স্মরণঃ পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ১১০তম জন্মবার্ষিকী
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ও লোকজীবন জসীমউদ্দীনের কবিতায় নতুন রূপ লাভ করেছে। বাংলাদেশের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা ও জীবন সংগ্রামের কাহিনীই তাঁর কবিতার প্রধান উপজীব্য। জসীমউদ্দীনের কবিতায় দেশের মাটির সাক্ষাৎ উপলদ্ধি ঘটে। এজন্য পল্লীকবি হিসেবে তাঁর বিশেষ এবং স্বতন্ত্র পরিচয় রয়েছে। তাঁর গদ্য রচনাও বিশেষ আকর্ষণীয়, সরস, সরল, গভীর ও আন্তরিকতার স্পর্শে তা যেন মন ছুঁয়ে যায়। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারি ও এ ধরণের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম গ্রহণ করেণ তিনি। পৈতৃক নিবাস একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। তাঁর পিতা আনসার উদ্দিন মোল্লা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। শৈশবে ফরিদপুর হিতৈষী স্কুলে জসীমউদ্দীনের প্রাতিষ্ঠানিত শিক্ষা শুরু হয়। পরে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা (১৯২১), রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই,এ (১৯২৪), বি,এ (১৯২৯) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম,এ (১৯৩১) পাস করেন। তাঁর কর্মজীবন মূলত শুরু হয় পল্লী সাহিত্যের সংগ্রাহক হিসেবে। স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে দীনেশ চন্দ্র সেনের আনুকূল্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক এ কাজে নিযুক্ত হন তিনি। এম,এ পাস করার পর থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দীনেশ চন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু লাহেড়ী’র গবেষণা সহকারী ছিলেন। ১৯৩৮ সালে জসীমউদ্দীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে যোগদান করেন। এখানে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত চাকরি করার পর ১৯৪৪ সাল থেকে তিনি প্রথমে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সককার এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে এখান থেকে ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে অবসর গ্রহণ করে তিনি ঢাকার কমলাপুরে নিজ বাড়িতে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। প্রকৃত অর্থে জসীমউদ্দীনের কবিত্ব শক্তির প্রকাশ ঘটে ছাত্র জীবনেই। তখন থেকেই তিনি তাঁর কবিতায় পল্লী-প্রকৃতি ও পল্লী জীবনের সহজ-সুন্দর রূপটি তুলে ধরেন। পল্লীর মাটি ও মানুষের সাথে তাঁর অস্তিত্ব যেন মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। কলেজ জীবনে ‘কবর’ রচনা করে তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তাঁর এ কবিতাটি প্রবেশিকা বাংলা সংকলনের অর্ন্তভুক্ত হয়। জসীমউদ্দীন সাহিত্যের নানা শাখায় কাজ করেছেন। যেমন; গাথাকাব্য, খন্ডকাব্য, নাটক, স্মৃতিকথা, শিশুসাহিত্য, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। তাঁর প্রধান গ্রন্থ গুলো হলোঃ নক্সী কাঁথার মাঠ (১৯২৯), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩), পদ্মা নদীর দেশে (১৯৬৯), ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৭২), পদ্মাপার (১৯৫০), বেদের মেয়ে (১৯৫১), পল্লীবধু (১৯৫৬), গ্রামের মায়া (১৯৫৯), ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায় (১৯৬১), জার্সানীর শহরের বন্দরে (১৯৭৫), স্মরণের সরণী বাহি (১৯৭৮), বাঙ্গালীর হসির গল্প, ডালিম কুমার ইত্যাদি। তাঁর রচিত বাঙ্গালীর হাসির গল্প (দুই খন্ড; ১৯৬০ ও ১৯৬৪) ও বোবা কাহিনী (১৯৬৮) উপন্যাস দুটি সুখপাঠ্য। জসীমউদ্দীন জারিগান (১৯৬৮) ও মুর্শিদা গান (১৯৭৭) নামে লোক সংগীতের দু’খানি গ্রন্থ সংকলন ও সম্পাদনা করেন। ১৯৬৮ সালে তাঁর সম্পাদনায় কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত হয় জারিগান। জারিগান একান্তভাবেই বাংলাদেশের নিজস্ব সৃষ্টি। গ্রন্থের ভূমিকায় জসীমউদ্দীন জারি গানের উৎস এবং বিভিন্ন এলাকার জারি গানের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন। জসীমউদ্দীনের নক্সী কাঁথার মাঠ কাব্যটি “দি ফিল্ড অব এমব্রয়ডার্ড কুইন্ট” এবং বাঙ্গালীর হাসির গল্পটি “ফোক টেল্স অব ইষ্ট পাকিস্তান” নামে ইংরেজীতে অনূদিত হয়েছে। তাঁর কবিতা অনাড়ম্বর কিন্তু রূপময়। কবি জসীমউদ্দীন বাংলা সাহিত্যের একজন বিশেষ সম্মানিত ও বহু পুরস্কারে পুরস্কৃত কবি। তিনি “প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরমেন্স” পুরস্কার (১৯৫৮), রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক “ডক্টর অব লিটারেচার ডিগ্রি” (১৯৬৯), বাংলাদেশ সরকারের “একুশে পদক” (১৯৭৬) ও “স্বাধীনতা দিবস” পুসস্কারে (মরণোত্তর, ১৯৭৮) ভূষিত হন। জসীমউদ্দীন ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখান করেন। ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর মরদেহ স্বগ্রামে সমাহিত হয়।।
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।