হাইব্রিড ধান চাষে ধূসর ফাঁদ!
কাজী মাহফুজুর রহমান শুভ,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ গত শতকের ষাটের দশকে তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের নামে সেচ-সার-নতুন বীজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধান উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মাটির আর্দ্রতায় ফসল আবাদের পুরনো পদ্ধতি বাতিলের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সার ও পাম্প কেনার জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। কিন্তু এক মৌসুমের বীজ অন্য মৌসুমে সহজ-সরল চাষীদের কাছে বিক্রি করে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। এছাড়া উৎপাদন খরচ বেশি, ধানের দাম কম, পোকামাকড়ের আক্রমন এবং বীজের অতিরিক্ত দাম হওয়ায় কৃষক হাইব্রিড ধান চাষ করতে চাচ্ছেন না।
শুরুতে ২০ হাজার হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধান চাষ হলেও বাড়তে বাড়তে ৯ লাখ হেক্টর পর্যন্ত ঠেকে। কিন্তু গত তিন বছর ধরে এর চাষ কমছে। এবছর চাষ হয়েছে সাড়ে ৬ লাখ হেক্টর জমিতে।
এছাড়া, দেশের মাটি ও আবহাওয়া বিবেচনায় হাইব্রিড ধানবীজ উৎপাদন ও আমদানির পর আদর্শমান জার্মিনেশন ৮০ শতাংশ, আর্দ্রতা (ময়েশ্চার) ১২ শতাংশ এবং বিশুদ্ধতা ৯৭ শতাংশ থাকা দরকার। এগুলো নিশ্চিত করা আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব। কিন্তু এ মান বজায় রাখতে পারছে না তারা। শুরুতে ব্যাপক তোরজোড় চালানো হয় হাইব্রিড ধান চাষে। কিন্তু কৃষক মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় এ জাতের ধান চাষ আর সম্প্রসারণ হচ্ছে না। এজন্য পরিবেশের প্রতিকূলতা, অতিরিক্ত সার কীটনাশক ব্যবহার, পোকার আক্রমণ, অতিরিক্ত খরচ, বীজের দাম বেশি হওয়া, বীজের জন্য বহুজাতিক কোম্পানির ওপর নির্ভরশীলতা, উৎপাদন খরচ না উঠা, ধানের দাম কম হওয়া, অনেক সময় ধানে চিটা হওয়া এবং ভাত ক্ষেতে না পারাকে চিহ্নিত করছেন কৃষিবিদ ও কৃষকরা।
হাইব্রিড ধানের রূপকার কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর উদ্যোগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ ধানবীজ দেশেপ ঢোকে। কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, খাদ্য নিরাপত্তার ধুয়া তুলে ১৯৯৬ সালে বীজ নীতি লংঘন করে ভারত থেকে ২৭০ কেজি এবং ১৯৯৮ সালে বন্যার পর দেশে কৃষি পুনর্বাসনের নামে গণচীন ও ভারত থেকে হাইব্রিড ধান বীজ আমদানি করে চাষ শুরু করা হয়। ২০০০ সাল থেকে এর ব্যাপকতা বাড়তে থাকে। ওই সময় ২ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ হয়। বীজের চাহিদা ছিল মাত্র ৩০ টন। পরে ২০০২-০৩ সালে ২১ হাজার ৫২ হেক্টরে চাষ হলেও ২০০৮-০৯ সালে তা বেড়ে ৯ লাখ হেক্টর জমিতে দাঁড়ায়। এরপর থেকে হাইব্রিড ধান চাষ কমতে থাকে। ২০০৯-১০ সালে ৭ লাখ ২০ হাজার হেক্টর, ২০১০-১১ সালে ৬ লাখ ৫৩ হাজার এবং ২০১১-১২ সালে সাড়ে ৬ লাখ হেক্টর জমিতে এ ধানের চাষ হয়। এ ধানের ফলন হয় গড়ে হেক্টরে ৪ দশমিক ৪১ টন।
এছাড়া, গত বছরে (২০১০-১১) আমন ও আউশ মৌসুমে হাইব্রিড ধান চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। খুবই কম জমিতে চাষ হলেও ফলন ভাল না হওয়ায় এবছর আর চাষের পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনও (বিএডিসি) ফিলিপাইন থেকে আমদানি করা এসএল-৮এইচ জাতের হাইব্রিড ধান বীজ উৎপাদন করে কৃষকদের কাছে সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তায় ধানের উৎপাদন বাড়াতে তথাকথিত হাইব্রিড ধান চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে কৃষি বিভাগ। তবে এসব ধান চাষে আগ্রহী নয় কৃষকরা। রংপুরের কৃষক কাশেম আলী ১৫ বিঘা জমিতে গত মৌসুমে হাইব্রিড ধানের (হিরা ধান) চাষ করেছিলেন। অধিকাংশ ধানেই চারা গজায়নি। এছাড়া ধানে চিটা হয়ে গেছে। ফলন না পেয়ে তিনি নিঃস্ব হয়ে যান। এজন্য কোম্পানিটির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও পাননি কাশেম আলী। প্রতারিত এ কৃষক আর হাইব্রিড ধান চাষ করবেন না বলে জানিয়েছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, উৎপাদন খরচ বেশি, ধানের দাম কম, পোকামাকড়ের আক্রমণ এবং বীজের অতিরিক্ত দাম হওয়ায় কৃষক হাইব্রিড ধান চাষ করতে চাচ্ছেন না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরও (ডিএই) এ ধান চাষে কৃষকদের সহযোগিতা করছে না বলে মনে করেন তিনি। কৃষি গবেষক পাভেল পার্র্থ বলেন, অধিকাংশ বীজ মানসম্মত নয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো প্রকৃত বীজ দিচ্ছে না। খাওয়ার ধান বীজ হিসাবে বিক্রি করছে। হাইব্রিড ধান চাষ ‘পরিবেশ নীতিমালা-১৯৯৫’এরও পরিপন্থী। এসব কারণে হাইব্রিড ধান চাষ পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য মারাÍক ঝুঁকিপূর্ণ। ডিএইর মহাপরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল লতিফ বলেন, অধিফতর হাইব্রিড ধান চাষ সম্প্রসারণে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে। তবে কৃষক ভালভাবে নিচ্ছে না।