পবা ও ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট-এর যৌথ মতবিনিময় সভাঃ পার্ক ও খেলার মাঠ রক্ষায় সরকারী প্রতিষ্ঠান দায়বদ্ধ
নিজস্ব প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ ঢাকা শহরে বর্তমানে অপর্যাপ্ত পার্ক ও খেলার মাঠ না থাকা অন্যতম নাগরিক সমস্যা। যে কারণে রোগের ঝুঁকি, সামাজিকীকরণের সীমাবদ্ধতা বৃদ্ধিসহ ঢাকা শহর প্রাণহীন এবং বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন এলাকায় বর্তমানে বিভিন্ন আকারের ৫৪ টি পার্ক এবং ১১ টি খেলার মাঠ রয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তাছাড়া বিদ্যমান অধিকাংশ পার্ক ও মাঠসমূহ ব্যবহারের উপযোগী না থাকায় মানুষ এর সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এজন্য বিদ্যমান মাঠ-পার্ক রক্ষা করে তা শিশু-কিশোর-তরুণ-বৃদ্ধÑসবার বিনোদন ও শারীরিক-মানসিক বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করতে সরকারী প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্ট এর যৌথ উদ্যোগে ধানমন্ডিস্থ বিলিয়া সেন্টারে (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল’ইয়ার্স এসোসিয়েশন) অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বিশিষ্ট আলোচকবৃন্দ উপরোক্ত পরামর্শ দেন। “সুস্থ্য, সামাজিক, প্রাণবন্ত ও বসবাসযোগ্য নগরীর জন্য পার্ক ও খেলার মাঠ: প্রেক্ষিত ঢাকা” শীর্ষক মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পবা সম্পাদক আবদুস সোবহান। ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর পরিচালক এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম-এর সঞ্চালনায় সভায় আলোচনা করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান, সাবেক আইজিপি ও আইন কমিশনের সাবেক সদস্য ড. এম এনামুল হক, সরকারী কর্ম-কমিশন (পিএসসি) এর সদস্য ইকরাম আহমেদ, বিআইপি সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আনসার হোসেন প্রমুখ। সভায় লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর প্রকল্প সমন্বয়কারী আমিনুল ইসলাম সুজন।
লিখিত প্রবন্ধে আমিনুল ইসলাম সুজন বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে মাঠ-পার্ক-এর মত গুরুত্বপূর্ণ উন্মুক্ত স্থানসমূহ দখল-বেদখল ও দূষণে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ায় মানুষের মুটিয়ে যাওয়া, ডায়বেটিস, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোকসহ নানারকম অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যে বলা হয়, বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের কারণে ৬১ শতাংশ মানুষ মারা যায়, এ মৃত্যুর অধিকাংশই শহরে ঘটছে। পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে এসব রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে গ্রামের তুলনায় শহরে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক এর কারণে মৃত্যুহার দ্বিগুন। পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে এ সব রোগের ঝুঁকি ৬০ শতাংশ হ্রাস করা যায়। কিন্তু শহর এলাকায় পর্যাপ্ত খেলার মাঠ, পার্ক না থাকায় নগরবাসী হাঁটা-চলা, খেলাধুলা এবং শরীর চর্চার করার জন্য প্রয়োজনীয় স্থান পায় না।
ড. এম এনামূল হক বলেন, বিদ্যমান অধিকাংশ মাঠ ও পার্কে নারী ও শিশুদের যাবার মত পরিবেশ নাই। ঢাকায় মাঠ ও পার্কের সীমাবদ্ধতার কথা জানি। কিন্তু যেগুলো আছে সেগুলো যেন সবার জন্য নিরাপদ, স্বাচ্ছন্দ্যময়, দখল ও দূষণমুক্ত রাখা হয়Ñসেদিকে নজর দিতে হবে। মাঠ-পার্ক ও জলাশয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো রক্ষায় আইনের অভাব নাই। কিন্তু এসব আইন পালন করার দৈন্যতা লক্ষ্যণীয়। সবাইকে শিশুদের স্বার্থে, নিজের সন্তানের কথা চিন্তা করে মাঠ-পার্কের মত স্থানগুলো রক্ষায় আইন মেনে চলতে উৎসাহী করে তুলতে হবে। পাশাপাশি আইন লঙ্ঘণকারীদের কঠোর সাজার ব্যবস্থাও করতে হবে। তবেই বিদ্যমান মাঠ ও পার্কগুলো রক্ষা করা সম্ভব হবে।
অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান ব্যক্তিগত উদাহরণ দিয়ে বলেন, ১৯৫২ সালে যখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হই তখন ঢাকার অধিকাংশ এলাকা ছিল আদর্শ গ্রাম। অনেক খাল-বিলসহ নানারকম জলাশয় ছিল, বৃক্ষরাজি ছিল। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়নের সুযোগে এখন সমগ্র ঢাকা ইট-বালু-সিমেন্টের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সমস্যাসঙ্কুল এ ঢাকায় উদ্যান, পার্ক, খেলার মাঠ হচ্ছে মানুষের নিশ্বাস নেয়ার ভাল স্থান। শিশুসহ সব বয়সী মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিনোদনের কেন্দ্রস্থল। তাই এগুলো রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন।
ইকরাম আহমেদ বলেন, উন্নত দেশগুলো মানুষের সুস্থ্যতার জন্য হাসপাতাল নির্মাণের চাইতে মাঠ, পার্কের মত প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণকে গুরুত্ব দেয় বেশি। আমাদেরও সেদিকে নজর দিতে হবে। খন্দকার আনসার হোসেন বলেন, শিশুদের সুস্থ্যভাবে বেড়ে উঠার জন্য যে পরিবেশ দরকার, ঢাকায় ক্রমেই তা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ফ্ল্যাটবাড়িতে শিশুরা একাকীত্বের মাঝে বেড়ে উঠে, যা তাদের আত্মকেন্দ্রীক ও নেতিবাচকতার দিকে ধাবিত করে।
আবদুস সোবহান বলেন, সরকারী কলোনীর মাঠসহ সব মাঠে, পার্কে শুধু খেলার জন্যই ব্যবহার করার বিধান রেখে সব ধরনের বাণিজ্যিক কাজ বন্ধ রাখতে হবে। যেহেতু খেলার মাঠের সঙ্কট রয়েছে তাই ‘ডেড এন্ড’ (যে সড়কগুলোর শেষ মাথায় সড়ক বন্ধ) সড়কে প্রতিদিন কিছু সময় গাড়ি চলাচল বন্ধ রেখে শিশুদের খেলার পরিবেশ গড়ে তোলা যেতে পারে। নতুন আবাসিক এলাকায় মাঠ-পার্ক রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সভায় আরও বক্তব্য রাখেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কামাল আতাউর রহমান, উইমেন এনভয় এর প্রেসিডেন্ট শিখা ভূঞাঁ, পুরান ঢাকার মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত, নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানা, জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় শামীম খান টিটু, বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার্স সমিতি’র সভাপতি কামাল সিদ্দিকী, বিসিএইচআরডি’র পরিচালক মো. মাহবুল হক, সিরাক বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক এস এম সৈকত প্রমুখ। এছাড়াও বউকস, সার্প, ডাস্ বাংলাদেশ, পল্লী উন্নয়ন সমাজকল্যাণ সংস্থা, ফুয়াড়া, অরুণোদয়ের তরুণ দল, ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গার (দি হাঙ্গার প্রজেক্টের তরুণ দল), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা কলেজ, স্ট্যামফোর্ম বিশ্ববিদ্যালয়, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের মাস্টার্সের ছাত্র-ছাত্রী, রায়েরবাজার হাইস্কুলের ছাত্ররা অংশগ্রহণ করে।