বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতি আমাদের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে!
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ ২৬ মার্চের এ দিনটি ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হয়। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। কিন্তু আয়তনের হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে ৯৩তম, ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ। বাংলাদেশের ওয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে ২০০৬ সালে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী বাংলাদেশ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। এদেশের একজন বিখ্যাত কবি একবার এই নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন! তার মনের ভেতরে জমে থাকা সব আবেগ আর ভালোবাসা হু হু স্রোতের মতোই তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো কবিতাটির পংক্তিতে পংক্তিতে। সেই বিখ্যাত কবির নাম- নির্মলেন্দু গুণ। তিনি তার সেই কবিতায় লিখেছিলেন- ‘তখনি পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ জনসমুদ্রে জাগিলো জোয়ার… শেষে লিখেছিলেন- কবি শোনালেন তার অমর কবিতাখানি/ এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম… … সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের’। এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে কবি কার কথা লিখেছিলেন কবিতায়! এই চিরকালীন উজ্জ্বল সূর্যের মতো দীপ্র, বলিষ্ঠ কথাগুলো কে বলেছিলেন? আসলে বলতে হবে, কে আমাদের বাঙালী জাতির সামনে অকুতভয় বলিষ্ঠ দীপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, বাঙালী জাতির স্বাধীনতার ঘোষণার কথাটি। সেই সিংহ-হৃদয় মহান মানুষটির নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জনক। আমরা তাঁকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু নামে ডাকি।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের লাখো নিযুত মুক্তিকামী মানুষের জন্য তিনি ডাক দিয়েছিলেন আমাদের মুক্তির সংগ্রামের, ডাক দিয়েছিলেন আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের, আর ’৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতের অন্ধকারে অসহায় নিরস্ত্র বাঙালীদের উপরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অতর্কিতে নিষ্ঠুর অমানবিকভাবে আক্রমণ করেছিলো এদেশের নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর। এরপর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের আগমুহূর্ত পর্যন্ত; আমাদের দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তির সংগ্রামে, পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে আমাদের বাঙালী জাতির মুক্তিযুদ্ধে অগণিত মুক্তিযোদ্ধাকে সাহস যুগিয়েছিলো তার সেই ভাষণ। বাংলাদেশের নিরস্ত্র নির্যাতিত মানুষকে সাহসে বুক বেঁধে রুখে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিলো সেই নিদারুণ কঠিন সময়ে।
মার্চ ২৬, ১৯৭১, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাদের স্বাধীনতার জন্য ঝাপিয়ে পড়ে। সাধারণ গ্রামবাসী থেকে রাজনীতিবিদ – সবাই একটাই লক্ষ্যে ছুটে চলে, যা হলো – স্বাধীনতা! স্বাধীনতা কখনো সহজে আসেনা। এর জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের জনগণের উপর হামলা চালায় ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ এর কালো রাত্রিতে। অসংখ্য মানুষ হত্যা করে, গ্রামের পর গ্রাম জালিয়ে দেয়, কিন্তু থামাতে পারেনা মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলন। আমরা সবাই কমবেশী এসব ইতিহাস জানি, জানি আমরা জানি আমাদের পূর্বপুরুষদের আত্মত্যাগ, রাজাকার, আল-বদরদের ভূমিকা। প্রায় প্রতিটি পরিবারই কাউকে না কাউকে হারিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে। আমাদের এই প্রজন্ম আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। আমাদের সম্বল বইপত্র, ছবি আর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ। তবে আমরা একটা জিনিস অবশ্যই দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকান্ড দেখতে না পারলেও আমরা রাজাকারদের কাজকর্ম দেখছি! বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতি আমাদের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানীদের সেই পৃথিবীর ইতিহাসের ঘৃণ্যতম গণহত্যার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। এর মূলে ছিলো বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসম্বাদিত নেতা হিসেবে বাঙালী জাতির আত্ম নিয়ন্ত্রণ আর অধিকার প্রতিষ্ঠা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হওয়ার ক্ষণটি থেকে প্রতিটি ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে আমাদের বিজয় দিবস, যেদিন আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম। এর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ৭ মার্চের ভাষণেই তিনি বাঙালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে ছিলেন। তিনি শুধু ডাকই দেননি! সবাইকে প্রস্তুত হয়ে হানাদার পাকিস্তানী শত্রুর মোকাবিলা করতেও বলেছিলেন। একজন প্রাজ্ঞ নির্ভীক নেতা কী অসাধারণভাবে বলিষ্ঠ অথচ এক অনাড়ম্বর সহজ ভাষায় সারাদেশের মানুষকে কী কী করতে হবে তার এক নিখুঁত যুদ্ধ পরিকলনা বলে দিচ্ছেন! ব্যাঙ্ক-বীমা, টাকা-পয়সা, খাবার-আশ্রয় সব বিষয়েই সহজ কিন্তু প্রাঞ্জল ভাষায় এক এক করে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কার কী করণীয় সেই ৭ মার্চেই তিনি একটিমাত্র বক্তৃতাতেই সব বলে দিয়েছিলেন। আর তাই, যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আর তাদের এদেশের সহযোগী রাজাকার, আল বদর এর নির্মম ঘাতকরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই কালরাতে সারাদেশে পাখির মতোই গুলি করে মারছিলো বাঙালী নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু সবাইকে, তখন, বিচলিত সন্ত্রস্ত মানুষ পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে রুখে দাঁড়িয়েছিলো পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে। আজ আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, আজ ৩০ লক্ষ অকুতোভয় শহীদের আত্মত্যাগের কারণে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ, আজ নিদারুণ অন্ধকার কষ্টের রাত পেরিয়ে আমরা সবাই পৌঁছে গিয়েছি স্বাধীনতার আলোমাখা সকালে; আজ সেইসব আত্মত্যাগের মুহূর্ত আমাদের গৌরবের ইতিহাস হয়ে গেছে।
প্রকৃত অর্থে বাঙালী জাতি সেই ১৯৫২ সালেই ভাষার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করেছিলো। বলা চলে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সেইই শুরু। ৫২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের সেই তারিখটি ছিলো বাংলা ৮ ফাল্গুন, ২১ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানী শাসকের অনুগত ঘাতক বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিলো এদেশের ছাত্র-শিক্ষক-জনতার ওপর। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের এইসব অকুতভয় প্রতিবাদী শহীদদের আত্মত্যাগের কারণেই আমরা পেয়েছিলাম ভাষার স্বাধীনতা। আজ যে বাংলাভাষায় লিখছি এ তাদেরই আত্মত্যাগ আর মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার জন্য মায়ের ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করারই অর্জন। এরপরে আসলো ১৯৬৯ আর ৭০ সাল। সেসময় পাকিস্তানী শাসকদের বাঙালীদের প্রতি নির্যাতন-অত্যাচার-শোষণ ক্রমশ এতোটাই চরমে পৌঁছেছিলো যে ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবি-রাজনীতিবিদ সবাই স্বাধীনতার পক্ষে একজোট হতে শুরু করেছিলেন। ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে বঙ্গবন্ধু তার এক ভাষণে পাকিস্তানের বৈষম্য আর শোষণের ছবি অসাধারণভাবে তুলে ধরেছিলেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য ছিলো এই বঞ্চনা আর শোষণ দুর করা। তিনি বলেছিলেন-‘দীর্ঘ ২২ বছর পরও (ভারত ভেঙে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার) সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রে … কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরীতে বাঙালীদের সংখ্যা ছিলো শতকরা ১৫ ভাগের কম। দেশরক্ষা সার্ভিসে ১০ ভাগেরও কম।… নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতে পূর্ব বাংলায় (আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে) শতকরা ৫০ থেকে ১০০ ভাগ বেশী। পূর্ব বাংলায় ১ মন মোটা চালের মূল্য ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে ২০ থেকে ২৫ টাকা। ব্যাংকিং সম্পদের শতকরা ৮০ ভাগ এবং বীমা সম্পদেরও শতকরা ৭৫ ভাগ তাদের দখলে। …এইভাবে এদেশে এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক শোষণ চলেছে।’ বাংলাদেশের সেই স্বর্ণ সময় আমি চোখে দেখিনি, পড়েছি আর বাবার মুখে শুনেছি। আমার বাবা এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। এতো কষ্ট আর নিষ্ঠুরতার সময়ও আর কখনো আসেনি এদেশের মানুষের জীবনে, এতো বীরত্ব আর সাহসও বাঙালী কখনো দেখায় নি আজবধি। কতো শত শহীদ যে এদেশের সবুজ মাঠ প্রান্তরে আজ মিশে আছেন! আমরা তাদের সবার নামও জানি না। জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও ক্যাপেন মনসুর আলীর বীরত্বেও কথা অনেকের-ই অজানা! দুঃখজনক হলেও সত্যি, এখন মুক্তিযোদ্ধারাই সবচেয়ে বেশী নিগৃহীত। রাজাকারদের উত্তরসূরীদের দেখি মুক্তিযোদ্ধার পশ্চাতদেশে লাথি মারে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সামনে। আমাদের প্রজন্ম এতটাই দুর্ভাগা আমরা, এই ছবি দেখতে হয়! আমাদেরকে দেখতে হয় রাজাকাররা জাতীয় পতাকাবাহী গাড়ীতে চড়ছে! স্বাধীনতার এতগুলো বছরেও তাদের বিচার হলো না। এতগুলো বছরে কি উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের? আমরা কি জাতি হিসাবে গর্ব করতে পারি? যেখানে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নাই, যথেষ্ট শিক্ষা-ব্যবস্থা নাই, রাজনৈতিক স্থিরতা নাই। কোথায় আমরা এই প্রজন্ম স্বাধীনতা খুজবো? আমাদের দারিদ্রতায়? হ্যা, এতকিছুর পরেও আমি বাংলাদেশী। গর্ব করি নিজেকে বাংলাদেশী হিসাবে। কয়টি দেশের অমন স্বাধীনতার ইতিহাস আছে? আমাদের এত না পাওয়া, এত হতাশার মাঝেও স্বপ্ন দেখি সত্যিকারের সুখী বাংলাদেশের। এত কষ্টের পরেও আমি থাকতে চাই বাংলাদেশের মাটিতে। কখনো বলতে চাই না, এই দেশে থেকে আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল। কখনো বলতে চাই না, এই দেশের কিচ্ছু হবেনা। তাহলে যে, আমার দেশের অপমান, আমার মায়ের অপমান! আসুন সবাই আমাদের বাংলাদেশকে ভালোবাসি। শপথ নেই, বাংলাদেশ গড়ার, শপথ নেই, দেশের বিরূদ্ধে যে কোন ষড়যন্ত্র রোখার।
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।