জীব বৈচিত্র্য রক্ষা করা আবশ্যক
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ ২৯ ডিসেম্বর। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় ২৯ ডিসেম্বরকে আর্ন্তজাতিক জৈব বৈচিত্র্য দিবস ঘোষণা করে (সিদ্ধান্ত ৪৯/১১৯)। ১৯৯৪ সালের নাসাউতে অনুষ্ঠিত জৈব-বৈচিত্র্য সংক্রান্ত কনভেনশনের পক্ষদের সম্মেলনের সুপারিশ অনুযায়ী সাধারণ পরিষদ উল্লিখিত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জৈব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং তার টেকসই ও সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির উদ্যোগে ১৯৯২ সালে জীব-বৈচিত্র্য কনভেনশন নামে একটি আর্ন্তজাতিক দলিল চুড়ান্ত করা হয়। কনভেনশনের বিধান অনুযায়ী ৩০টি দেশ কর্তৃক তা অনুমোদিত হওয়ার পর ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরের ২৯ তারিখে তা কার্যকর হয়। বাংলাদেশ উক্ত কনভেনশনের অন্যতম অনুমোদনকারী দেশ।
মানুষের জন্য অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও সেবার উৎস হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন জীবের জীন, প্রজাতি ও পরিবেশ ব্যবস্থা তথা ইকোসিস্টেম সমূহের প্রকারভেদ। পৃথিবীর জৈব-বৈচিত্র্য জেনেটিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক, বিনোদনগত ও সৌন্দর্য্যগত বিভিন্ন দিক থেকে অতি মূল্যবান। প্রাণের ক্রম বিবর্তন এবং পৃথিবীতে জীবের বিকাশ লাভের ক্ষেত্রে জৈব-বৈচিত্র্যের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে জৈব-বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার অতি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ জৈব-বৈচিত্র্যের প্রতি মানুষেরই বিরূপ কর্মকান্ড যেভাবে অবাধে চলছে তাতে আশঙ্কা হচ্ছে যে, ২০২৫ সালের মধ্যে শতকরা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদ পৃথিবী থেকে নিচিহ্ন হয়ে যেতে পারে। তাই জৈব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণে ও টেকসই ব্যবহারে তৎপর হওয়ার আহ্বানই হচ্ছে আর্ন্তজাতিক জৈব-বৈচিত্র্য দিবসের মূল উপাত্ত। কনভেনশন অনুযায়ী জীব বৈচিত্র্যের টেকসই ব্যবহার বলতে বোঝায় এর ব্যবহার এমন নিয়ন্ত্রিতভাবে করতে হবে যাতে দীর্ঘ মেয়াদেও এই সম্পদ সংকুচিত না হয়। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে জৈব-বৈচিত্র্যের ব্যবহার বলতে বংশগতির ধাপ বহনকারী জীন সমেত কোন উদ্ভিদ প্রাণী বা অনুজীবের ব্যবহারকে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন বিশ্ববাসীর। জৈব-বৈচিত্র্যের অর্থনৈতিক গুরুত্ব পর্যালোচনায় দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ৪.৫ শতাংশ আসে বন্য জাতি থেকে। তুরুস্কের একটি বন্য প্রজাতির গমের জীন ব্যবহার করে গমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গম থেকে বছরে অতিরিক্ত ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। ইথিওপিয়ায় যব গাছের একটি জীন দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার ১৬০ ডলার মূল্যের যব ফসলকে হলদে ভাইরাসের আক্রমন থেকে রক্ষা করা হয়েছে। প্রতিবছর পৃথিবীতে বন্য প্রজাতি থেকে আহরিত ওষুধের মূল্য প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। সম্প্রতি আবিস্কৃত মদাগাস্কার দ্বীপের পেরিউইংকল নামের গাছের নির্যাস থেকে তৈরী ওষুধ দিয়ে লিউকোমিয়া নামক ক্যান্সার রোগ বহুলাংশে নিরাময় করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে জৈব বৈচিত্র্য প্রচুর ও তার সম্ভাবনাও অনেক। কিন্তু আজ তা হুমকীর সম্মুখিন। জনসংখ্যার বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রাণীর আবাসস্থল হচ্ছে সংকুচিত। তারা হারিয়েছে তাদের শিকারের ক্ষেত্র। এককালে বাংলাদেশের সর্বত্রই রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা ডোরাকাটা বাঘ দেখা যেত। এখন তাদের কেবল সুন্দরবনেই সীমিত সংখ্যায় দেখা যায়। প্রসঙ্গত, বন্য প্রনী বলতে বাংলাদেশে ১৯৯ জতের স্ত্যপায়ী, ৫৭৮ জাতের পাখি, ১২৪ জাতের সরীসৃপ ও ১৯ জাতের উভচরকে সনাক্ত করা হয়েছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভেশন অব নেচার’ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ২৩টি প্রজাতির বন্য প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকীর সম্মুখিন। এই তালিকায় আছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতা বাঘ, হাতি, অজগর, কুমির, গড়িয়াল ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে ২৭টি বন্য প্রাণীর প্রজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন আর ৩৯টি প্রজাতি হুমকীর সম্মুখিন। গত শতাব্দিতে ১৯টি প্রজাতি বাংলাদেশ থেকে নিচিহ্ন হয়ে গেছে। এর মধ্যে আছে তিন ধরণের গন্ডার, বুনো মোষ, একধরণের কালো হাস, নীল গাই, কয়েক ধরণের হরিণ রাজশকুন, মিঠা পানির কুমির প্রভৃতি। মানুষের সুস্থ্য ভাবে বেঁচে থাকা এবং স্বাভাবিক জীবন যাপনের স্বার্থে জীব বৈচিত্র্য রক্ষা করা আবশ্যক।
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।