়ালা পবিত্র কুরআনে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন যে, জীবনের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ ব্যক্তি সেদিন ফরিয়াদ করে বলবেঃ হে প্রভু, পৃথিবীতে থাকার আর একটু যদি সুযোগ দিতে তাহলে তোমার নির্দেশানুযায়ী জীবন-যাপন করে ও সর্বস্ব উৎসর্গ করে সৎ মানুষ হয়ে ফিরতাম। কিন্তু এতে কোন লাভ হবে না। কেন না নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলে এক মুহূর্তেও বাড়ানো-কমানো হবে না। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনেই ঘোষিত হয়েছেঃ ‘তাদের নির্ধারিত সময় সমাপ্ত হওয়ার পর এক মুহূর্ত পূর্বে বা পরে তাদের জীবনের সমাপ্তি ঘটানো হবে না।’ (১০ঃ৪৯) এবং (১৬ঃ৬১)। বরং নির্ধারিত সময়ই প্রতিটি মানুষকে এ পৃথিবী ত্যাগ করতে হবে। তাই সময় থাকতেই আমাদের আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি লাভ করা উচিত এবং মানুষের কল্যাণে নিজেদেরকে উৎসর্গ করার মনোভাব হওয়া উচিত, যেন পশু কুরবানির সাথে-সাথে আমাদের কুপ্রবৃত্তি বা পশুশক্তির কুরবানি হয়ে যায় এবং আমাদের ত্যাগ ও উৎসর্গের মাধ্যমে অসহায়, নিরাশ্রয় ও অনাথ মানুষের মুখে হাসি ফুটে, তাহলেই ঈদুল আযহার আনন্দ সত্যিকারের আনন্দ হবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে মানবপ্রেম তথা সৃষ্টি প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে মহান আল্লাহর প্রেমার্জনে আত্মোৎসর্গ করার শক্তিদান করুন…।

লেখক: সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।

jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক