সেলিম আল দীনকে ঝুঝতে হলে এই দেশটাকে ভালোবাসতে হবে…!
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ প্রতিভার স্থায়ীকাল কি সত্যই ক্ষণস্থায়ী? মাঝে মধ্যেই এ কথাটি আমাদের স্মরণে আসে। আর স্মরণে আসে তখনই যখন আমাদের মধ্য থেকে কোনো অনন্য প্রতিভার অকাল প্রয়াণ হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এরই প্রমাণ রেখে গেলেন বর্তমানকালের দুই বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার সেলিম আল দীন। মাত্র চারদিনের অসুস্থতায় ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের নাট্যভূমির, দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের। কোনো প্রিয় মানুষের অকাল প্রয়াণের পরপরই তাকে নিয়ে কোনো নিবন্ধ বা শ্রদ্ধাঞ্জলি লেখা সত্যি দুঃসাধ্য।
আজ ১৪ জানুয়ারী। সেলিম আল দীনের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী। সেলিম আল দীন (১৮ আগস্ট, ১৯৪৯ থেকে ১৪ জানুয়ারি, ২০০৮) একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী নাট্যকার। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি নাটকের আঙ্গিক ও ভাষা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। বাংলা নাটকের শিকড় সন্ধানী এ নাট্যকার ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যের বিষয় ও আঙ্গিক নিজ নাট্যে প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলা নাটকের আপন বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছেন। সেলিম আল দীনের বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। সেই সূত্রে বিভিন্ন জায়গা ঘুরেছেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি ছিল তাঁর চরম ঝোঁক। তাই দূরে কাছে নতুন বই দেখলেই পড়ে ফেলতেন এক নিমেষে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ¡বিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর লেখক হওয়ার বিষয়ে পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি। লেখক হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৮ সালে, কবি আহসান হাবিব সম্পাদিত দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার মাধ্যমে। আমেরিকার কৃষাঙ্গ মানুষদের নিয়ে লেখা তাঁর বাংলা প্রবন্ধ নিগ্রো সাহিত্য ছাপা হয় ওই পত্রিকায়। বিশ¡বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সেলিম আল দীন, যুক্ত হন ঢাকা থিয়েটারে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষে যোগ দেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীতে, কপি রাইটার হিসাবে। ১৯৭৪ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ¡বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। ওই বছরই বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। তাঁদের একমাত্র সন্তান মইনুল হাসানের অকালমৃত্যু হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ¡বিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠা সেলিম আল দীনের হাত ধরেই। ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম আল দীন ১৯৮১-৮২ সালে নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফকে সাথী করে গড়ে তোলেন গ্রাম থিয়েটার। তাঁর প্রথম রেডিও নাটক বিপরীত তমসায় ১৯৬৯ সালে এবং টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় লিব্রিয়াম (পরিবর্তিত নাম ঘুম নেই) প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে। আমিরুল হক চৌধুরী নির্দেশিত এবং বহুবচন প্রযোজিত প্রথম মঞ্চনাটক সর্প বিষয়ক গল্প মঞ্চায়ন করা হয় ১৯৭২ সালে। তিনি শুধু নাটক রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, বাংলা ভাষার একমাত্র নাট্য বিষয়ক কোষগ্রন্থ বাংলা নাট্যকোষ সংগ্রহ, সংকলন, প্রণয়ন ও সম্পাদনা করেছেন। তাঁর রচিত হরগজ নাটকটি সুয়েডীয় ভাষায় অনূদিত হয় এবং এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল হিন্দি ভাষায় মঞ্চায়ন করেছে। সেলিম আল দীনের প্রথমদিককার নাটকের মধ্যে সর্প বিষয়ক গল্প, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, মূল সমস্যা, এগুলোর নাম ঘুরে ফিরে আসে। সেই সঙ্গে প্রাচ্য, র্কীত্তনখোলা, বাসন, আততায়ী, সয়ফুল মূলক বদিউজ্জামান, কেরামত মঙ্গল, হাত হদাই, যৈবতি কন্যার মন, মুনতাসির ফ্যান্টাসি ও চাকা তাকে ব্যতিক্রমধর্মী নাট্যকার হিসেবে পরিচিত করে তোলে। জীবনের শেষ ভাগে নিমজ্জন নামে মহাকাব্যিক এক উপাখ্যান বেরিয়ে আসে সেলিম আল দীনের কলম থেকে। ১৯৮৪ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০০২ সালে পান কথাসাহিত্য পুরস্কার। ১৯৯৪ সালে তিনি নান্দিকার পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাটক রচয়িতার পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি পান শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচনার জন্য জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার । খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার পান ২০০১ সালে। সেলিম আল দীন বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানীয় পুরস্কার একুশে পদক লাভ করেন ২০০৭ সালে। ১৯৯৫ সালে তিনি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে নাটক এর উপর গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন।
সেলিম আল দীনের নাট্যচর্চায় এত বহুমাত্রিক অবদান রয়েছে যে, সামান্য কথায় তা বর্ণনা করা কঠিন। সেলিম আল দীন প্রধানত ছিলেন একজন নাট্যকার। আর দশজন সাধারণ নাট্যকারের সঙ্গে তাকেই মিলিয়ে দেখলে চলে না, আমাদের নাট্যচর্চায় তার আবির্ভাব ছিল আগ্নেয়গিরির মতো। জীবনের প্রথম থেকেই তিনি ছাই ও জঞ্জাল চাপা দেয়া ঔপনিবেশিক নাট্যরীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। সে বিদ্রোহ ছিল অসাধারণ অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে সত্যকে আবিস্কার করার পণ। ঔপনিবেশিকমনস্কতায় বেড়ে ওঠা বুদ্ধিজীবীরা যখন কেবলই পাশ্চাত্য নাট্যরীতিকে একমাত্র অবলম্বন ভেবে এগিয়ে যাওয়ার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই সেলিম আল দীন বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস নিয়ে পথ আগলে দাঁড়ালেন। চিৎকার করে বলে উঠলেন, দাড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে…। বঙ্গভূমির ইতিহাস মানুষ-মাটি, বৃক্ষলতা-নদী সব হয়ে গেল সেলিম আল দীনের নাট্যরচনার হাতিয়ার। প্রথম লড়াই তিনি শুরু করেন একক ও নিঃসঙ্গভাবে যেমন পৃথিবীর আর সব গুণী শিল্পীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। এক অর্থে সেলিম আল দীন ছিলেন বিপ−বী, শিল্প বিপ−বী। একজন রাজনৈতিক বিপ−বী যেমন দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য প্রথমে নিজেই রুখে দাঁড়ান, আত্মস্থ করেন তত্ত্ব তারপর সংগ্রহ করেন সহযোগী, সেলিম আল দীনও তাই করেছেন। সেলিম আল দীনের এ শিলের লড়াইয়ে ধীরে ধীরে যুক্ত হয়েছেন অন্য সহযোগীরা। তার আজীবন বন্ধু শিল্পী কমরেড নাসির উদ্দীন ইউসুফ তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়ে শিল্প স¡প্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সাহায্য করেছেন। তারপর দুজন হয়ে উঠেছেন একে অপরের পরিপূরক। সেলিম আল দীন ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী মানুষ। সমাজ-জীবনের নানা জঞ্জাল থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন, নিমগ্ন থাকতেন তাঁর সৃষ্টির সংগ্রামে। বিশ¡বিদ্যালয় থেকে শুরু করে দীর্ঘ জীবন তিনি এভাবেই এগিয়ে গেছেন। একেকটি নাটক রচনার পেছনে দীর্ঘ অনুশীলন ছিল তাঁর। যে পটভূমিতে তিনি দাঁড়াতেন তাকে আত্মস্থ করতেন, যে চরিত্রগুলো নির্মাণ করতেন তার আদ্যন্ত চিনে নিতেন তিনি। অচেনা চরিত্রকে কখনো চিত্রিত করতেন না তিনি। সেলিম আল দীন বিশ¡াস করতেন নাটকের পাণ্ডুলিপি হতে হবে পাঠযোগ্য এবং তাকে দিতে হবে যথার্থ সাহিত্য মূল্য। নাটকের গতানুগতিক গদ্যভিত্তিক সংলাপকে বর্ণনা করে তিনি নিয়েছিলেন কাব্যময়তার আশ্রয়। তাই তাঁর সংলাপে ছিল সৃজনশীল কাব্যময়তা, সেসঙ্গে অসাধারণ উপমা। সেলিম আল দীনের সৃষ্টিশীল রচনা নাসির উদ্দীনের হাতের স্পর্শে হয়ে উঠেছে মহাকাব্যিক প্রযোজনা। ঢাকা থিয়েটারের উদ্যমী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাকে করে তুলেছেন গতিময়। এ এক মহাযজ্ঞ। র্কীত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাতহদাই, চাকা, বনপাংশুল থেকে নিমজ্জন প্রতিটি প্রযোজনা একেকটি শিল্পভুবন। সেলিম আল দীন প্রধানত ছিলেন একজন রাজনৈতিক মানুষ। তাঁর রচনায় সাধারণত প্রথাগত রাজনৈতিক উদাহরণ খুব উচ্ছ্বসিত থাকত না; কিন্তু নাটকজুড়ে নানা শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হতো রাজনৈতিক চেতনা। রাষ্ট্রের শৃঙ্খলবিরোধী এ মহান মানুষটি আগাগোড়া ছিলেন মার্কসবাদে বিশ্বাসী। সেসঙ্গে সেলিম আল দীন ধর্মীয় কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ছিলেন সদা সোচ্চার। তাঁর নাটকে ধর্মের তথাকথিত নিয়মরীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল শৈলিক ও নান্দনিক। একজন নাট্যপুরুষ তাঁর নিজের জীবনের সৃজনশীলতা, অধ্যবসায় ও বাস্তব জ্ঞান সংগ্রহের মধ্য দিয়ে ক্রমেই হয়ে উঠেছিলেন এক দার্শনিক। তাঁর শিল্পদর্শন ক্রমেই যখন বাঙালি সংস্কৃতির শিকড় স্পর্শ করছিল, তখনই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। সেলিম আল দীন যেসব নাটক লিখছিলেন তা কেবলই নাটক ছিল না, নাটককে ছাড়িয়ে যেন হয়ে উঠছিল আরো বেশি কিছু। ক্রমেই এভাবে তিনি নিজেকে শিল্প শিখরে উত্তীর্ণ করছিলেন। কর্মমুখী, আজীবন শিল্পসাধনায় নিমজ্জিত সেলিম আল দীনের প্রতি রইলো আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি…!
**সেলিম আল দীনের উল্লেখ যোগ্য নাটকসমূহঃ
মুন্তাসীর ফ্যান্টাসি (১৯৭৬), র্কীত্তনখোলা (১৯৮০), কেরামত মঙ্গল (১৯৮৪), চাকা (১৯৯০), যৈবতি কন্যার মন (১৯৯১), শকুন্তলা, হাত হদাই, বণপাংশূল, ধাবমান, পূত্র, নিমজ্জন, প্রাচ্য, প্রভৃতি।
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।।
jsb.shuvo@gmail.com