প্রতিবন্ধীদের প্রতি প্রয়োজন সকলের সহানুভূতিশীল আচরণ
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ জাতিসংঘ ঘোষিত প্রতিবন্ধী দশক ছিলো ১৯৮৩-১৯৯২। এই দশকের শেষ লগ্নে ১৯৯২ সালের ১৪ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৩ জিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ঘোষণা করে (সিদ্ধান্ত ৪৭/৩)। প্রতিবন্ধী দশকের মূল লক্ষ্য ছিলো প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি, তাদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তাদের সম অধিকার প্রদান করা। একই লক্ষ্যে আরো অধিক তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সরকার সমূহকে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালনের অনুরোধ জানায় (সিদ্ধান্ত নং ৪৭/৮৮)। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সংগতি রেখে বাংলাদেশেও যথাযথ মর্যাদার সাথে দিবসটি পালন করা হয়। এই লক্ষ্যে সরকারি কর্মসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ন্যাশনাল ফোরাম অব অর্গানাইজেশন ‘ওয়াকিং উইথ দি ডিসাএবলড’ দিবসটি উদযাপনের উদ্যোগ নেয় প্রতি বছর।
এক পরিসংখ্যানের আলোকে জানা যায়, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখ যোগ্য অংশ প্রতিবন্ধী। এদের সংখ্যা দুই কোটির ঊর্ধ্বে। এরা শারিরীক, মানসিক, শ্রবণ বা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক তথ্য অনুযায়ী সমগ্র পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক দশমাংশ লোক কোন না কোন ভাবে প্রতিবন্ধীত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ। সার্বিক ক্ষতিগ্রস্থদের সংখ্যা অর্ন্তভুক্ত করলে এ হার শতকরা ২৫ শতাংশে উন্নিত হওযার আশঙ্কা রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের শতকরা ৮০ ভাগ প্রতিবন্ধীই বাস করে গ্রামে। পরিবারের সদস্য ও রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের মতো তাদেরও রয়েছে জীবন যাপনের অধিকার। এই প্রতিবন্ধীদেরকে আর্থিক ও সামাজিকভাবে পুণর্বাসন করার মাধ্যমে সমাজের সকল অংশের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব। সুতরাং প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিচর্যা, শিক্ষা ও সঠিক প্রশিক্ষণ। বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রতিবন্ধীদের জন্য ইতোমধ্যেই প্রণয়ন করেছে নানাবিধ কর্ম পরিকল্পনা। প্রতিবন্ধীদের জন্য এ সকল কর্ম পরিকল্পার মধ্যে রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও পুণর্বাসনে চিকিৎসা সেবা। আরো রয়েছে উপকরণ সরবরাহ, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, পুলর্বাসন ও পরামর্শ প্রদানসহ অন্যান্য কার্যক্রম। এছাড়াও সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য অঘোষিত পদের চাকরির ক্ষেত্রে শতকরা ১০ শতাংশ পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছে। সরকারের পাশাপাশি কাজ করছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা তথা এনজিও। প্রতিবন্ধীদের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা। সচেতন থাকা। তাদের প্রতি অন্যায় অবিচার কিংবা বৈরী আচরোন পরিহার করা। প্রতিবন্ধীদের মধ্যে প্রতিভাবানদের খুঁজে বের করা। তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেয়া। মনে রাখা প্রয়োজন প্রতিবন্ধীরাও তাদের প্রতিভা দিয়ে দেশের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। আর হয়তো সে প্রচেষ্টার-ই অংশ হিসেবে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ইদানিং চোখে পরে প্রতিবন্ধীদের প্রতিভা বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠান। তাদের প্রসঙ্গে জানা-অজানা বিবিধ প্রতিবেদন। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বিজ্ঞানীরা অবিরাম কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি জিহ্বা দিয়ে প্রতিবন্ধীরা কম্পিউটারারের সাহায্যে সকল কাজ করতে পারবেন এমন আশাবাদও জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
জর্জিয়া টেক-এর গবেষকরা মনে করেন, একটি চৌম্বকীয় টাং-পাওয়ারড (জিহ্বা-নিয়ন্ত্রিত) সিস্টেম একজন প্রতিবন্ধীর মুখকে ভার্চুয়াল (কার্যত) কম্পিউটারে রূপান্তরিত করতে পারে, দাঁতকে পরিণত করতে পারে কি-বোর্ডে, যেখানে জিহ্বা সহজেই স্পর্শ করতে পারে। আর এভাবেই জিহ্বার দ্বারা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করা/চালানো যাবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।
‘শুধু জিহ্বা নাড়ানোর মাধ্যমেই আপনি আপনার পরিপার্শ্ব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন’Ñ বলেছেন মেইস্যাম গোভানলো। তিনি জর্জিয়া টেকের সহকারী অধ্যাপক এবং এই গবেষক দলের নেতা। জিহ্বাকে এক ধরনের জয়স্টিকে পরিণত করার অর্থাৎ জিহ্বার কাছে জয়স্টিকের কাজ নেয়ার চেষ্টা করছেন গবেষকরা। এর ফলে প্রতিবন্ধীরা হুইলচেয়ার চালাতে পারবেন, গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্রও নাড়াচাড়া করতে পারবেন এবং কম্পিউটার চালাতে পারবেন। গবেষণার কাজ এগিয়ে চলছে। অনেকে এটি পরীক্ষা করে দেখতেও আগ্রহী।
মুখমন্ডলের বিভিন্ন পেশির নাড়াচাড়ার মাধ্যমে ইলেকট্রনিক্স নিয়ন্ত্রণের এ বিষয়টি কতোটুকু সফল হবে তা নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ থাকলেও প্রতিবন্ধীদের শুভাকাঙ্খীরা কিন্তু আশায় বুক বেঁধেছেন এর জন্য।
‘যোগাযোগের জন্য এতে অসংখ্য সুইচ এবং অপশন বা বিকল্প থাকবে’ বলে মনে করছেন মাইক জোন্স। তিনি আটলান্টা পুনর্বাসন হাসপাতালের শেফার্ড সেন্টারের রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজির সহ-সভাপতি। তিনি আরো বলেন, ‘এটা খুবই সহজ আর কেউ হয়তো একেবারে নতুন একটি ভাষা শিখে ফেলবে।’ গলার নিচ থেকে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী লাখ লাখ আমেরিকান যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করে, সেগুলোর তুলনায় এটি একেবারেই বিপরীত।
‘সিপ অ্যান্ড পাফ’ পদ্ধতি অর্থাৎ একটি টিউবের মাধ্যমে নিঃশ্বাস নেয়া ও ছাড়ার মাধ্যমে কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ করার এ পদ্ধতিটি প্রতিবন্ধীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু এখানে সীমাবদ্ধতা হলো, মাত্র চার ধরনের কমান্ড এর মাধ্যমে করা যায়।
জটিল ধরনের প্যাড ব্যবহার করে ঘাড় ও মাথার নড়াচড়ার ওপর ভিত্তি করে তৈরি ‘কন্ট্রোল সিস্টেম’ও খুবই ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবন যা চোখের নড়াচড়ার ওপর ভিত্তি করে তৈরি তা সম্ভাবনাময়। এটি ব্যয়বহুল ও ধীরগতির হলেও এর মাধ্যমে মিশ্রিত সিগনাল সহজে গ্রহণ করা যায়।
এ কাজে জিহ্বা খুবই নমনীয়, সংবেদনশীল এবং বিরামহীন কর্মরত একটি উপায়। মুখমন্ডলের অন্যান্য পেশির মতো এটি দুর্ঘটনায় রক্ষা পায়, যেখানে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে থাকে। জিহ্বা এ থেকে রক্ষা পায় কারণ, এটি মস্তিষ্কের সঙ্গে সম্পর্কিত, স্পাইনাল কর্ডের সঙ্গে নয়।
জিহ্বার মাধ্যমে এসব কাজ পাওয়ার সম্ভাবনার বিষয়টি বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিন ধরে আকৃষ্ট করছে। ষাটের দশকে এক গবেষণায় দেখা গেছে, জিহ্বাকে প্রিমিটিভ লেন্সে পরিণত করতে এর টিস্যুর সঙ্গে ইলেকট্রোড যুক্ত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় জিহ্বার সঙ্গে ক্যামেরা যুক্ত করা হয়েছে। জিহ্বায় ইলেকট্রোড এমনভাবে যুক্ত করা হয়েছে, যেন এটি কোনো বস্তু। এর সাহায্যে অন্ধরা বিভিন্ন ইমেজ অনুধাবন করতে পারবেন।
মুখের ভেতরের ওপরের অংশে এটি স্থাপন করা হবে যেন সহজেই ইলেকট্রনিক্স নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
গোভানলোর কাজ একটি ভার্চুয়াল কি-বোর্ড তৈরিতেই নিমগ্ন, সাধারণ কি-বোর্ড নয়। এজন্য সে ৩ মিলিমিটার প্রশস্ত একটি চুম্বক জিহ্বার মাথার নিচের অংশে রাখার কথা বলছেন।
গালের দুই পাশের দুটি সেন্সর এ চুম্বকটির নড়াচড়ার তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর তা ওপরে একটু বড় আকারের হেডগিয়ারে পাঠিয়ে দেয়। এসব তথ্য একটি সফটওয়্যারে প্রসেস/প্রক্রিয়াকরণ করা হয়, যা এ নড়াচড়াকে রূপান্তর করে কমান্ড বা হুকুম হিসেবে হুইলচেয়ার এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক্সে পাঠিয়ে দেয় ও নিয়ন্ত্রণ করে।
এ সিস্টেমটি অন/চালু করার পর ব্যবহারকারীকে ছয়টি কমান্ড স্থাপন করতে হয় যথা- বাম, ডান, সামনে, পেছনে, সিঙ্গল ক্লিক ও ডাবল ক্লিক।
এটি খুবই উৎসাহ-উদ্দীপক ঘটনা। গোভানলো আশা করেন, একদিন তিনি আরো এক ডজন কমান্ড এর সঙ্গে যুক্ত করবেন। এভাবে তিনি দাঁতগুলো কি-বোর্ডে এবং গাল দুটিকে কম্পিউটার কনসোলে পরিণত করবেন। যেমনÑ ‘লেফট-আপ’ কমান্ড দিয়ে হয়তো তিনি লাইট জ্বালাবেন, ‘রাইট-ডাউন’ কমান্ড দিয়ে হয়তো টেলিভিশন বন্ধ করবেন।
জর্জিয়া টেকের ছাত্রদের ওপর পরিচালিত প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষণের পর গবেষক দলটি ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ডলার এবং ক্রিস্টোফার অ্যান্ড ডানা রিভস ফান্ড থেকে দেড় লাখ ডলার সহায়তা পাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
একটি কথা অনস্বীকার্য যে, গণজাগরণের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া। সুতরাং প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বর্তমান কালে মিডিয়া যে সব ভূমিকা পালন করছে সেটি র্নিঃসন্দেহে দেশের জন্য মঙ্গলকর। প্রতিবন্ধীদের জন্য সহানুভূতি ও সচেতনতাকে জাগ্রত করাই এ দিবসটি পালনের মূল উপাত্ত। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ সমূহের মধ্যে রয়েছে; (১) দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও পুণর্বসনের জন্য দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে বিদ্যালয় স্থাপন। (২) শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও পুণর্বাসনের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় ৯টি বিদ্যালয় স্থাপন। (৩) চক্ষুষ্মান ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে দৃষ্টিহীনদের শিক্ষা প্রশিক্ষণের জন্য ৬৪টি মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ে সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রম। (৪) বয়ষ্ক দৃষ্টিহীনদের বৃত্তি মূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও আতœনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার লক্ষে টঙ্গীতে একটি প্রতিষ্ঠান (টিআরসিপি)। (৫) শারীরিক প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা উপকরণ ও অঙ্গহীনদের জন্য কৃত্রিম অঙ্গ উৎপাদন করার লক্ষ্যে টঙ্গীতে একটি কমপ্যুটারাইজড ব্রেইল প্রেস ও কৃত্রিম অঙ্গ উৎপাদন কেন্দ্র। (৬) গ্রামীণ প্রতিবন্ধীদের জন্য বৃত্তিমূলক পুর্ণবাসনের জন্য উপকেন্দ্র। (৭) অন্ধ, অন্ধ প্রায় ব্যক্তি, বধির ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ঢাকার মিরপুরে শিক্ষা প্রশিক্ষণ এবং পর্ণবাসনের লক্ষ্যে একটি জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র। (৮) মানসিক প্রতিবন্ধীদের যতœ, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও পুণর্বান কল্পে চট্রগ্রমে একটি প্রতিষ্ঠান।
আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে প্রতিবন্ধীরা এই সমাজের অংশ। তারাও কারো ভাই, কারো বোন। তাদেরও রয়েছে এই পৃথিবীর অপরূপ শোভায় নিশ্চিত ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। সুতরাং করুণা নয়, তাদের প্রয়োজন আমাদের সকলের সহযোগিতা। আর সেই সহযোগিতার হাত প্রসারিত করাই হোক আজকের দিনের প্রেরণা…!
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সম্পাদক,এসবিডি,নিউজ24 ডট কম।।