নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সকল বাঁধাকে অতিক্রম করতে হবে
____________________________________________________________________________
১৯০০ শতাব্দি নারী জাগরণের কাল: উনবিংশ শতাব্দির প্রারম্ভে জনসংখ্যা ও শিল্প বিকাশের সাথে সাথে বিশ্বে বেশ কিছু র্যাডিকাল আইডলোজির উদ্ভব ঘটে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ভাবনার কাল সেইটি!
১৯০৮: ১৯০৮সাল, এই সময়টি ছিলো একই সাথে নারীর জন্য উদ্বেগ ও জাগরণের। নারীর অবস্হানগত দিক নিয়ে নারীসমাজ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ এবং পাশাপাশি সে বিষয়ে সচেতন নারী সমাজ গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক ও আলোচনা কর্মসূচি আহবান করে। ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে ১৫০০০ নারী মিছিল সমাবেশের মাধ্যমে তাদের বেতন, কাজের সময়সীমা এবং ভোটের অধিকার নিয়ে রাজপথে নামেন।
১৯০৯: ১৯০৯ সালে আমেরিকায় একটি ‘সোশালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা’র উন্মেষের সাথে সাথে ২৮ শে ফেব্রুয়ারি আমেরিকাতে একটি ‘জাতীয় নারীদিবস’ পালন শুরু হয়।
১৯১০: এ সময়ে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে দ্বিতিয় আন্তর্জাতিক কর্মজীবি নারী সম্মেলন বা ‘ইন্টারন্যাশনাল কন্ফারেন্স অব ওয়ার্কিং ওমেন’ সম্পাদিত হয়। নামে জার্মানির সোশাল ডেমোক্রাটিক দলের এই নেতা সর্বপ্রথম একটি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পরিকল্পনা জনসমক্ষে তুলে ধরেন। তিনি প্রস্তাব করেন বিশ্বের প্রত্যেক দেশের জন্য প্রতিবছর পালনের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন থাকা বান্ছনীয়। তারা সেই সাথে এই দিনটিতে নারীর দাবীর কথা তুলে ধরার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বিশ্বের ১৭ টি দেশ থেকে আগত শতাধিক নারী এ সম্মেলনে অংশ গ্রহন করেন। তাদের ভেতর ট্রেড ইউনিয়ন, সোশাল ডেমোক্রাটিক পার্টি, কর্মজীবি মহিলা সমিতি এবং দুইজন নির্বচিত ফিনিস পার্লামেন্ট মেম্বার কোপেনহেগের এই সম্মেলনে যোগদান করেন। আর তারই ফল স্বরূপ একটি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের উন্মেষ ঘটে।
১৯১১: ১৯১১ সালের ১৯ শে মার্চ্চ ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে প্রথম আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালিত হয়।
এক মিলিয়ন নারী ও পুরুষের অংশগ্রহনের মাধ্যমে তারা নারীর কর্মের অধিকার, ভোটের অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন ও বৈষম্য দূরীকরনের দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। কিন্তু এই সফল র্যালির এক সপ্তাহের ভেতর নিউইয়র্কে ঘটে আরেক যুগান্তকারী ট্রাজেডি।১৯১১ সালের ২৫ শে মার্চ Triangle Fire ১৫০ জন মহিলার জীবন কেড়ে নেয়। এরা বেশির ভাগই ইটালিয়ান ইহুদি কর্মজীবি নারী। এই অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা নারীর ভাগ্য উন্নয়নে তড়িৎ গতি দিতে সক্ষম হয়। সকল সচেতন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করে এই সীমাহীন ট্রাজেডি!
এই অসম্ভব দুঃখজনক ঘটনাটি আমেরিকার সুশীল সমাজের টনক নড়তে ব্যাপক ভুমিকা রাখে, তারা সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে নারী বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে অনেকটাই বাধ্য করেন। এর পরই নারীর অবস্হাগত উন্নয়ন, কর্মনীতি ও আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
১৯১৩-১৯১৪: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এই প্রাক্কালে শান্তির জন্য সকল আন্দোলনে রুশ নারী এক বিরল ভুমিকা রাখে। যা পরবর্তিতে আন্তর্জাতিক নারীদিবসের এই প্রাতিষ্ঠানিক রূপটিকে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারীর শেষ রবিবার ওরা দিনটি আন্তর্জাতিক নারীদিবস হিসেবে পালন করে।
১৯১৩ সালে সম্মিলিতভাবে ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারীদিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। ১৯১৪ সালও নারীর ভুমিকায় নারী অত্যন্ত শক্তিশালী ভুমিকা রাখে। ইউরোপের নারীরা ১৯১৪ সালে শান্তির পক্ষে এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন জনমত গড়ে তুলে নারীর উপর ন্যায়বিচার ও সৌহার্দ্যের বিষয়টি বিশ্বের সামনে তুলে ধরে।
১৯১৭: ১৯১৭ সালের ফেব্রুায়ারির শেষ রবিবার রুশ নারীরা যুদ্ধে তাদের দুই মিলিয়ন রুশ সৈন্যের করুন মৃত্যুর প্রতিবাদে ”ব্রেড এন্ড পিস” ব্যানারে এক অসহযোগ হরতালের কর্মসূচি পালন করে। যা জারের পতনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং তখনকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নারীর অনেক দাবী অনুমোদনে বাধ্য হয়। এই হরতালটি নারীর অর্জনের ইতিহাসে মাইলস্টোন হয়ে রয়েছে যা এখন ইতিহাসের এক যুগপৎ বিস্ময়কর অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। সেই হরতালের দিনটিই জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ি ছিলো ২৩ শে ফেব্রুয়ারি এবং Gregorian ক্যালেন্ডার অনুযায়ি ৮ই মার্চ।
১৯১৮-১৯৯৯: সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্মের অব্যাবহিত পরে আন্তর্জাতিক নারীদিবসের গুরুত্ব একটি গ্লোবাল রূপ পায় যা উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। এ দিনটি বাৎসরিকভাবে পালন করা শুরু হয়। দিনটির গুরুত্বকে জোরদার করে জাতিসংঘ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের আয়োজন করে। জাতিসংঘ নারীর ক্ষমতায়ন সহ নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানবিক উন্নয়নের দিকটি বিশেষভাবে তুলে ধরার গুরুত্ব অনুভব করে। এবং বিভিন্ন কর্মসূচি যেমন ১৯৭৫ সালকে ‘নারীর বছর’ হিসেবে ঘোষনা করে।
২০০০: আজ এদিনটি অনেক দেশ সরকারি ভাবে পালন করে। অনেক উন্নয়নশীল দেশে এ দিনটিতে সরকারি ছুটি ঘোষনা করা হয়েছে। নারীর জীবন্নোয়নে এবং নারী ও পুরুষের সমতার প্রশ্নে এই দিনটিকে বিশেষভাবে পালন করা হয় যেমন আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলুরাস, কম্বডিয়া, চিন, জর্জিয়া, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে এই দিনটিতে পুরুষেরা নারীকে ফুল দিয়ে অভিন্দন জানায়। নতুন শতাব্দিতে জেনারেশনের ভেতরে যে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে সেখানে নারীর অধিকারের বাস্তবতা কেবল একটি সময়ের বিষয় মাত্র। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ছাড়া নারীর এ দীর্ঘ অর্জনকে তারান্বিত করা সম্ভব হবেনা।
নারীর এক শতাব্দির অর্জন যত শ্লথ বলেই মনে হোক না কেন, শত বছরের এই অর্জনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক গুরু দায়িত্ব আমাদের উপর। ৮ই মার্চের গুরুত্ব তাই আমাদের জন্য সীমাহীন গুরুত্বের। আমরা আমাদের পূর্বসুরীর কাছে ঋণী তারা তাদের সীমাহীন বাঁধার বিন্দাচল পার হয়ে আমাদের জন্য যে অনুপ্রেরণা রেখে গেছেন তাকে সামনে রেখে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে দৃঢ় ও অবিচল পদক্ষেপে। তবেই আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবো। নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা সকল বাঁধাকে অতিক্রম করবো, এই হোক আমাদের ৮ই মার্চের দৃপ্ত শপথ!
শেখ তাসলিমা মুনঃ মানবাধিকারকর্মী,সুইডেন প্রবাসী কলামিষ্ট।।