শিল্প কারখানাগুলোর সংস্কারে প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালু কণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল’_ কবিতার লাইনগুলো থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, কোনো ছোট জিনিসকে অকারণে অবহেলা করা উচিত নয়। বিশাল একটি জাহাজ, বৃহৎ শিল্প কারখানা কিংবা বৃহদাকার কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হলে ছোটবড় নানা প্রকার জিনিসের প্রয়োজন হয়। বিশাল জুট মিলের, বিশাল সার কারখানার কিংবা বিশাল জাহাজ নির্মাণের কাজে অতি ক্ষুদ্র নাট-বল্টুরও প্রয়োজন আছে। অতি ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশও জরুরি। ক্ষুদ্র একটি যন্ত্রাংশ ভেঙে গেলে কিংবা নষ্ট হয়ে গেলে বিশাল কারখানা অচল হয়ে পড়ে, উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। খুচরা যন্ত্রাংশ প্রতিটি ছোট-বড় কল-কারখানা কিংবা যানবাহনের চালিকা শক্তিকে অব্যাহত রাখতে সহায়তা প্রদান করে থাকে। আমাদের দেশের বড় বড় শিল্প কারখানাগুলোর অধিকাংশই অচল হয়ে আছে কিংবা বন্ধ হয়ে আছে প্রয়োজনীয় সংস্কার, সংরক্ষণ ও মেরামতের অভাবে। অথচ যথাসময়ে প্রয়োজনীয় মেরামত ও সংস্কার কাজ সম্পাদন করতে পারলে এগুলোর বর্তমান দৈন্যদশা দেখা দিত না। ছোট ছোট ওয়ার্কশপের গুরুত্ব অনেক। এটা শুধু খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি আর সরবরাহ করে এ পর্যন্ত এর গুরুত্ব সীমাবদ্ধ নয়। এসব শিল্পের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষদের কর্মসংস্থান হয়। একই সঙ্গে তাদের তৈরি খুচরা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করার কারণে অন্তত যেটুকু পরিমাণ তারা প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়, ততটুকু বিদেশ থেকে আমদানি না করার ফলে বৈদেশিক মুদ্রায় সাশ্রয় হচ্ছে। তবে এসব ওয়ার্কশপ নানা সমস্যায় জর্জরিত। এদের প্রধান সমস্যা মূলধনের অভাব। মূলধনের অভাবে ওয়ার্কশপগুলোর মালিকরা বেশি শ্রমিক নিয়োগ করে একটু বড়সড় আকারে উৎপাদন কাজ করতে পারছে না। এ কারণে অধিকাংশ ওয়ার্কশপের মূল কাজটা মালিক করছে আর বেকারত্বের কবলে পতিত কিশোর বয়সী ওয়ার্কশপ শ্রমিকদের বেতনও সামান্য।
সামান্য বেতনেই অনেককে বেশি কাজ করতে হয়। মূলধনের সমস্যা ছাড়াও আরো কিছু সমস্যা এসব ওয়ার্কশপের অনগ্রসরতার পেছনে কাজ করছে। সেগুলো হচ্ছে দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধি, অব্যাহত লোডশেডিং, বৈষম্যমূলক আমদানি ও শিল্পনীতি, বিসিকের উদাসীনতা, বিসিক থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা, কারিগরি জ্ঞানের অভাব, পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ বড় বড় নগরীতে বিভিন্ন এলাকাজুড়ে খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির ওয়ার্কশপ রয়েছে। রাজধানী ঢাকার পুরনো এলাকায় খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানায় ভরপুর। এসব ওয়ার্কশপে বিদেশি বিভিন্ন মডেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের এত নিখুঁত নির্মাণ হয় যে, অনেক সময় কোনটা দেশি কোনটা বিদেশি বোঝাটা কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের তৈরি মালামালের গুণগতমান সম্পর্কে আমাদের ধারণা যদিও স্পষ্ট নয়, তবে যারা বিদেশি যন্ত্রপাতির অবিকল নকল করতে পারে তাদের পক্ষে উন্নতমানের যন্ত্রাংশ তৈরি অসম্ভব নয় এটাও মনে করা যেতে পারে। দেশের শিল্পায়ন খাতে তাদের ভূমিকা একেবারে গৌণ হিসেবে বিবেচনা করা মোটেও উচিত হবে না। আমরা যাদের নকলকারী হিসেবে ধরে নিয়েছি তাদের প্রকৃত প্রস্তুতকারী হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে তাদের কাছ থেকে আরো ভালো মানের জিনিস আশা করতে পারি। নকল করতে তাদের যে মেধাটা কাজে লাগানো হচ্ছে সে মেধাটাকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তির অংশীদার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আমরা তাদের অবিকল নকল করার ব্যাপারটাই শুধু দেখছি; কিন্তু তাদের মধ্যে নিহিত যে সূক্ষ্ম জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত মেধা রয়েছে সেদিকটার দিকে মোটেও খেয়াল করছি না। এদেশে প্রচুর মেধাশক্তিসম্পন্ন মেকানিক রয়েছে যাদের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছুই পেতে পারতাম। কিন্তু সুযোগের অভাবে তাদের সেই প্রযুক্তিগত মেধা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তাদের পুঁথিগত জ্ঞান নেই। চোখে দেখেই যে কোনো যন্ত্রপাতি কিংবা যন্ত্রপাতির খুচরাংশ তৈরির যে গুণ তাদের রয়েছে সেটার মূল্যায়ন করা উচিত। তাদেরকে যদি কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে ও কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া যেত তাহলে তারা দেশের শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারতো। এতে যে কোনো শিল্পকারখানার খুচরা যন্ত্রপাতি প্রয়োজন পড়লেই বিদেশ থেকে আমদানি করার দরকার পড়ত না। তাদেরকে ব্যাংক থেকে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদান করলে, বিদ্যুৎ বিভ্রাট থেকে রেহাই দিতে পারলে দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প ব্যাপক প্রসার লাভ করতে পারে। এ ব্যাপারে বিসিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সুষ্ঠুভাবে জরিপের মাধ্যমে দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ওয়ার্কশপগুলোর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করে তাদেরকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করতে পারলে তারা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে এবং এ শিল্প খাতটিও দিনে দিনে বিস্তার লাভ করবে যা দেশের জন্য মঙ্গলই বয়ে আনবে।
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।