এইডসঃ সচেতন নারী, সচেতন স্বপ্ন…
মোমিন মেহেদীঃ এইচআইভি এইডস যখন সারা বিশ্বে হুমকি তখন নারী সবচেয়ে বেশি আতঙ্কগ্রস্থ। তখন গবেষকরা বলেছেন, নারীই এইচআইভি এইডস আক্রান্ত ও ছড়ানোর অন্যতম পথ। এই পথে হেঁটে হেঁটে অসংখ্য মানুষ আজ মৃত্যুর কাছাকাছি পৌছে গেছে। যেখানে নারীই ক্ষতিগ্রস্থ পুরুষের চেয়ে বেশি। আর সেই সূত্র ধরে বর্তমানে এইডস শুধু একটি ভয়ই নয়, এটি একটি সামাজিক সমস্যাও। তাই এইডসকে বন্ধুত্বের মাধ্যমে সামাজিকভাবেও মোকাবিলা করতে হবে। এক্ষেত্রে নারী রাখতে পারে বিশেষ অবদান। অর্থাৎ এইচআইভি ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে কেবল চিকিৎসকরাই ভূমিকা পালন করবেন, সেটা ভাবা ঠিক নয়। সরকারের দিক থেকে যেমন, আমাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ অবস্থান থেকেও তেমন এইচআইভির প্রতিরোধে দায়িত্ব পালন করা জরুরি। আমাদের ছোট ছোট ভূমিকাই ভবিষ্যতের বড় ঝুঁকি থেকে বাঁচাবে। সেই লক্ষ্য থেকেই এগিয়ে যেতে হবে দেশের প্রতিটি মানুষকে। অনেকেই এইডস সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনায় সঙ্কোচ বোধ করেন। কিন্তু অপর্যাপ্ত তথ্য বা ভুল তথ্য আরো বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভ্রান্ত ধারণা এড়াতে এইডস ও এইচআইভি ভাইরাস সম্পর্কে জানতে হবে। আসলে এইডস প্রতিরোধে যেহেতু এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি, তাই সঠিক তথ্য লাভ ছাড়া বিকল্প পথ খোলা নেই। মা-বাবা, অভিভাবকরা উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এইডস সম্পর্কে আলোচনা করতে পারেন, আলোচনা করতে দ্বিধা থাকলে তাদের বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক বইপত্র সংগ্রহ করে সেগুলো পড়তে বলতে পারেন। এক্ষেত্রে বন্ধু ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনসহ বেশ কিছু সংগঠন কাজ করলেও তাদের পক্ষ্যে সম্ভব নয় প্রতিটি নারীর ঘরে ঘরে এই তথ্য পৌছে দেয়া যে, ‘আপনার বিদেশ ফেরত স্বামী বা প্রেমিক দেশে ফেরার পর এইচআইভি/এইডস পরীক্ষা করে একান্ত সান্যিধ্যে যান।’ নৈতিকতা বজায় রেখে চরিত্র গঠন কতটা উপকারী, সে দিকটাও তাদের কাছে তুলে ধরা আবশ্যক। এ ছাড়া একটা পর্যায়ে এসে ছেলেমেয়েরা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে এসব লক্ষ রাখা উচিত। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে তাদের কাছ থেকে দৈনন্দিন কর্মকান্ড জেনে নিলে ভবিষ্যতের শঙ্কা এড়ানোও সম্ভব। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণী কক্ষে শিক্ষকরাও পালন করতে পারেন অগ্রণী ভূমিকা। অনেক কিছুই আছে, যেগুলো মা-বাবা বলতে পারেন না; কিন্তু একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সহজেই মিশে গিয়ে নানা ব্যাপারে তাদের গড়ে তুলতে পারেন। সঙ্গী-সঙ্গিনীর বিভিন্ন কাজের খোঁজ-খবর রাখাও আমাদের রোজকার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে একটি প্রবাদবাক্য প্রচলিত আছে সেটা হলোথ’এইডস প্রতিরোধে এইচআইভি ভাইরাসের সংক্রমণপদ্ধতিই অনুসরণ করো। এইচআইভি ভাইরাস যেমন অন্য অনেক সাধারণ ভাইরাসের চেয়ে আলাদা, এর সংক্রমণপদ্ধতি অনেক বেশি স্পর্শকাতর; ভাইরাসটি নিজে থেকে কারো শরীরে প্রবেশ করে না, ঠিক তেমনি আমরা নিজেও ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ থেকে বিরত থাকলে কেউ আগ বাড়িয়ে অন্যের কারণে এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবে না, নিরাপদ জীবনযাপনে সক্ষম হবে। সুস্থ ও সুন্দর আগামী নিশ্চতকরণের লক্ষ্যে ২০১০ সালের বিশ্ব এইডস দিবসের প্রাক্কালে এই মূল্যবান প্রবাদটিই হোক এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে আমাদের সবার পাথেয়। এইডসের এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। তবে উন্নত বিশ্বে চিকিৎসকরা এইচআইভি/এইডস রোগীদের জন্য বেশ কিছু ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু এসব ওষুধের উচ্চমূল্য ও দুষপ্রাপ্যতার দরুন কিছু দিন আগ পর্যন্তও উন্নয়নশীল দেশে এইডস প্রতিকারে কোনো ওষুধ পাওয়া যেত না। সঠিক মান নিয়ন্ত্রণও ছিল দেশগুলোয় আরেকটি বড় সমস্যা। বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এশিয়ার ভারতসহ কয়েকটি দেশের তৈরি ওষুধ ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে, ফলে ভবিষ্যতে হয়তো ওষুধের সহজলভ্যতার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আবার ওষুধ গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়ার আগে রক্তের সিডিফো গণনা করা প্রয়োজন। সিডিফোর কাউন্টার নামের মেশিনের মাধ্যমে এই গণনা প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হয়। সুতরাং ওষুধের প্রাপ্তি নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে এই যন্ত্রডঁ দেশে বিদ্যমান থাকাও জরুরি। আইসিডিডিআরবিসহ বেসরকারি পর্যায়ের আরো দুটি সংস্থা ইতিমধ্যেই সিডিফোর কাউন্টারের ব্যবহার শুরু করেছে। এর বাইরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালসহ বিভাগীয় পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালগুলোয় সিডিফোর কাউন্টার স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। আগামীকে আরো সুন্দর ও প্রানবন্ত করার জন্য এইডস থেকে নিজেকে, বন্ধুকে, সমাজকে আর দেশকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের বন্ধুত্বের দেয়ালবদ্ধ হয়ে হারিয়ে যাক এইডস, হারিয়ে যাক আগামীর যত বেদনা আর ভয়ের দাপট।
এই দাপট থেকে, কালো থেকে, কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসার সংবাদটি আমাদেরকে আশান্বিত করবে। সেই আশার পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মানুষকে। কেননা, এইডসে মহামারীর দিন শেষ হয়ে আসছে। এমন আশার আলো জ্বালা শিরোনাম আমাদেরকে ভয়কে জয় করার যেমন শিক্ষা দেয়; তেমন শিক্ষা দেয় আলোর সাথে ভালোর সাথে পথ চলার। আর এই শিক্ষার সূত্র ধরে জানা যায়, বিশ্বে অ্যাকিউট ইমিউনো ডিফিসিয়েন্সি সিনড্রোম (এইডস) রোগে মহামারীর দিন শেষ হয়ে আসছে বলে মনে করছে জাতিসংঘ। মূলত এইডস রোগ সংক্রমণের জন্য দায়ী হিউম্যান ইমিউনোডিফিসিয়েন্সি ভাইরাস(এইচআইভি) প্রতিরোধী এবং এ সংক্রমণ প্রতিকারে ব্যবহৃত ওষুধ সুলভ হয়ে ওঠার ফলেই এ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের এইডস কর্মসূচির ইউএনএইডসের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। প্রত্যয়দ্বীপ্ত আগামীর পথ ধরেই জানা যায়, ২০১১ সালে সারাবিশ্বে ৩ কোটি ৪০ লাখ এইচআইভি সংক্রমিত মানুষ ছিল। এইডসে মৃত্যুর পরে এ সংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখে নেমে আসে, যা ২০১০ সালে বিশ্বে এইচআইভি সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৮০ লাখ। ২০০৫ সালে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ২ কোটি ৩০ লাখ এইচআইভি আক্রান্ত মানুষ ছিল বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। রক্তের মাধ্যমে ও যৌন সংসর্গের কারণে নতুন করে এইচআইভি সংক্রমণের হারও বিশ্বজুড়ে কমে এসেছে। ২০১১ সালে নতুন করে এইচআইভি সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫০ লাখ, যা ২০০১ সালের চেয়ে ২০ শতাংশ কম। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৯৫ সাল থেকে ওষুধের মাধ্যমে এইডসের চিকিৎসায় দরিদ্র দেশগুলোর ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের ৯০ লাখ মানুষ রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি এইচআইভি আক্রান্ত মানুষের বসবাস সাব-সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলে, যেখানে প্রতি ২০ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন এইচআইভি আক্রান্ত। এশিয়ার চেয়ে এইচআইভি সংক্রমিতর সংখ্যা সেখানে ৫ গুন বেশি। দক্ষিণ, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলো মিলিয়ে এইচআইভি সংক্রমিতের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। ২০০৩ সালের চেয়ে ২০ গুন বেশি। ২০১০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে চিকিৎসার অন্তর্ভূক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারন করেছে জাতিসংঘ। ইউএনএইডসের নির্বাহী পরিচালক মিশেল সিডিবে বলেন, ’এ প্রকল্পের কাজের গতি ক্রমেই বাড়ছে। যে লক্ষ্য অর্জনে আগে পুরো দশক পেরিয়ে যেত তা এখন ২৪ মাসের মধ্যেই সম্ভব। তিনি বলেন রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এবং তা অনুসরণ করলে সার্বজনীন লক্ষ্য অর্জন সম্বব, এটি তারই প্রমাণ। প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০০১ সালের পর থেকে এইচআইভি সংক্রমণের হার সবচেয়ে দ্রুত কমেছে ক্যারিবিয়ার ও সাব-সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলে। এ অঞ্চলগুলোতে এক দশকে সংক্রমণের হার ২৫ শতাংশ কমেছে। তবে ২০১১ সালে নতুন করে এইচআইভি সংক্রমিতদের ৭১ শতাংশেরই বাস সাব-সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলে। এ পর্যন্ত এইডস রোগে মারা যাওয়া ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখই এ অঞ্চলের বাসিন্দা। এদিকে ২০০১ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাতে নতুন করে এইচআইভি সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
এখন কথা হচ্ছে, আমরা কি করছি, কি করবো? আমরা যা করছি, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে স্বপ্নজ-সচেতন হয়ে উঠতে হবে বাস্তবতার হাত ধরে। যে হাত তৈরি করতে পারে প্রত্যয়ের পথ, সমস্যা সমাধানের পথ। এইডসের বিরুদ্ধে সচেতনতার কোন বিকল্প নেই, বিকল্প নেই নতুুন মত নতুন পথ-এরও…
মোমিন মেহেদী : রাজনীতিক ও কলামিস্ট