প্রতিটি দিন হোক বাংলা ভাষার জন্য
মোমিন মেহেদীঃ ভাষার জন্য ভালোবাসা সবসময় আমাদের মধ্যে এসেছে ছন্দিত সময়ের হাত ধরে। এই সময়টা বাহান্ন সালে এসেছিলো সাহসের হাত ধরে। সাহসের রাত দিন আমাদেরকে করে তুলেছিলো প্রচন্ড সাহসী। বিশেষ করে ভাষা সৈনিকগণ হয়ে উঠেছিলেন দূরন্ত-প্রত্যয়ী এবং এগিয়ে যাওয়ার যোদ্ধা। যে কারনে মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য, কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন প্রতিটি প্রত্যয়ী বাঙালি। সেই সাহসের সাথে সাথে তৈরি হওয়া নিরন্তর মানুষ সালাম-রফিক-জব্বার আর শফিউর রাত থেকে করেছিলেন নতুন আলোর সন্ধান। এই সন্ধানের সূত্র ধরে বাংলা ভাষার লড়াই হয়েছিলো। সেই লড়াইয়ে আমরা আমাদের জীব কেও উৎসর্গ করতে তৈরি ছিলাম। এই তৈরি থাকার কারনে নির্মিত হয়েছিলো একটি ভাষার ইতিহাস। আমরা একটু গভীরভাবে বাংলা ভাষার ইতিহাসকে দেখলে চলে আসবে ব্যাপক আলোচনা। ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য রক্তদান পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মায়ের ভাষা বাংলাকে রক্ষা করার জন্য ১৯৪৮ সালে এ দেশের ছাত্র সমাজ মহান ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে। ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে ছাত্রদের জীবনদানের মধ্য দিয়ে এ দেশের ছাত্র সমাজের গৌরবময় রক্তাক্ত ইতিহাস সৃষ্টি হয়। ‘৫২-এর ছাত্র আন্দোলন এদেশের বাঙালী জাতির মুক্তি সংগ্রামের আকাঙ্খাকে জাগ্রত করে। একুশে ফেব্রুয়ারী আসলেই আলোচনা সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পনসহ নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে দিবসটি পালিত হয়। কিন্তু বাংলা ভাষা শহীদদের চেতনা-সংগ্রাম-স্বপ্ন-ল্ক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। আমরা সকলেই জানি, একুশে ফেব্রুয়ারী মহান শহীদ দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় দেশব্যাপী পালনের খবর পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হবে। অথচ একুশে ফেব্রুয়ারী তথা বাংলা ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদ দিবসের ৫৭ বছর পূর্ণ হলেও ইংরেজীসহ ভিন্ন ভাষায় রচিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌলিক গ্রন্থসমূহ বাংলায় অনুবাদ ও প্রকাশের ব্যবস্থা করার দাবী অদ্যাবধি উপেক্ষিত। ভাষা আন্দোলন তো বটেই, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ১১ দফা, ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৮২-’৯০ সময়কালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ছাত্র সমাজের রক্তস্নাত ১০ দফা ও ‘৯০-এ মহান গণঅভ্যুত্থানসহ এ পর্যন্ত সকল গণ-আন্দোলনে প্রায় সকল বাম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল ও শক্তি যে দাবীটি জানিয়ে আসছে, যা এখনো জনগণের প থেকে উত্থাপিত হচ্ছে তা হলো, শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হতে হবে মাতৃভাষা বাংলা এবং ইংরেজীসহ ভিন্ন ভাষায় রচিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌলিক গ্রন্থসমূহ জরুরী ভিত্তিতে বাংলায় অনুবাদ ও প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমান ১৪ দলীয় মহাজোট সরকারের কাছে জনগণের পক্ষ থেকে আমরা উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য।
৫৭ বছর আগে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনের সূচনা, বুকের রক্ত ঢেলে জাতিকে রুখে দাঁড়াবার সাহসে উজ্জীবিত করেছিল যারা, সেই ভাষা শহীদদের স্মরণে জাতীয় শোক দিবস পালিত হবে। ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার মধ্যে সীমিত থাকেনি, ভাষাভিত্তিক চেতনায় জাতি ক্রমে ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শোষণ-শাসনের শিকল ছিঁড়ে মুক্তিকামী মানুষ একুশের চেতনার পথ ধরেই একাত্তরে রক্তাক্ত মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছে মহান স্বাধীনতা। গৌরবোজ্জ্বল এই দিবসের অনন্যতা বিষয়ে জাতির গর্ব আরো বেড়ে গেছে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়ার পর। বাঙালির ও বাংলাদেশের একুশ এখন সারা বিশ্বে প্রধান ও অপ্রধান মিলিয়ে প্রায় ৬ হাজার ভাষার মানুষের জন্য মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপনের দিন। একুশ এখন সারা বিশ্বে ভাষা ও অধিকারজনিত সংগ্রাম ও মর্যাদার প্রতীক। একুশ আমাদের সংগ্রাম ও জাতীয় মর্যাদাকে বিশ্বদরবারে সমুন্নত করেছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিবছর জাতীয়ভাবে একুশে উদযাপন করা হলেও সরকার একুশের শিক্ষা ও চেতনাকে জাতির জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগই নিতে পারে নি। একুশের শিক্ষা ও চেতনাকে জাতির জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার হাতিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন তথা বিজ্ঞানভিত্তিক ও গণমুখীকরণ কেন করতে পারে নি? একুশের চেতনা ও শহীদদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন ও জনগণের প্রয়োজনে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের জন্য এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়াটাও জরুরি হয়ে ওঠেছে। সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর আমলা মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া লুটেরা ধনিক বণিক শ্রেণীর বিগত ৩৮ বছরের শাসন ও রাজত্বে নানা সমস্যা ও সঙ্কটে বিদীর্ণ হলেও বর্তমান ১৪ দলীয় মহাজোট সরকারের আমলেও তো আজকের জাতীয় জীবনে একুশের অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ ও প্রেরণা খুঁজে পাওয়াটাই একটা বড় সমস্যা। স্বাধীনতার পর থেকে সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর আমলা মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া শাসক শ্রেণী সকল নির্মাণ ও উন্নয়ন প্রয়াসে একুশের চেতনাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদা দেয়ার চেষ্টাই তো হয় নি, অতএব ব্যর্থতার দিকটি বলার উপায় নেই। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একুশের চেতনাবিরোধী কার্যক্রমের অসংখ্য নজির স্থাপিত হয়েছে প্রতিটি সরকারের আমলে। এই চেষ্টাহীনতা, ব্যর্থতা ও মর্যাদাহানির বিষয়টি আরো নগ্নভাবে ধরা পড়তে শুরু করেছে রাষ্ট্রীয়ভাবে একুশে পদক বিতরণের কর্মসূচির মধ্যেও। একুশের চেতনা, সংগ্রাম ও প্রেরণাকে জাতির মধ্যে সঞ্জীবিত রাখার লক্ষ্যে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য জাতির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিশীল সন্তানদের একুশে পদক দিয়ে জাতীয় সম্মাননা জ্ঞাপন নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু কাদের দেয়া হচ্ছে এই পদক? যারা এ পদক পাচ্ছেন, তাদের সকলেরই ব্যক্তিগত অবদান কি একুশের আন্দোলন ও চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত? এই আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ও একুশের সংগ্রাম ও চেতনা ধারণ করেন এমন রাজনীতি সচেতন শ্রমিক শ্রেণীর মতাদর্শ তথা সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী অনেকেই এ পদক পাননি। অথচ কোনোভাবেই সম্পৃক্ত ছিলেন না এবং ভাষা ও গণসংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নয়নে অবদান নেই- এমন লোকজনও এ পদক পাচ্ছেন। একুশের মহান সংগ্রাম ও চেতনা ছাপিয়ে সরকারের মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া শ্রেণীর সংকীর্ণ রাজনৈতিক পরিচয় ও পক্ষপাতই প্রধান হয়ে উঠছে কেন মনোনয়নের ক্ষেত্রে? এ যাবত যাদের একুশে পদকে সম্মানিত করা হয়েছে, সেই তালিকা সচেতন মানুষের মনে এ প্রশ্ন না জাগিয়ে পারে না। জাতিকে নানাভাবে এগিয়ে নেয়ার সাধনায় সংগ্রামী, ত্যাগী ও গুণী মানুষ দেশে অবশ্যই রয়েছেন। কিন্তু সরকার তাদেরকে যথাযথ সম্মান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। সমাজজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো মহান একুশের নামে প্রবর্তিত একুশে পদকের ক্ষেত্রেও তদবির পার্টির দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপনে আরো দু’টি ব্যর্থতা আমাদেরকে লজ্জিত করে। সংগ্রামী ঐতিহ্যের ধারক ঐতিহাসিক একুশের ডকুমেন্টস সরকার বহির্বিশ্বে প্রচার করতে পারে নি এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার কাজও থমকে আছে। আমাদের দেশের জনগণের সকল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস ও অর্জনকে সংরক্ষণ এবং আমাদের দেশের জনগণের সংগ্রাম, জাতীয় ঐতিহ্য ও গৌরবকে অক্ষুন্ন রাখার শপথে একুশের প্রেরণায় উজ্জীবিত জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে আবারও সকল ধরণের দেশী-বিদেশী শোষণ-বঞ্চনা-অনুন্নয়ন-লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করুক- এই প্রত্যাশা করি। মহান একুশে ফেব্রুয়ারী ও ভাষা শহীদদের সংগ্রাম-স্বপ্ন-ল্ক্ষ্য-স্মৃতি অমর হোক। শুধু এখানেই শেষ নয় ভাষার জন্য ভালোবাসা নিবেদন করে আসা ভাষা মতিন, রওশন আরা বাচ্চুসহ সকল ভাষা সৈনিকদের আলোকিত ভালোকিত সময় আমরা প্রত্যাশা করি। যেখানে তারা ভালো থাকবেন, ভালো থাকবেন নিবেদিত আগামীর জন্য। যেই আগামীতে শুধু একটি দিন প্রতিটি দিন থাকবে বাংলা ভাষার জন্য নিবেদিত প্রাণ। সেই নিবেদিত তরুণ প্রজন্মের একজন হতে চাই আমি। যে কারনে বৃহ্নলা ভাষা বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।
আজ শাহবাগে যে, আন্দোলন শুরু করেছি আমরা-ব্লগাররা-সচেতন তরুণরা; তারা প্রত্যাশা করি সরকার বাংলা ভাষার সঠিক সংরক্ষণ করবেন, সঠিক দেখভাল করবেন ভাষা সৈনিকদেরকেও। দেশের বরেণ্য চলচ্চিত্রকার শহীদুল হক খান যেভাবে বাংলা ভাষার জন্য ভালোবাসা নিবেদন করেছেন, ঠিক সেভাবেই নয়; আরো এগিয়ে তাঁর উৎসাহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এগিয়ে যাবো অনন্তকাল। পরিশেষে একটি কথা দিয়ে, একটি কবিতা দিয়ে ইতি টানছি। আর সেই কথাটি হলো-উত্তরণ প্রয়োজন এই বর্তমান থেকে, যেই বর্তমানে একুশে ফেব্রুয়ারী তথা বাংলা ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদ দিবসের ৬০ বছর হলেও ইংরেজীসহ ভিন্ন ভাষায় রচিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌলিক গ্রন্থসমূহ বাংলায় অনুবাদ ও প্রকাশের ব্যবস্থা করার দাবী অদ্যাবধি উপেক্ষিত।
জীবনের জন্য নিবেদিত আজ যোদ্ধাদেরকে ডাকে/ আবার বিজয় আনতে হবে বাংলা তোমায় ডাকে/ বিজয় আনো নতুন করে বাংলা ভাষায়- দেশে/ তবেই দেখো আম জনতা তৈরি ভালোবেসে…
মোমিন মেহেদী : কলামিস্ট ও আহবায়ক, নতুনধারা বাংলাদেশ(এনডিবি)