অন্ধকারের রাজনীতিঃ বিদায় ২০১২
মোমিন মেহেদীঃ এই বদ্ধভূমি একদিন আমার স্বদেশ ছিলো। সেই স্বদেশ সত্যি সত্যি দত্যিদের রঙ্গপুরীতে পরিণত হয়েছে। একাত্তরের পাক-রাজাকার আর আলবদরদের রঙ্গলীলায় জীবন দিয়েছে লক্ষ লক্ষ নারী, জীবন দিয়েছেন লক্ষ লক্ষ বীর বাঙালি। আজ ৪১ বছর পরও পিছু ছাড়েনি সেই দত্যিরা। একাত্তরের প্রেতাত্মাতারা ঘুরে ফিরে বারবার আসছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও যুদ্ধাপরাধী-জামায়াত শিবিরের রগকাটা বাহিনীর ঘাড়ে চরে।
তথাকথিত রাজনীতি আর তথাকথিত অর্থনীতির রোষানলে পরে ক্রমশ সম্বলহীন হচ্ছে বাংলাদেশের মত এশটি উজ্জল সম্ভাবনার দেশ। এখানে নতুন করে পুরোনো খুন-ধর্ষণ ফিরে আসে সকালের সূর্যের সাথে। খুন, গুম, অপহরণ, প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে ছিনতাই ও ডাকাতিসহ নানা অপঘাতের মধ্য দিয়ে আমরা পার করছি প্রতিটি দিন। আর সেই হতাশা-শূণ্যতায় আরেকটি বছর শেষ হলো আমাদের জীবন থেকে। শেষ হলো ২০১২ ইংরেজি বর্ষ। আইনশৃঙ্খলার চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে পুরো একটি বছর দেশবাসী ছিল দিশেহারা। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম, সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তা খালাফ আল আলী খুন, মায়ের বুকে গুলি করে শিশু পরাগ মল্লিকে অপহরণ, ছাত্রলীগের চাপাতির আঘাতে নিরীহ পথচারী বিশ্বজিৎ খুন, সংসদ ভবন থেকে তরুণীর লাশ উদ্ধার, আশুলিয়ায় আগুনে পুড়ে ১১১ পোশাক শ্রমিকের করুণ মৃত্যু এবং শেষ দিকে জামায়াত-শিবিরের হাতে পুলিশের মার খাওয়া এবং তাদের জঙ্গিপনা ও চোরাগোপ্তা হামলার ঘটনা ছিল মানুষের মুখে মুখে।
এই সবকিছুর পেছনেই ছিলো আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক ক্ষমতার রাস্তায় এগিয়ে চলা। পেছনে ছিলো ক্ষমতার জন্য নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন। আর তাদের রাজনৈতিক অরাজকতার সূত্র ধরে সারাদেশে নেমে এসেছে অন্ধকার। বাঙালি এই অন্ধকার থেকে কালো থেকে আলোর দেখা চায়; চায় আরেকবার স্বাধীন হতে। যে স্বাধীনতা হাতের মুঠোয় পেয়েও হারাতে হয়েছিলো ক্ষমতার রাজনীতির জন্য। সেই অতিতে নয়; আলোকিত তরুণ প্রজন্মের পথ ধরে এগিয়ে আসতে চায় আগামী; আলোকিত আগামী। আর তাই তরুণরা সংগঠিত হচ্ছে। যাদের জন্য নতুনধারা বাংলাদেশ গড়ে উঠছে; তারা নতুন প্রজন্ম। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এই তরুণ প্রজন্মের রায়ে ক্ষমতায় আসলেও নির্বিচারে হত্যা-ধর্ষণ আর হামলা-মামলার মুখোমুখি করেছে তারা নতুন প্রজন্মকে।
আজ যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের ধোয়া তুলে আবারো ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ; তখন তরুণ প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে অন্ধকার থেকে আলোর দেশে পরিণত করতে। কেননা, আমরা দেখেছি যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমও ছিল চরম বিতর্কিত। তাদের হাতে সাংবাদিক, আইনজীবী, বিচারক নির্যাতন, আদালত পাড়ায় তরুণীর শ্লিলতাহানি ও জেল থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীর জামিনে মুক্তির পর লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ছিল আলোচিত। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে আগামী বছর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশে অপরাধের মাত্রা আরো বেড়ে যেতে পারে। জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় রাজনৈতিক নেতাদের কাছে নিজেদের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য অনুসারী ক্যাডাররা বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটাতে পারে। এছাড়া যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করতে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা আগের তুলনায় আরো বেশি চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে পারে বলেও আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। তবে এ জাতীয় আশঙ্কা নাকচ করে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
২০১২ তে সবচেয়ে সমালোচিত হত্যাকান্ডের মধ্যে ছিল ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে নিজ ফ্ল্যাটের বেডরুমে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনির নৃশংসভাবে খুন হওয়া। ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। পরে মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়। তদন্তের শুরুতে মামলা ধামাচাপা দেয়ার নানামুখী গুঞ্জন উঠতে থাকে। এরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি জনস্বার্থে এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের খুনিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা এবং হত্যার কারণ নির্ণয়ে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। পরে আদালত ২২ মার্চ বৃহস্পতিবারের মধ্যে সাগর-রুনি হত্যাকা-ের ঘটনায় তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য পুলিশের আইজিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। পরে আইজিপি ১৭ এপ্রিল আদালতে অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদন পর্যালোচেনা করে আদালত ডিবি দক্ষিণের ডিসি মনিরুল ইসলামকে গত ১৮ এপ্রিল ডেকে পাঠান। মনিরুল ইসলাম আদালতে গিয়ে তাদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেন। এরপর মামলাটি র্যাবে হন্তান্তর করা হয়। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ডিএনএ টেস্ট ও কয়েকজন ‘চোর’কে গ্রেপ্তার দেখিয়ে নতুন নাটকের জন্ম দেয়া হয়। এ ঘটনা এখনো নানা আলোচনা-গুঞ্জনের জন্ম দিচ্ছে। ৫ মার্চ সোমবার দিবাগত রাতে গুলশানের ১২০ নাম্বার রোডে বাসার অদূরে সৌদি দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব (হেড অব সৌদি সিটিজেনস অ্যাফেয়ার্স) খালাফ আল আলীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভোর সাড়ে ৫টার দিকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ৭ মার্চ গুলশান থানার এসআই মোশারফ হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের নামে একটি খুনের মামলা করেন। পরবর্তীতে ১৪ মার্চ মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর হয়। এই মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হলে তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর হাজারীবাগের ৪৮/১৫/জি ভাগলপুর লেনের বাসার ৩ তলার ফ্ল্যাট থেকে বিডিআর স্কুল অ্যান্ড কলেজের মেধাবী ছাত্রী তাসনিম আক্তার করবীর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। ধর্ষণে বাধা দেয়ার কারণে তাকে হত্যা করা হয় বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। ১৩ বছর বয়সী করবী ঢাকা বারের আইনজীবী দম্পতি মিজানুর রহমান-আফরোজা বেগমের একমাত্র মেয়ে। ওই মামলায় শামিম আহমেদ নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। চলতি মাসের ৯ তারিখে বিএনপির ডাকা অবরোধের দিন সকালে পুরান ঢাকায় ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী ক্যাডারদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন পথচারী বিশ্বজিৎ দাস। জামায়াত-শিবিরকর্মী সন্দেহে তাকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকা-ে সরাসরি জড়িত ৬ জনকে ও সন্দেহজনক ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বিশ্বজিৎ হত্যাকা-ের পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। সে সমালোচনার রেশ যায়নি এখনো। গত ২৯ এপ্রিল মধ্যরাতে উত্তর বাড্ডার পূর্বাচল সড়কের ১০ নাম্বার লেনের এক নাম্বারের নিজ বাড়িতে শিল্পকলা একাডেমীর সাবেক পরিচালক মো. নজরুল হককে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তখন তার স্ত্রী সেলিনা হকও দুর্বৃত্তদের হাতে গুরুতর আহত হন। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নিহতের ভাগ্নে এনামুলের দেয়া তথ্যমতে প্রতিবেশী কামাল, রিজিয়া, আমিরুল্লাহ, আবু রায়হান, কাহার ও আমিরুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৭ জুন সেগুনবাগিচার তোপখানা রোডের একটি বাড়িতে মা’কে হাত-পা-মুখ বেঁধে রেখে অজ্ঞাত খুনিরা মেয়েকে শ্বাসরোধে হত্যা করে। পরে ঘাতকরা ওই বাসা থেকে বেশকিছু স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা ও জমির ছয়টি দলিল লুট করে নিয়ে যায়। নিহত নিশাত বানু (৪০) তার মা খালেদা বানুর (৭৩) সঙ্গে তোপখানা রোডের ২৭/১৩/১৪ নাম্বার হোল্ডিংয়ের নিজস্ব বাড়ির নিচতলায় বসবাস করতেন। ৬ এপ্রিল সকালে মিরপুরে ছিনতাই ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন হযরত আলী। এ ঘটনায় পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে হিমু ও উজ্জ্বল নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিলেও তারা কেউই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি। গত ২১ এপ্রিল হরতালের আগের দিন খিলগাঁও থানাধীন মালিবাগ এলাকায় দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে ঈগল পরিবহনের বাসের ভেতর পুড়ে মারা যান চালক বদর আলী বেগ। শ্রমিক সংগঠক আমিনুল ইসলাম হত্যাকা- তদন্ত করছে টাঙ্গাইলের ডিবি পুলিশ। এ ছাড়া, ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি কমিটি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে কোনো তদন্তেই খুনিদের সন্ধান মেলেনি। ২২ এপ্রিল সংসদ ভবন চত্বরে এমপি হোস্টেলের ৬ নাম্বার বস্নক থেকে এক নারীর গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এখন পর্যন্ত ওই নারীর পরিচয়ই মেলেনি বলে জানান শেরেবাংলা নগর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাকির হোসেন মোল্লা। গত ২ জুন রাজধানীর হাতিরপুল এলাকায় সুস্মিতা নামে এক তরুণীকে হত্যার পর তার লাশ ২৬ টুকরো করে বাচ্চু নামের তারই প্রেমিক। মাথাসহ শরীরের বেশকিছু অংশের হাড়-মাংস আলাদা করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলা হয় পার্শ্ববর্তী ভবনের ছাদসহ আশপাশের চারিদিকে। আর নাড়ি-ভুঁড়িসহ বাকি অংশ ফেলা হয় বাথরুমের কমোডে। ভয়ঙ্কর এই নির্মম ঘটনায় খোদ পুলিশ প্রশাসনেই তোলপাড় শুরু হয়। গত আগস্টে নিজ বাসায় খুন হন চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র দত্ত নামে এক চিকিৎসক। এ ঘটনায় ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়াও এ বছরের মাঝামাঝিতে যাত্রবাড়ী এলাকা থেকে এক যুবকের ৮ টুকরা লাশ ও সূত্রাপুর এলাকা থেকে অপর এক যুবকের মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এসব ঘটনায় পুরান ঢাকায় ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। কয়েকটি ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা গেলেও অধিকাংশ ঘটনার রহস্য ভেদ করতে পারেনি পুলিশ। গুম খুন, ডাকাতি, ছিনতাই ও অপহরণের পাশাপাশি বছরে বিস্তর সময় জুড়ে আলোচিত ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের পর গুম করার ঘটনাগুলো। বছরটিতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৩০জনকে অপহরণের পর গুম করা হয়। গত ১৮ এপ্রিল সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালক আনসারকে রাজধানীর বনানী এলাকার রাস্তা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উঠিয়ে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠে। ঘটনার পর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসর খালেদা জিয়া ও ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর দাবি সরকারের কোনো বাহিনী তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। গত ৪ এপ্রিল গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা এবং বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির সংগঠক আমিনুল ইসলামকে (৪১) আশুলিয়া থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে বলে অভিযোগ উঠে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে নিখোঁজ হন ঢাবির মেধাবী ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা মো. দেলোয়ার হোসেন ভূইয়া। তিনি ঢাবির ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। ভুক্তভোগী পরিবারের আশঙ্কা দেশে চলমান গুমের ধারায় তিনিও গুম হয়েছেন। পরিবারের অভিযোগ ঘটনার দিন লালবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হলেও পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। তিনি এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার দিকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র মোকাদ্দেস ও ওয়ালিউল্লাহ ঢাকার কল্যাণপুর থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ এর একটি বাসে কুষ্টিয়ার যাওয়ার পথে আশুলিয়া থানার নবীনগর বাসস্ট্যান্ড জ্যামে আটকা পড়লে হঠাৎ র্যাবের পোশাক পরিহিত একদল যুবক বাসে ওঠে তাদের ধরে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় যুবকরা বাসের অন্য যাত্রীদের কাছে নিজেদের র্যাব ৪ এর সদস্য বলে পরিচয় দেয়। ঘটনার পর থেকে অন্যদের মতো তারাও নিখোঁজ রয়েছেন। বছরের শুরুতে ‘ডিবি সদস্য’ পরিচয়ে রাজধানীর দয়াগঞ্জ বাজার এলাকা থেকে জুয়েল, রাজীব ও মিজান নামের তিন তরুণকে ‘গ্রেপ্তার’ করা হয়। পরে গাজীপুরের পুবাইলে দু’জনের এবং ঢাকা-মাওয়া সড়কের পাশে অপরজনের লাশ পাওয়া যায়। তাদের হাত-পা গামছা দিয়ে বাঁধা ও শরীরে গুলির চিহ্ন ছিল। বছরের মাঝামাঝিতে হাতিরপুল থেকে ইসমাইল, মাসুম ও সোহেল নামের তিন যুবককে র্যাব পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এর ১০ দিন পর মুন্সীগঞ্জে পাওয়া যায় ইসমাইলের লাশ। ২৬ অক্টোবর ঢাকার ফকিরাপুল থেকে ‘অপহরণ’ করা হয় ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা যুবলীগ নেতা সারোয়ার জাহান বাবুলকে। ১৭ নভেম্বর বিকালে মালিবাগ থেকে ‘অপহরণ’ করা হয় ভোলার বোরহানউদ্দিনের সাত যুবককে। তারা হলেনথ আরিফ, জসিম, জুয়েল, শেখ সাদী, দিদার, মিরাজ ও আকাশ। এরপর জসিমের লাশ আশুলিয়া থেকে উদ্ধার হয়। অপহরণ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মতো থেমে ছিল না অপহরণও। অন্যান্য ঘটনার সঙ্গে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর অপহরণের ঘটনাও বছরের বেশ কিছু সময় আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। গত ১১ নভেম্বর সাড়ে ৭টার দিকে কেরানীগঞ্জের শুভাড্যা পশ্চিমপাড়া কালীবাড়িতে মা-বোন ও গাড়ি চালককে গুলি করে শিশু পরাগকে (৬) তুলে নিয়ে যায় অপহরণকারীরা। বাড়ির সামনেই সন্তানদের নিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য মা লিপি ম-ল গাড়িতে ওঠার সময় এই অপহরণের ঘটনা ঘটে। দুই মোটর সাইকেলযোগে ৪ দুর্বৃত্ত এই ঘটনা ঘটায়। বাংলাবাজার হিড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র পরাগকে অপহরণের সময় তার মা লিপি রানী ম-ল (৩৫), বোন পিনাকী ম-ল (১১) ও তাদের গাড়ি চালক নজরুল ইসলাম (৩৫) গুলিতে আহত হন। এরপর ১৩ তারিখ মঙ্গলবার মধ্যরাতে ঢাকার উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জের নয়াবাজার এলাকার খোলামোড়া আঁটিবাজার পাকা রাস্তার পাশ থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় পরাগ ম-লকে। পরাগ ম-ল অপহরণের ঘটনাটি দেশব্যাপী সমালোচিত হয়ে উঠে। এ ঘটনায় পুলিশ ও র্যাব মোট ১০ জনকে আটক করে। গত ২১ এপ্রিল খিলগাঁও এলাকায় এক ব্যাংক কর্মকর্তার বাসায় ডাকাতি করে তার আট মাসের শিশুকে অপহরণ করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে শিশুটিকে মিরপুর এলাকার একটি বাসার সিঁড়ি থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষার্থীসহ প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে অপহরণ করা হয়। তাদের মধ্যে অনেকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এলেও ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন কেউ কেউ। পুলিশের হাতে নির্যাতন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অস্থির রাখতে শুধু বিভিন্ন দলের ক্যাডার, সন্ত্রাসী, অপহরণকারীরাই নয় আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এর সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে। তাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বিচারক থেকে শুরু করে শিক্ষক, সাংবাদিক আইনজীবী । এসব ঘটনায় কয়েকজনকে প্রত্যাহার করা হলেও কাউকে শাস্তি দেয়া হয়নি। গত ১০ জুন নরসিংদী জেলা যুগ্মদায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের বিচারিক হাকিম মো. ইমান আলী শেখকে নরসিংদী আদালতের প্রবেশমুখে পুলিশ সদস্যরা মারধর করেন। ওইদিন নরসিংদী জেলা আদালতে পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের হত্যা মামলার শুনানি ছিল। নিরাপত্তার জন্য আদালত প্রাঙ্গণে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আদালতের মূল ফটকে পুলিশ সবাইকে তল্লাশি করে ভেতরে ঢোকায়। বিচারিক কাজে অংশ নিতে বিচারক ইমান আলী শেখ আদালতের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে পুলিশ তার ব্যাগ তল্লাশি করতে চায় এবং পরিচয়পত্র দেখাতে বলে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিচারক ইমান আলী শেখের তর্ক হলে পুলিশ তার ওপর চড়াও হয়ে পুলিশের কাছে থাকা হেলমেট দিয়ে তাকে আঘাত করে ও মারধর করে। গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নাতি রাকিবকে রাজধানীর গুলশান থানায় বেদম মারধর করে পুলিশ। রেসিং কার চালানোর অপরাধে তাজউদ্দীনের নাতিকে মারধরের ঘটনায় দেশব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। এ ঘটনায় গুলশান থানার তৎকালীন ওসি শাহ আলমকে প্রত্যাহার করা হয়। গত ২৯ মে আদালত চত্বরে সাংবাদিক পেটানো এবং বিচারপ্রার্থী এক তরুণীসহ তার মা-বাবাকে প্রকাশ্যে নির্যাতন ও শ্লীলতাহানির ঘটনায় কোতোয়ালি জোনের এসি রাজিব আল মাসুদ ও ওসি সালাউদ্দিনসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়। এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ও পুলিশে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু একটি কমিটিও ওসি ও এসির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় সালাউদ্দিনকে মিরপুর থানার ওসি হিসেবে বদলি করা হয়। এদিকে গত ১১ মে সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিক বিভাষ চন্দ্র সাহার মৃত্যু ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন ও গুলিবর্ষণ করা হয়। এ গত ২১ এপ্রিল খুলনায় ছাত্রদলের দুই কর্মীকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে পেটান খুলনা সদর থানার ওসি কামরুজ্জামান। র্যাব-পুলিশের কথিত ক্রসফায়ার র্যাব-পুলিশের কথিত ক্রসফায়ারে প্রায় ২০১২ সালে ৭০ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে র্যাবের সঙ্গে ৪৮ জন, পুলিশের সঙ্গে ৮ জন, র্যাব-পুলিশ যৌথভাবে ৪ জন ও র্যাব-কোস্টগার্ড যৌথভাবে ৬ জন ক্রসফায়ারে নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ৩ জন গণমুক্তি ফৌজের সদস্য, ২ জন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (লাল পতাকা), ৩ জন শ্রমিক, ৪ জন ব্যবসায়ী, ৩ জন যুবক, ১ জন বাসের হেলপার, নাটোরের ১ জন সাজাপ্রাপ্ত আসামি, ১জন ফল বি?েতা, ১জন কৃষক ও ৪১ জন অপরাধী বলে র্যাব-পুলিশ দাবি করে। আশুলিয়ায় আগুনে পুড়ে ১১১ শ্রমিকের মৃত্যু বছরের সবচেয়ে আলোচিত ও ভয়াবহ যে ঘটনাটি পুরো দেশবাসীকে নাড়া দিয়েছে, অশ্রুসিক্ত ও বিক্ষুব্ধ করেছে তা হলো আশুলিয়ায় তাজরিন গার্মেন্টে আগুন লেগে ১১১ শ্রমিকের করুণ মৃত্যুর ঘটনা। গত ২৪ নভেম্বর রাতে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরিন ফ্যাশন গার্মেন্ট এই ভয়াবহ আগুন লাগে। অভিযোগ উঠে আগুন লাগার পরপরই কারখানাটির গেটের বাইরে তালা দেয়ায় এত সংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ওই কারখানার ৩ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের স্মরণীয় এ ঘটনায় দেশব্যাপী শোকের ছায়া নেমে আসে। আশুলিয়ার ঘটনার ৮দিন আগে হাজারীবাগের বৌবাজারের বস্তিতে আরেক ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ১৪ জনের করুণ মৃত্যু হয়।
২০১২ ছিলো রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক কারনে হারানোর বছর। এবছরের শেষ দিন সকল হারানো আর দুঃখ বেদনাকে- শোককে শক্তিতে রুপান্তরিত করে গড়ে উঠতে যাচ্ছে নতুনধারা বাংলাদেশ। যাদের মূল লক্ষ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক সংঘাত আর হানাহানির উর্দ্ধে থেকে সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য নতুন প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধ করা। যাতে করে রাজনৈতিক চেতনার মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করে নির্বাচনের মাধ্যমে মন্দকে-মন্দ রাজনীতিকে ‘না’ বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুনধারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে করা যায় আলোকিত আগামীর জন্য নিবেদিত…
মোমিন মেহেদী : রাজনীতিক ও কলামিস্ট
www.mominmahadi.com