লাশের গন্ধ! সোদা মাটির গন্ধ কই?
মীর আব্দুল আলীমঃ কবির সেই “সোদা মাটির গন্ধ” নেই দেশের বাতাসে ! স্বাভাবিক মৃত্যু আজ অস্বাভাবিক। বাতাসে লাশের গন্ধ ! দেশটা যেন রক্তে মাখামাখি। ভয়াবহ আগুন, সড়ক পথে দুর্ঘটনা এবং ফ্লাইওভার ভেংগে পড়া-সারি সারি লাশ। লাশের গন্ধ আর স্বজনদের আহাজারি বাতাসে করুন সুর তৈরি করে যা সাধারন মানুষের চোখ ভিজিয়ে দেয়। এভাবে মৃত্যুর মাতম কেন ফিরে আসে বারবার ? স্বজনদের আহাজারি; মন্ত্রী এমপি আর নেতদের শোক প্রকাশের তামাসা…! এইতো চলছে দেশে। দুর্ঘটনা পর উদ্ধার তৎপরতা দেখা এবং নিহতদের স্বজনদেরকে সান্তনার বানী শোনাতে দেশের মন্ত্রী বাহাদুরগন হেলিকপ্টার কিংবা এসি গাড়ীতে চড়ে ঘটনাস্থলে আসেন। রাষ্ট্রপতি , প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীনেত্রীর পক্ষ থেকে প্রেস রিলিজ দিয়ে মিডিয়াতে জানানো হয়, দুর্ঘটন্য়া উনারা গভীর শোক এবং দু:খ প্রকাশ করেছেন। মাঝে মাঝে সরকারের তরফ থেকে নিহতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ ঘোষনা করা হয়। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের কোনো পদক্ষেপের কথা শোনা যায় না। তারপর আবার যেই লাউ সেই কদু। বারবার আগুনে পুড়ে মানুষ মরে। লঞ্চ ডুবে মানুষ মরে। ওভার বিজ্র ধ্বসে মানুষ মরে। বস্তিতে; বাসাবাড়িতে মানুষ মরে। বাসে ট্রাকে চাপা পরে মানুষ মরে। শুধু মরে আর মরে। এর কোনো প্রতিকার নেই। প্রতিক্ষেত্রেই কেবল দুঃখ প্রকাশ করা হয়। আমরা দুঃখ প্রকাশ করা শিখেছি; দুঃখ লাঘব করা শিখিনি।
আমরা কেন কোথাও নিরাপদ নই ? ঘরেও না; বাহিরেও না। দেশে স্বাভাবিক মৃত্যু কেন আজ অস্বাভাবিক ? নিজ ঘরে থাকবেন ? সাগর রুনী অথবা ফরহাদ দম্পতিদের মত খুন হবেন। রাস্তায় যাবেন ? ইলিয়াছের মত গুম হবেন ; যেকোনো সময় হুড় মুড় করে আপনার উপরই ভেঙ্গে পড়তে পারবে ফ্লাই ওভারের গাড কিংবা যান্ত্রীক দানব বাস ট্রাকে চাপা দিয়ে কেড়ে নিতে পারে আপনার প্রাণ। কর্মস্থলে থাকবেন ? সর্বনাশা আগুনে যে আঙ্গার হবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায় ?! নদীতে যাবেন ? সেখানেও লঞ্চ ডুবিতে প্রাণ যাবে। কোন নিরাপত্তা নেই, কোন গ্যারান্টি নেই জীবনের, যখন যেখানে সেখানে মৃত্যু। ফ্লাইওভার ভেঙ্গে পড়ছে, ব্রিজ ভেঙ্গে পড়ছে, বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ছে। যা কিছু মানুষের সৃষ্টি, সবই ভেঙ্গে পড়ে মানুষের ওপর। ভাগ্যিস আকাশটা সৃষ্টিকর্তার গড়া ছিলো ! তা না হলে সেটাও যে ভেঙ্গে পড়ত ঘাড়ে। আজ স্বাভাবিক মৃত্যুই যেন অস্বাভাবিক। কিন্তু কেন? কে দেবে এর উত্তর। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ট্রাজেডি আর আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনের ভয়াবহ আগুন আমাদের অশান্ত করে তুলেছে। অনিশ্চিত করে ফেলেছে শত শত পরিবার ভবিশ্যত। সে কি দৃশ্য। স্বজনরা খুঁজছে স্বজনদের লাশ। লাশও পাওয়া যাচ্ছে না। লাশের নামে থরে থরে ভেতর থেকে যা আসছে তা যে কেবলই কয়লা খন্ড। আমার মনে হয়েছে আমি ও মনে হয় হাজার মানুষের ভিড়ে আমার আদোওে বোন কিংবা ভাইকে খুঁজছি। সরবে বার বার কেঁদেছি, ভাবি কেন এমন হয়। বার বার এমন হচ্ছে কেন ?—কেন ?—কেন ?
সময় তারিখ ২৫ নভেম্বর দিবাগত রাত। স্থান আশুলিয়া থেকে বহদ্দারহাট। রাজধানীর ঢাকার আশুলিয়ার তাজরিন ফ্যাশনে ভয়াবহ আগুন লাগে এবং প্রায় একই সময়ে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ফ্লাইওভারের ৩ টি ব্লক ভেঙ্গে পড়েছে । যখন লেখাটি লিখছি তখন আশুলিয়ায় মোট ১২৪ আর বদ্দাহাটে ২২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করতে পেরেছি। ফ্লাইওভারের গার্ডার কীভাবে ভেঙ্গে পড়ে ? যারা কাজ নিয়েছে, তারা কি জানতো না যে নিচে মানুষ চলাচল করে ? নির্মাণের সময়ে গার্ডার ভেঙ্গে পড়ে কীভাবে ? উপযুক্ত নির্মাণ সংস্থাকে কি কাজটি দেওয়াা হয়েছিলো ? কোথায় সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান ? তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে খুবই ভালো কথা, ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক হওয়া যাবে, কিন্তু যাদের প্রাণহানি হলো তাদেরকে ফিরিয়ে দেবে কে ? এসব তো অনাকাঙ্খিত মৃত্যু। এসব নিছক দুর্ঘটনা নয় । এগুলো কি এড়ানো যেতো না ? যদি বলি অনিয়ম, অবহেলা, আত্মসাৎ, সংশ্লিষ্টদের নজরদারীর অভাব আর অব্যবস্থাপনাই এসব মৃত্যুর জন্য দায়ি ? মোটেও ভূল হবে না। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ফ্লাইওভারের কাজের মান নিয়ে আগেও এন্তার অভিযোগ ছিল। এর আগেও সেখানে জুন মাসে একবার গার্ডার ভেঙ্গে পড়েছিলো। ভাগ্যিস দুপুর বেলায় মানুষের চলাচল কম ছিলো বলে, সেখানে লোকজন না থাকায় প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেনি। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে তখন পত্রপত্রিকা গুলো লিখেছে । তাতে তোয়াক্কা করেনি সংশ্লিষ্ট বিভাগ। তাই যা হবার তাই হলো। এ দেশে পোশাক কলগুলোতে আগুনে পুরে মরবার ঘটনাও নতুন নয়। আগেও বহুবার হয়েছে। মানুষ পুরে পুরে কয়লা হবার দুশ্য দেশবাসী মাঝে মধ্যেই অবলোকন করে থাকে। সাভারের ঘটনায় আমরা পত্রিকা এবং টেলিভিশনে যা দেখলাম তাতে করে পুরে যাওয়া মানুষ গুলো আঙ্গার হবার আগে মোাইল ফোনে তাদের করুন পরিনতির কথা জানিয়েছে স্বজনদের কাছে । অনেকে বলেছে ,গার্মেন্টস কতৃপক্ষ আগুন লাগার পর উধাও হয়ে গেছে। উদ্ধারে সচেষ্ট থাকলে হয়তো দুর্ঘটনার মাত্রা কম হতো। ঐ গামেন্টস শিল্পে অগ্নি নির্বাপনের পর্যাপ্ততা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এ দায় কার ? সরকারের সংশ্লিষ্টার কি এ দায় এড়াতে পারেন ? এতো মানুষের জীবনের মূল্য কি তারা দিতে পারবেন ? কোন অবস্থায়ই নয় ।
কী মর্মান্তিকই না এ মৃত্যু! কিন্তু এভাবে থেতলে; পুড়ে আঙ্গার হয়ে ? ফ্লাইওভারের মস্ত গার্ডের চাপে থেঁতলে গেছে শরীর; কেবল ক্ষতবিক্ষত পা দুটো বের হয়ে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। কারোবা দেখা যাচ্ছে মাথাটুকু। তাও ক্ষতবিক্ষত। গার্ডারে পিষ্ঠ হওয়া তরতাজা শরীর থেকে তখনও গলগলিয়ে রক্ত বয়ে যাচ্ছিল। মুহূর্তে লাল হয়ে যায় পিচঢালা পথ। এমন মৃত্যু কি মেনে নেয়া যায় ? দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে । রোধ করা যাচ্ছে না। আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। প্রশ্ন হলো এসব দুর্ঘটনার ‘স্রষ্টা’ কে ? মানুষই ! তবে কেন রোধ করা যাচ্ছে না ? আইনের প্রয়োগ হলে; নিয়মতান্ত্রিকভাবে ঠিকঠাক মত সব পরিচালিত হলে অনেকাংশেই এসব দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। আমরা যারা লিখিয়ে তারা কেবলই লিখি। কার কথা কে শোনে। পয়সা পেয়ে সবাই একদম চুপ্। মামুজানের মহব্বতে সবার মুখেই কুলুপ আটা থাকে। এসব রুখতে হবে ? যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। সে মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয়, তবে তা মেনে নেয়া আরো কঠিন। প্রতিনিয়তই নানা গেড়াকলে পড়ে একের পর এক অকালমৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না, এ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবেলা করতে হচ্ছে, যা আমাদের কারো কাছেই কাম্য নয়।
(লেখক-মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, কলামিষ্ট, নিউজ-বাংলাদেশ ডটকমের সম্পাদক।)
e-mail-newsstore09@gmail.com