আপন আলোয় আলোকিত একজন…
জবরুল আলম সুমনঃ এইডা কোন ব্যাপার হইলো? হ্যা, অনেকের কাছেই সেই’টা কোন ব্যাপার স্যাপার হতেই পারে কিন্তু তার কাছে নয়। সে এমনই একজন, যে কঠিন জীবনের যে কোন ব্যাপার স্যাপারকে এক তুড়িতে সহজ করে ফেলতে পারে। যে কোন পরিস্থিতিকে সহজভাবে নেয়ার অসীম এক ক্ষমতা তার মাঝে আছে। সে আমার অতি প্রিয় মুখ, সুপ্রিয় বন্ধু (যদিও বন্ধু বলে কেউ কাউকে ডাকিনা দুস্ত বলেই ডাকি), প্রাণের দোসর, প্রিয় ভাই, আমার মতো অনেকেরই প্রিয় মুখ, আপন আলোয় আলোকিত সেই প্রিয় মুখটি হলো রায়হান হোসেন। কিছু মানুষ জন্মে নিজেকে আলোকিত করার জন্য আর কিছু মানুষ জন্মে তার চারপাশটাকে আলোকিত করতে, রায়হান হচ্ছে দ্বিতীয় দলের, যে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেও অন্যকে আলোকিত করতে জানে। নিগূঢ় অন্ধকার থেকেও আলোকচ্ছটা বের করতে জানে… আমি তাকে মাঝে মধ্যে জীবন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া বলেও ডাকি যথার্থ কারণেই। রায়হানের মগজে জ্ঞানের ধারণ ক্ষমতা দেখে আমি সহসাই বিশ্বাস করে ফেলি যে, হ্যা একটা সুপার সনিক কম্পিউটারের স্মৃতি ধারণ ক্ষমতার চেয়ে একজন মানুষের স্মৃতির ধারণ ক্ষমতা কয়েক লক্ষ গুণ বেশী।
আপন আলোয় আলোকিত তারুণ্যের প্রতীক, পারমাণবিক বুদ্ধিমত্ত্বার অধিকারী রায়হানের সাথে ফোনে যখন আমার প্রথম কথা হয় তখই বুঝে গিয়েছিলাম এই ছেলেটা আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো নয়, একেবারেই আলাদা, মাথার মধ্যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ যুক্তি আর বুদ্ধির বিশাল মজুদ। যুক্তি দিয়ে যে কাউকে ধরাশায়ী করতে তাকে খুব একটা সময় খরচ করতে হয়না। বাংলা ভাষায় বিলুপ্তপ্রায় কয়েকটা শব্দের একটা হচ্ছে “প্রত্যুৎপন্নমিতা”। আমি এই কঠিন শব্দটা আমার মাথায় জিইয়ে রেখেছি রায়হানের জন্যই। রায়হানের উপস্থিত বুদ্ধিমত্ত্বার কথা যখনই আমার স্মরণ হয় তখনই এই শব্দটা আমার মাথার মধ্যে ভেসে উঠে। আমার হাতে গুনা যেক’জন কাছের বন্ধু আছেন রায়হান তাদের অন্যতম। সে আমাকে বন্ধুত্বের নতুন এক সংজ্ঞা শিখিয়ে দিয়েছে যা বন্ধুত্বের পুঁথিগত সংজ্ঞার উর্ধ্বে। প্রকৃত বন্ধু বলতে যা বুঝায় রায়হান আমার কাছে তাই কিংবা তারচেয়েও বেশি।
মনে পড়ে যায় বছর তিন আগে ফেসবুকের কোন একটা ফান গ্রুপে রায়হানের সাথে পরিচয় ঘটেছিলো আমার। সেই ফান গ্রুপের একটা পোষ্টে মন্তব্য করতে করতে তাকে চিনেছিলাম। অবাক হয়ে দেখছিলাম মন্তব্যে মন্তব্যে এই ছেলেটা একেবারে ফাটিয়ে দিচ্ছিলো! আস্তে আস্তে তার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে তারপর থেকেই সেই গ্রুপের মধ্যে অঘোষিত ভাবেই আরো একটা গ্রুপ তৈরী হয়ে যায়, সেটা হলো সুমন-রায়হান গ্রুপ। অঘোষিত সেই গ্রুপে আরোও তিনজন সদস্য ছিলো, তারা হলো লুৎফুর, সাইফ ও কামাল। মূল গ্রুপটাও কিন্তু আমরাই তৈরী করেছিলাম, গ্রুপের মজাদার ও স্পাইসি বিভিন্ন পোষ্টে সুক্ষ্ণ ভাবে নানান ছুঁতোয় বিরোধীতা করে হাস্যরসের সৃষ্টি করতাম। মজার ব্যাপার হলো আগের কোন পোষ্টে কোন একটা টপিকের পক্ষ ধরে আমরা এগিয়ে গেছি, নানান উদ্ভট যুক্তি দাঁড় করিয়ে জয়ের ঝান্ডা আমারা ছিনিয়ে নিয়েছি প্রতিপক্ষ বা গ্রুপের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে আবার অন্য কোন পোষ্টে একই টপিকের বিরোধীতা করেও জয়ের ঝান্ডা আবারো আমারাই বগল দাবা করে নিয়েছি। একটা সময় খেয়াল করলাম পারতপক্ষে কেউ আমাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছেনা বা বিতর্কে জড়াচ্ছেনা, কারণ তারা জানতো কোন না কোন ভাবে তাদের হার অবধারিত, কেউ কেউ প্রথমে বিতর্কে আমাদের প্রতিপক্ষ হলেও একটা সময় সেও আমাদের যুক্তি স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতো। হাসাতে হাসাতে কাঁদিয়েছি অনেককে। মনে পড়ে যায় কেউ কেউ আমাদেরকে ব্লক করেও দিয়েছিলো আমাদের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে। আমাদের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পারার অন্যতম কারণ রায়হান। রায়হানের মাথা থেকে বের হওয়ার বিস্ময়কর, মজাদার ও বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তির ঝড়ের সামনে কেউ দাঁড়াতে পারতো না। আজ ফেসবুকে শত সহস্র গ্রুপের ছড়াছড়ি কিন্তু এতো এতো গ্রুপের ভিড়েও আমাদের সেই ফেলে আসা গ্রুপের মজা খুঁজে পাইনা, ম্যাগনিফাই গ্লাস দিয়েও।
সেই গ্রুপ আজ আর নেই, হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে কিন্তু যা থেকে গেছে তার নাম বন্ধুত্ব। সৌদী প্রবাসী রায়হান শত ব্যস্ততার মাঝেও আমার সাথে তার বন্ধুত্ব টিকিয়ে রেখেছে পরিপূর্ণ ভাবেই। সব সময় আমার খোঁজ খবর নিয়েছে এখনো নিচ্ছে (একটু আগে এই লেখাটা যখন লিখছিলাম তখনো সে আমার মোবাইলে ফোন করে আমার খোঁজ খবর নিচ্ছিলো, আমি অবশ্য তাকে বলিনি তাকে নিয়ে আমি একটা নোট লিখছি)। আমার সব সকল সংকটময় মুহুর্তে তাকেই সবচে কাছে পেয়েছি এতো দূরে থেকেও। আমি অকপটে স্বীকার করি সে আমাকে মানসিক ভাবে যতটা সাপোর্ট দিয়েছে, যতটা সময় দিয়েছে আমার হাতের নাগালের কোন বন্ধুও অতটা দিতে পারেনি কখনোই। তার কাছ থেকেই জীবনকে নতুন ভাবে দেখতে শিখেছি, শিখেছি কিভাবে মহাসংকটে থেকেও হাসি খুশিতে জীবনের এক একটা সময় পার করে দেয়া যায়। আমাদের বন্ধুত্ব আজ আর শুধু আমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি সেই সম্পর্ক আমাদের দুজনের গন্ডি পেরে পারিবারিক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মানে রায়হানের মা আর আমার মা দুজনেই আজ বোনের বন্ধনে আবদ্ধ। রায়হানের মা আমাকে ফোন করে প্রথমেই জিজ্ঞেস করবেন তার বোন মানে আমার মা কেমন আছেন। মাঝে মধ্যে তাদের দুজনের মধ্যে বেশ কথাও হয় তবে মজার ব্যাপার হলো রায়হানের মা ঢাকাইয়া ভাষা ছাড়া শুদ্ধ বাংলাতে কথা বলতে পারেন না আর আমার মা সিলেটী ভাষা ছাড়া শুদ্ধ বাংলাতে কথা বলতে পারেন না তাই প্রায়শই আমাকে ইন্টারপেটারের দায়িত্ব পালন করতে হয়… হা হা হা।
প্রতিদিন অন্তত দুই কোটি মানুষের দরজায় তার জন্মদিন এসে নক করে, সে হিসেবে আজ দুই কোটি মানুষের জন্মদিন। আমি আজ সেই দুই কোটি মানুষের ভিড় থেকে একজন প্রিয় মুখকে তুলে আনবো। হ্যা এতোক্ষণে নিশ্চয় ধরে ফেলেছেন সেই প্রিয় মুখটি কার? হ্যা, সেই প্রিয় মুখটি আর কারো নয় আমার প্রিয় বন্ধু রায়হানের। আজ রায়হানের জন্মদিন, শুভ জন্মদিন। কালের অতল গহবরে হারিয়ে যাওয়া আজ থেকে বহু বছর আগে ঠিক আজকের এই দিনের মতো সেই দিনে যদি রায়হান পৃথিবীতে না আসতো তাহলে হয়তো বন্ধুত্বের প্রকৃত সংজ্ঞা আমার কখনোই জানা হতো না, আর থেকে যেতো অপরিপূর্ণ একটা জীবন। রায়হানের মতো একটা বন্ধু যদি কারো জীবনে না আসে তাহলে তার জীবনটাই অপরিপূর্ণ থেকে যায়। মনে পড়ে আমার গত জন্মদিনে রায়হান আমাকে বাংলা চলচ্চিত্রের একটা মিউজিক ভিডিও দিয়ে উইশ করছিল। গানটি ছিলো “একটাই কথা আছে বাংলাতে, মুখ আর বুক বলে এক সাথে, সে হলো বন্ধুউউউ, বন্ধু আমার, বন্ধু আমার…”।
প্রয়াত চলচ্চিত্রাভিনেতা জাফর ইকবাল, ফারুক, সুচরিতা ও প্রমূখদের অভিনীত সেই ছবির উল্লেখিত এই গানটি অনেকের মতো আমিও আগে অনেকবার শুনেছিলাম কিন্তু রায়হান যখন আমাকে সেই গানটি ডেডিকেট করে তখন এতোটাই ভালো লেগেছিলো যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। তখন থেকেই মনে মনে পণ করেছিলাম রায়হানের নেক্সট বার্ড ডে-তে আমি এই গানটি নিজ কন্ঠে গেয়ে রায়হানকে উইশ করবো, কিন্তু আমি এতোটাই বেখেয়ালী এবং কিছুটা অকৃতজ্ঞও যে আজ রায়হানের বার্ড ডে সেটা গতকাল পর্যন্ত আমার মনেই ছিলোনা তাই নিজেকে ভর্ৎসনা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। প্রিয় বন্ধু রায়হানের শুভ জন্মদিনে তাই খালি হাতেই শুভেচ্ছা জানাই। সেই সাথে অসীম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা, তার এই আলোকিত জীবন যেন আরোও দ্যুতিময় হয়ে উঠে। জগতের যা কিছু ভালো, সব ভালোটাই যেন তার দিকে ধাবমান হয়। পরিপূর্ণ জীবনের স্বাদ আস্বাদন করে জীবনের শেষ দিনটাতে দাঁড়িয়ে বুক উঁচিয়ে যেন বলতে পারে “স্বার্থক জীবন আমার”। রায়হানের শুভ জন্মদিনে এইটুক চাওয়া আমার, আর দু’বাহু প্রসারিত করে গলার স্বর উচ্চে তুলে আরো একটি বার বলবো, শুভ জন্মদিন দুস্ত, হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা তোমার জন্য…
জবরুল আলম সুমনঃ প্রাবন্ধিক ও গবেষক।।