চেতনায় মার্চ…
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ ফেব্রুয়ারিতে যে রকম সারা মাস ধরে চলতে থাকে ভাষা আন্দোলনের ওপর আলোচনা ও নানা ধরনের কর্মসূচি, তেমনি মার্চ মাসে একই ধরনের নানা কর্মসূচি চলতে থাকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। এ বছরও এখন তাই চলছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান শাসকশ্রেণীর শোষণ-নির্যাতন জনগণকে বিপর্যস্ত করতে থাকার কারণে অল্পদিনের মধ্যেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র জনগণের কাছে স্পষ্ট হতে থাকে। সেই সঙ্গে হতে থাকে তাদের মোহভঙ্গ। পাকিস্তানে মুসলমানদের শাসন কায়েম হলে তারা হিন্দুদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবন নতুনভাবে গড়ে তুলে সুখ-সমৃদ্ধির মুখ দেখবেন এমনটি তারা আশা করেছিলেন; কিন্তু সে আশা তাদের পূরণ হয়নি। উপরন্তু অল্পদিনের মধ্যেই জনগণের শিক্ষিত ও সচেতন অংশের কাছে এটা পরিস্কার হয়েছিল যে, হিন্দুদের হাত থেকে পরিত্রাণের আওয়াজ তুলে মুসলমানদের সতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন হয়েছিল তার মধ্যে মুসলমান জনগণের জন্য পাওয়ার কিছু ছিল না। এমনকি যে সাংস্কৃতিক আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছিল তার কোনো সম্ভাবনাও সেই আন্দোলনের মধ্যে ছিল না। কাজেই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই পাকিস্তান রাষ্ট্রে হিন্দু জমিদার, মহাজন বিভিন্ন পেশাজীবীর প্রভাব-প্রতিপত্তি আর না থাকলেও হিন্দুদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক মুসলমান শাসকশ্রেণী। ব্রিটিশ শাসনের কাঠামোর মধ্যে হিন্দুদের কোনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিল না। শিক্ষা-দীক্ষা এবং আর্থিক সামর্থ্যরে দিক থেকে তারা ছিল মুসলমানদের চেয়ে অনেক অগ্রসর। তাছাড়া সারা ভারতে তারা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এজন্য মুসলমানদের ভয় দেখানো হয়েছিল এবং অনেকে সত্যি সত্যিই ভয় পেয়েছিল যে, স্বাধীন ভারতে হিন্দুদের শাসন কায়েম হলে তারা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হবে। পাকিস্তানে সে আশঙ্কা থেকে মুক্ত হলেও তারা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর অধীনে বাস্তবতই পরিণত হয়েছিলেন তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে। এ অবস্থায় তারা যে শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন তা-ই নয়, তাদের ওপর চালানো হয়েছিল এক পরিকল্পিত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। এই আগ্রাসনের সব থেকে উচ্চারিত রূপ ছিল বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ, উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা। এ চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই এখানে প্রতিরোধ শুরু হয়। কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয় অন্যান্য বৈষম্য এবং শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ। কাজের অভাব, খাদ্যের অভাব, শিক্ষার ক্রমাগত অবনতি, কৃত্রিমভাবে ইসলামী সংস্কৃতির নামে এক উদ্ভট জিনিস চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা, শ্রমিক নির্যাতন, দুর্ভিক্ষের অবস্থা, সাধারণভাবে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি সবকিছু মিলিয়ে পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে যে বিক্ষোভ ও প্রতিরোধের সৃষ্টি হচ্ছিল তারই প্রতিফলন ঘটেছিল ভাষা আন্দোলনে। কাজেই ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলাভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিল না, সেটা ছিল তৎকালীন পূর্ববাংলার পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বিশাল আকারের এক প্রতিরোধ সংগ্রাম।
সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ পূর্ববাংলার মাটি থেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে উৎখাত হয়েছিল। কিন্তু সেটাই শেষ নয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন যেসব মূল কারণে প্রথম প্রতিরোধ আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল, সেই একই কারণে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এ অঞ্চলে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একের পর এক বহু আন্দোলন হয়েছিল, যার একটা পরিণতি ঘটেছিল ১৯৬৮-৬৯ সালের গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে। এত দীর্ঘ সময় ধরে ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত যে আন্দোলন হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে তার কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল না। প্রকৃতপক্ষে সে আন্দোলন ছিল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের এক dress rehearsal (ড্রেস রির্হাসেল)। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের এই পশ্চাৎভূমি এই যুদ্ধের ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও এ নিয়ে বিশেষ কোনো আলোচনা দেখা যায় না। এ আলোচনায় ২৪ বছরব্যাপী কৃষক-শ্রমিকের সংগ্রামের কোনো স্থান নেই, ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনের কোনো স্থান নেই, পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কোনো স্থান নেই। এ সবকিছুই উহ্য রেখে এখানে আলোচনা হয় মুক্তিযুদ্ধের। এ কান্ড দেখে মনে হয়, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ এক অলৌকিক ব্যাপার, ম্যাজিকের মতো ঘটনা। মনে হয় জাদুরকাঠি ঘুরিয়ে বাংলাদেশের এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, এতে জনগণের কোনো ভূমিকা নেই। অথচ ২৪ বছর ধরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এই স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছে। প্রথম দিকে অস্পষ্ট এবং অনুচ্চারিতভাবে শুরু হলেও অতি অল্প দিনের মধ্যেই এ আন্দোলন গতিলাভ করে। ১৯৫০-এর দশকেই মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানের প্রকাশ্য জনসভায় পাকিস্তান সরকারকে ‘আসসালামো আলায়কুম’ দিয়ে বলেন, ‘তোদের সাথে আর থাকার মতো অবস্থা নেই।’ ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলায় মুসলিম লীগ উৎখাত হওয়ার মধ্যে এ সম্ভাবনার বিষয়টিই উচ্চারিত হয়েছিল। মুসলিম লীগ উৎখাত হওয়ার পর তৃতীয় কোনো সারা পাকিস্তান পার্টি পাকিস্তানের ইতিহাসে আর গঠিত হয়নি। কারণ পাকিস্তানের দুই অংশের স্বার্থের মধ্যে এমন দ্বন্দ ও বৈপরীত্য রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে ছিল, যাতে এই দ্বন্দ ও বৈপরীত্য সামাল দিয়ে কোনো একক পার্টি গড়ে ওঠা তৎকালীন পরিস্থিতিতে সম্ভব ছিল না। কাজেই পাকিস্তানের প্রত্যেক পার্টিই ছিল হয় পূর্ব নয়তো পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক। সারা পাকিস্তান পার্টির এক রূপ সাময়িকভাবে দেখা গিয়েছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের মধ্যে। কিন্তু যে কারণে অন্য কোনো সারা পাকিস্তান পার্টি গঠিত হতে পারেনি, সেই একই কারণে ন্যাপের পক্ষেও একটি প্রকৃত সারা পাকিস্তান পার্টি হিসেবে বিকশিত হওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু কোনো সারা পাকিস্তান পার্টি গঠন সম্ভব না হলেও পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম থেকেই রাজনৈতিক আন্দোলন শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবেই গড়ে উঠতে থাকে ও প্রথম দিকে কমিউনিষ্ট পার্টি এবং আওয়ামী লীগ ও কমিউনিষ্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত যুবলীগ এবং ন্যাপের মাধ্যমে এ প্রতিরোধ সংগ্রাম শক্তিশালী হতে থাকে। এই সঙ্গে যুক্ত হয় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ইত্যাদি সংগঠন। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন এবং মওলানা ভাসানীর নেতৃত্ব্যে ও কমিউনিষ্টদের অংশগ্রহণে সংগঠিত হয় কৃষক সমিতি। এসব নানা ধরনের সংগঠনের মধ্যে অল্পবিস্তর পার্থক্য থাকলেও তাদের সম্মিলিত সংগ্রাম ষাটের দশকের মধ্যভাগে একটা স্পষ্ট চরিত্র লাভ করে। পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে পূর্ববাংলার জনগণের যে পাওয়ার কিছু নেই, ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করে তারা যে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন হননি, এ সত্যের উপলব্ধি এ সময়েই ব্যাপক জনগণের মধ্যে দেখা যায়। এরই প্রতিফলন ঘটে আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচি এবং কমিউনিষ্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে, যারা ১৯৬৯-এর আন্দোলনের সময়ই প্রকাশ্য রাস্তায় আওয়াজ তোলে ‘ছাত্র-শ্রমিক অস্ত্র ধরো, পূর্ববাংলা স্বাধীন করো’। ১৯৬৯-এর আন্দোলনকে এ কারণেই বলা যেতে পারে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের dress rehearsal (ড্রেস রির্হাসেল)। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর পরিস্থিতি আরো দানা বাঁধে। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন হঠাৎ স্থগিত করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১ মার্চ যে ঘোষণা দেন সেটাই প্রকৃতপক্ষে ছিল পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৃত্যুঘণ্টা। সেই ঘণ্টাধ্বনি থেকেই স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল, পাকিস্তান বিভক্ত করা ছাড়া পাকিস্তানের তৎকালীন রাজনৈতিক সংকট নিরসনের আর কোনো সম্ভাবনা নেই। পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্তি ছাড়া জনগণের আর কোনো উপায় নেই। এ উপলব্ধি জনগণের সর্বস্তরে ভালোভাবেই, বলা চলে তার চূড়ান্তরূপে দেখা দিয়েছিল ১ মার্চ। কাজেই ওইদিন থেকেই শুধু ছাত্র নয়, ঢাকার আশপাশের শিল্পকলের শ্রমিকরা এবং ঢাকার বাইরে অন্যান্য শহর ও গ্রামাঞ্চলেও শ্রমিক-কৃষক-জনগণ আওয়াজ তোলেন ‘অস্ত্র ধরো, পূর্ববাংলা স্বাধীন করো’। বিপুলসংখ্যক মানুষ পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সভাস্থলে উপস্থিত হয়েও ওইদিন এই একই আওয়াজ তুলেছিলেন। বাংলাদেশে এমন এক রাজনৈতিক অস্থিরতা
চারদিকে দেখা দিয়েছিল, যাকে এক ধরনের বৈপ্লবিক অস্থিরতা হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। ৭ মার্চ শেখ মুজিবের জনসভা বক্তৃতায় তারই প্রতিফলন ঘটে। ছাত্রলীগ সে সময় আওয়ামী লীগের প্রেসার গ্রুপ হিসেবে শেখ মুজিবের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করায় তিনি ওই জনসভায় ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ কিন্তু তার পরদিন থেকেই তিনি শুরু করেন এক অহিংস অসহযোগ আন্দোলন এবং ১৫ তারিখে ইয়াহিয়া ঢাকা আসার পর শুরু করেন ক্ষমতা ভাগাভাগির জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ও সরকারের সঙ্গে আলোচনা। এ দুই-ই ছিল তৎকালীন পরিস্থিতিতে অবাস্তব। কারণ ইতিমধ্যেই পাকিস্তান খুব বাস্তব অর্থেই বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। এ বিভক্তি ঠেকানোর কোনো পথ আর খোলা ছিল না। কোনো ধরনের আলোচনার মাধ্যমেই এ পরিণতি ঠেকিয়ে রাখার সম্ভাবনা আর ছিল না। এ পরিস্থিতিতেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আমাদের জনগণের ওপর এক সর্বাত্মক সশত্র আক্রমণ শুরু করে, শুরু হয় সশত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং এ স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে অর্জিত হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।