৫ লক্ষাধিক বেসরকারী শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ অনিশ্চিত!
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবীতে শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের আন্দোলন কর্মসূচি ১৭ ফ্রেবুয়ারী পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। এরপর বিভিন্ন কর্মসূচি শেষে ৩১ মার্চ ঢাকায় সমাবেশ ১ এপ্রিল ঢাকায় হরতাল দেয়ার কথা। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্র থেকে শিক্ষকদের প্রাপ্তির একটি ইতিহাস রয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান শিক্ষকদের প্রথম বেতন স্কেল দেয়া শুরু করেন। তখন মূল বেতনের ৫০ শতাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দেয়া হতো। এর আগে বেসরকারী শিক্ষকদের সরকার কোন বেতন দিত না। এরশাদ সরকার শিক্ষকদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ও মেডিকেল ভাতা চালু করেন এবং বেতনের সরকারী অংশ বাড়িয়ে ৭০ শতাংশে উন্নীত করেন। তার সময়েই সরকার এসএসসি পরীক্ষা অন্য কর্মকর্তাকর্মচারীদের দ্বারা পরিচালনা করিয়েছিলেন শিক্ষকদের ধর্মঘটের কারণে। তবে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের মতো আন্দোলনরত শিক্ষকদের পুলিশ দিয়ে বেদম প্রহার করেন নি। খালেদা জিয়ার ( ১৯৯১-৯৬) সালে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ৮০শতাংশ করেন। ( ১৯৯৬-২০০১ সালে)। শেখ হাসিনার সরকার ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করেন। এ ছাড়া নারী শিক্ষকদের মাতৃকালীন ছুটি ৬ মাস, নতুন ১ হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্ত করা হয়। আন্দোলনরত শিক্ষকদের বলা হচ্ছে তারা রাজনীতি করছে কিন্তু একথা কেউ বলছেননা যে, বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগন এ পর্যন্ত যতটুকু পেয়েছেন তা আন্দোলন ছাড়া পাননি। ১৯৮০ সালের পূর্বে শিক্ষকগণ সরকারী বেতনভাতা পেতেন না। একটি দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন বিষয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ বিমানের মতো অনেক রাষ্টায়ত্ত প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা লেকাসান গুনছে। আর শিক্ষার জন্য টাকা নেই একথা বলার অধিকার কি রাষ্ট্রের রয়েছে? দেশে এমপিও ভুক্ত ও স্বীকৃতপ্রাপ্ত মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার সংখ্যা ৩৫ হাজার ৩৯৬টি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, এসব প্রতিষ্ঠানের পাঁচ লক্ষাধিক বেসরকারী শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করন করা হলে বছরে প্রয়োজন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এখন বেতনভাতা যাবৎ খরচ হচ্ছে ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। তাদের মতে খরচ এর দ্বিগুন হলেও ১০ হাজার কোটি টাকা হলে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করন করা সম্ভব। দেশে অনেক বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোর আয় অনেক। এগুলোর সমন্বয় সাধন করতে পারলে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা খুব একটা দুরূহ বিষয় নয়। এই মুহুর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য মোট বাজেট ১১ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। সরকার বলছে শিক্ষকদের কিছু করতে হবেনা, সরকারই তাদের জন্য যা করার করবে। কিন্তু শিক্ষকদের আন্দোলনের ইতিহাস তাই বলছে না। দেশের সব সেক্টরে, উচ্চ শিক্ষায় মাধ্যমিক পর্যায় থেকে ছাত্র-ছাত্রী আসে, অথচ এই খাত পুরোপুরি অবহেলিত ছিল, শিক্ষকগণ আন্দোলন করে করেই এ পর্যন্ত এসেছেন। জানা গেছে, ২০১৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ৮২ হাজারেরও বেশী পরীক্ষার্থী ঝড়ে পড়েছে। ২০১০ সালে এই শিক্ষাার্থীরা অষ্টম শ্রেণীতে প্রথমবারের মতো জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১১ সালে নবম শ্রেণীতে নিবন্ধন করেছিলো। কিন্তু দুই বছর পর এসএসসি পরীক্ষায় তারা অংশ নিচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন ২০১০ সালে দেশে প্রথম বারের মতো জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা চালু হয়। ঝড়ে পড়া কমানোর অন্যতম লক্ষ্য নিয়ে নতুন এই পরীক্ষা চালু করা হয়েছিলো। শিক্ষা বোর্ডেগুলোর খসড়া পরিসংখ্যান বলা হয়েছে গত বছর এসএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা যেখানে ১৪ লাখ ২০ হাজর ৫৭ জন ছিল, এ বছর পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ কমে গেছে। এটি কোনভাবেই কাম্য নয়। এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ঝড়ে পড়া জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। সর্বত্রই রাজনীতি আর রাজনীতি, জাতির ভবিষ্যৎ বা শিক্ষার মান নিয়ে ভেবে দেখার সময় হয়তো সেভাবে কেউ পাচ্ছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়া ও শিক্ষক নিয়োগে গুরুত্ব পাচেছ রাজনৈতিক বিবেচনা বা অর্থ। রাজনীতির সঙ্গে শিক্ষার এই সম্পর্ক শিক্ষা বাজেটে চাপড় সৃষ্টি, অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষার মানে অবনতি ছাড়াও বহুমুখী সংকট তৈরি হয়েছে। মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসছেনা, আসলেও টিকে থাকছেনা। মফস্বলে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক সংকট কাটছে না, কাটানোর কার্যকরী পদক্ষেপও নেই। ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শেখ মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ”অন্য বছরের তুলনায় এবার (২০১৩) এসএসসি পরীক্ষার্র্র্থীর সংখ্যা কিছুটা কমবে। কারণ যারা জেএসসি পরীক্ষায় পাশ করেছে তারাই এবার এসএসসিতে অংশ নেয়ার জন্য নিবন্ধন করেছে। নিবন্ধন করেও যারা পরীক্ষায় অংশ নেয়নি, তাদের বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খোাঁজ নিয়ে ফের স্কুলে ফিরিয়ে আনা হবে।” মাদ্রাসা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ নাজমুল হুদা বলেন, ” পরীক্ষার্থী কমেছে একথা সত্য তবে যারা চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে, তাদের ভিত্তি মজবুত হয়েছে। কারণ তার দুই বছর আগে পাবলিক পরীক্ষায় পাশ করেছে।”
আসলেই কি তাই? পরীক্ষার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট, যারা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন, খাতা পরীক্ষণ করেন এবং শিক্ষা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেন, তারা জানেন শিক্ষার মানের কি অবস্থা? তারপরেও সরকারকে ধন্যবাদ অষ্টম শ্রেণীতে একটি পাবলিক পরীক্ষা চালু করার জন্য। কিন্তু তাই বলে এবার দুই লাখ শিক্ষার্থীর ঝড়ে পড়া কোনভাবেই মেনে নেয়া যায়না। জাতি হিসেবে এটি আমাদের আর একটি ব্যর্থতা।
অপরদিকে, কমিউনিটির হাতে শিক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া একটি আদর্শিক এবং পুস্তকের কথা। কমিউনিটির হাতে যখন শিক্ষার দায়িত্ব থাকে আমাদের মতো দেশে, সেখানে শিক্ষার বারোটাতো বাজবেই। কারণ শিক্ষক নিয়োগে রাজনীতি, পরীক্ষায় রাজনীতি, ভর্তি পরীক্ষায় রাজনীতি। প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষদের স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের মন জয় করা এবং খুশী রাখা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। শিক্ষা কিংবা বিদ্যালয়ের উন্নয়নে প্রধান শিক্ষকদের সময় দেয়ার মতো সময় কমই থাকে। ম্যানেজিং কমিটিতে ব্যতিক্রম ছাড়া বিদ্যেৎসাহী, সৎ ও নিবেদিতপ্রান সাধারনত থাকেনা। তারা রাজনীতি, ভিলেজ পলিটিক্্র এবং ক্ষমতাতন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই বেশী পছন্দ করেন। কাজেই শিক্ষার দায়িত্ব থাকতে হবে রাষ্ট্রের হাতে যেকানে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির ইচছায় স্কুল কিংবা কলেজকে চলতে না হয়। আবার এটিও সত্য যে বর্তমানে সরকারী স্কুলগুলো দেশে প্রতিষ্ঠিত কিছু বেসরকারী বিদ্যালয়ের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছে না শিক্ষাদানের মান ও পাবলিক পরীক্ষায় ফলাফলের দিক দিয়ে। হাতেগোনা কিছু বেসরকারী বিদ্যালয় ছাড়া হাজার হাজার বেসরকারী বিদ্যলয়ে শিক্ষক নিয়োগে সরকারী নীতিমালা সেভাবে মানা হয়নি বিধায় অনেক শিক্ষক-ই আছেন যাদের পক্ষে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাদান করা সম্ভব নয় তারাও শিক্ষকতায় ঢুকে পড়েছেন। কাজেই ঢালওভাবে তাদের চাকরী জাতীয়করণ করা হলে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাদানের মান না বাড়ার সম্ভাবনাই বেশী। সেক্ষেত্রে সরকারের বিপাকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং প্রস্তাবনা থাকতে হবে তা না হলে গরীব জনগনের টাকায় শুধুমাত্র জাতীয়করণই করা হবে, শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যাবেনা।
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।