নারী নির্যাতন রোধে স্বোচ্চার হোন
মোমিন মেহেদীঃ পত্রিকার পাতা উল্টালেই চোখে পড়ে পদদলিত নারীর মুখ আর বিপর্যস্ত শিরোনাম। যেখানে লেখা থাকে- ধর্ষণের পর হত্যা অথবা নির্যাতনের পর নির্মমভাবে খুন। এভাবে বাংলাদেশ সোনার বাংলায় পরিনত হতে পারে না। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য ‘নতুন আলোয় হেসে উঠা’ সুখি সম্মৃদ্ধ নারী সমাজ প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনের দিকে তাকিয়ে আমাদের নারী সমাজের নির্যাতন-ধর্ষণ ও খুন রুখতে হবে। তা না হলে ক্রমশ আমাদের আর কোন উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়।
আমরা আমাদের বর্তমানের দিকে তাকালে দেখবো যে, সব মানুষের সমান অধিকারের কথা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন আইন, ঘোষণায় বা সনদে বলা হয়েছে। কিন্তু সমঅধিকারের কথা বলা থাকলেও একটা বিরাট বৈষম্য চোখে পড়ে নারী-পুরযষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে। পরিবারে, কলকারখানায়, কৃষিতে, ব্যবসায়, প্রশাসনে, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে আজও পৃথিবীর প্রতিটি কোণে নারীরা অবহেলিত, নির্যাতিত, বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে বিশেষ ভাবে নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও)। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশও এ সনদ স্বাক্ষর করে। স্বাক্ষরের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য নারীর মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিতকরণ, সাংবিধানিক গ্যারান্টিসহ রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্রের সকল স্তরে যেমন পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নারীর অংশগ্রহণ ও অধিকার নিশ্চিতকরণের জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে পুরুষের সাথে নারীর অধিকারকে সমান স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। নারী-পুরুষভেদে সেখানে কোনো পার্থক্য করা হয়নি বরং নারীদের এগিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনে বিশেষ আইন প্রণয়নের কথাও বাংলাদেশের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। পারিবারিক ক্ষেত্রে নারীর অধিকার রক্ষায় পৃথক পৃথক ধর্মাবলম্বীদের জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক পারিবারিক আইন, যাতে মূলত বিয়ে, দেনমোহর, তালাক, ভরণপোষণ ও সন্তানের অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত অধিকারগুলো সন্নিবেশিত রয়েছে। পারিবারিকভাবে সংগঠিত এসব সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিটি জেলায় স্থাপিত হয়েছে একটি পারিবারিক আদালত। কিন্তু আমাদের দেশের বেশীরভাগ নারীরা জানে না, আইনগতভাবে তাদের কি কি অধিকার আছে বা এ অধিকারগুলো না পেলে তারা প্রতিকারের জন্য কোথায় যাবে। উপরোন্তু আমাদের চিন্তাকে আছন্ন করে ফেলছে পাচার, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, এসিড সন্ত্রাস, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও ফতোয়াবাজির শিকার অসংখ্য নারীমুখ। এসব অপরাধ দমনের লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন কঠোর আইন-কানুন প্রণয়ন করেছে, যেমন – নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, এসিড সন্ত্রাস দমন আইন ২০০২ ও যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১ঌ৮০। এসব আইনের কার্যকারিতার প্রশ্নে অনেকেই মনে করছেন শুধুমাত্র কঠোর শাস্তি প্রদান ছাড়া এসব বিশেষ আইনের ভিন্ন কোনো বৈশিষ্ট বা কার্যকারিতা নেই। এরই মাঝে আমাদের সামনে আশার আলো ছড়ায় অনেক নারীর সংগ্রামী প্রচেষ্টা৷ সরকারী উদ্দ্যেগের পাশাপাশি বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থাও নারী অধিকার তরান্বিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে, নির্যাতিত নারীদের বিনামূল্যে আইনী সহযোগিতা দিচ্ছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো। আমাদের সমাজে এমন উদাহরনও রয়েছে যেখানে সাধারণ জনগণের প্রচেষ্টায় বন্ধ হয়েছে বিভিন্ন অন্যায় নির্যাতন।
এখন কথা হচ্ছে আইনি সহায়তার এই রাস্তা কতটা প্রশস্থ? নারীর রাস্তা বরাবরই আইনি সহায়তায় এগিয়ে আসবে। আর তাই তৈরি হয়ে এগিয়ে আসছেন নতুন আলোর সাথে সাথে সুলতানা কামাল, ব্যারিস্টার তানিয়া আমির, এডভোকেট তারানা হালিম, এডভোকেট এলিনা খান প্রমুখ। আইনী সহায়তাটা আমাদের নারী সমাজের জন্য খুবই প্রয়োজন।
বাংলাদেশের রাত থেকে দিনের আলোর জন্য, জীবনের রঙধনুময় আগামীর জন্য যদি একটু ত্যাগ করতে হয়; তা করে হলেও গড়তে হবে বাংলাদেশ। স্বপ্ন আর বাস্তবতার রঙিনযাত্রায় একটা সুন্দর দেশ সকলের কাম্য। যে দেশে সবার আগে নারীর নির্যাতন বন্ধ প্রয়োজন, সে দেশে সচেতনতা তৈরি করতে হবে বিন¤্র মায়াবী বাংলাদেশের জন্য।
কবি সুফিয়া কামাল সারা জীবন স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে গেছেন নারী অধিকার আদায়ের জন্য। সেই অধিকার আদায়ের মধ্য দিয়ে নারীর প্রকৃত স্বাধীনতা তাদেরকে দেয়ার জন্য এখন সবাইকে সচেতন হবে। সচেতনতার মধ্য দিয়ে নারী নির্যাতন রোধ করার পাশাপাশি নিবিড় পথচলায় আমাদেরকে গড়তে হবে বাংলাদেশ, নারী নির্যাতনহীন-ধর্ষণহীন এবং খুনহীন বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে তৈরি থাকতে হবে বাংলাদেশের সকল পুরুষকে। কেননা, নারীর জন্য নিরাপদ সমাজ কেবলমাত্র পৃরুষের দ্বারাই গড়া সম্ভব। নারী-পুরুষের সম্মিলিত পথচলায় একটি সুন্দর সোনার বাংলাদেশ গড়ে উঠলে আমাদেরকে আর নতুন করে আর কোন তিন্নি-আদৃতা বা শাম্মিকে হারাতে হবে না। আর এ কারনেই আইনী সহয়তা ও সচেতনতা প্রয়োজন সমান্তরালভাবে চলা…