বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল বাণিজ্য জোট ‘সাফটা’ ৮ বছর ধরে অকার্যকর!
কাজী মাহফঝুজুর রহমান শুভ,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতার বিশ্ববাজারে আঞ্চলিক জোটের গুরুত্ব ও অবদান বাড়লেও এ সুবিধা থেকে পিছিয়ে আছে সার্ক অঞ্চল। সাউথ এশিয়ান মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল বাণিজ্য জোট। সাফটার বয়স ৮ বছর পার হলেও এখনও নিজেদের মধ্যে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য এ অঞ্চলের মোট বাণিজ্যের ৫ শতাংশেরও কম। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে সার্ক অঞ্চলের ৮টি দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রমুখী। তাছাড়া সার্কভুক্ত একটি দেশের একগুঁয়েমির কারণে সাফটার লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়নি। এমনটাই দাবি দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের।
জানা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অভিন্ন বাজার গড়ে তোলার উদ্দেশেই এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ২০০৩ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত তৎকালীন ৭টি দেশের মধ্যে মুক্তবাণিজ্য ব্যবস্থা চালুর প্রক্রিয়া নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়। এরপর দু’বছর ধরে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত হয় সাফটার রূপরেখা। ২০০৫ সালের নভেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের পরও দু’একটি বিষয়ে মতবিরোধ ছিল। ঐ মাসেই দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বৈঠকে সব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সব সদস্য দেশ সাফটা চুক্তি অনুমোদন সম্পন্ন করার পর ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি কাগজে-কলমে এটি কার্যকর হয়। ২০০৬ সালের ১ জুলাই শুল্ক-কাঠামো কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে বাস্তবরূপ লাভ করে সাফটা।
এ চুক্তি কার্যকর হলেও কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। বিশ্বে যতগুলো আঞ্চলিক সংগঠন রয়েছে, এর মধ্যে সার্ক অঞ্চলে আন্তঃবাণিজ্য সবচেয়ে কম। গত আড়াই দশকে সার্কের এ বাণিজ্য মাত্র ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। যা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় নিতান্তই কম। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক সংগঠন নিজেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য সম্পাদন করে থাকে। সার্কের সদস্য একটি বড় দেশ সাফটা বাস্তবায়নে উদ্যোগী না হয়ে ইতোমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংঙ্গে বাণিজ্য সমপ্রসারণে পদক্ষেপ নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান বলেন, এ অঞ্চলের আন্তঃবাণিজ্য বাড়ানোর জন্য অবশ্যই সাফটার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন জরুরি। তবে সার্কভুক্ত ৮টি দেশই প্রায় একই ধরনের পণ্য উৎপাদন করে। ফলে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগ তেমনভাবে মেলে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। এ চুক্তিটি কার্যকর হতে আরো কয়েক বছর সময় লাগতে পারে বলে মনে করেন ড. আকবর আলী খান।
সার্ক চেম্বার প্রেসিডেন্ট আনিসুল হক জানান, সাফটা বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল বাণিজ্য জোট। সাফটার বয়স ৫ বছর পার হলেও এখনও নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য এ অঞ্চলের মোট বাণিজ্যের ৫ শতাংশেরও নিচে। যেখানে ইইউতে এ হার ৫৫ শতাংশ এবং আসিয়ান ও নাফটা’য় ২১ শতাংশ। এসব কারণে বিশ্ববাণিজ্যে পিছিয়ে পড়ছে এ অঞ্চল।
রপ্তানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ইএবি) সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, সাফটা বাস্তবায়িত না হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে আঞ্চলিক বাণিজ্যের দীর্ঘ স্পর্শকাতর পণ্য তালিকা। সাফটায় ভারত হলো সবচেয়ে বড় দেশ। তার সঙ্গে বাংলাদেশ ছাড়া অধিকাংশ দেশের মধ্যে রয়েছে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি। সাফটা চুক্তির আওতায় প্রত্যেক সদস্য দেশেরই একটি করে স্পর্শকাতর পণ্য তালিকা রয়েছে। এ তালিকার পণ্য সংশ্লিষ্ট দেশে রপ্তানি করা যাবে না এটা হলো বিধিবদ্ধ নিয়ম।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের এ তালিকায় রয়েছে ১ হাজার ২৫৪টি পণ্য। একইভাবে ভারতের ৮৬৫টি, শ্রীলংকার তালিকায় ১ হাজার ৭৯টি, পাকিস্তানের ১ হাজার ১৯১টি, আফগানিস্তানের ১ হাজার ৭২টি, মালদ্বীপের ৬৭১টি, ভুটানের ১৫৭টি পণ্য। বাংলাদেশ ও নেপাল তাদেও তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল পণ্য তাদের স্পর্শকাতর তালিকায় রেখেছে। এছাড়া সদস্য দেশগুলোর নানা ধরনের অশুল্ক বাধার প্রাচীর তো আছেই। যদিও ভারত চলতি বছর তাদের স্পর্শকারত বস্ত্র পণ্য থেকে ৪৬টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে।
উল্লেখ্য, সাফটা চুক্তির শুল্ক-কাঠামো অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভারত ও পাকিস্তান তাদের আমদানি-পণ্যের নির্ধারিত শুল্ক ১০ শতাংশ হ্রাস করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০০৭ সালের ১ জুলাই থেকে দুটি দেশ শুল্কহার আরো ৩০ শতাংশ হ্রাস করে। ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের পণ্যের শুল্কহার ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ ১০ বছরের মধ্যে শুল্কহার একই স্তরে নামিয়ে আনবে।