রিটনের জন্মদিনে শুভেচ্ছা…(অজয় দাশগুপ্ত)
অজয় দাশগুপ্তঃ রিটন কে আমি প্রথম দেখি ছত্রিশ বছর আগে। আমরা তখন কৈশোর কাল অতিক্রম করছি। তখন-ই এক অন্য ধরনের টান অনুভবের শুরু। আজকাল যা ভাবা ও কষ্টকল্পিত। রিটন তখন খ্যাতির পর্বতে পা রাখতে শুরু করেছে। আমরা থাকতাম চট্রগ্রামে। তখন ঢাকা যাওয়া এত সহজ ছিল না। বেশ কয়েকবার ফেরী পেরিয়ে তারপর রাজধানীর মুখ দর্শন। সে দর্শনের কালে ও বন্ধু লুৎফর রহমান রিটনের দর্শন যদি সুখকর ও প্রার্থিত-ই না হত আমরা কেন মিলিত হয়েছিলাম তবে? বয়স তখন অনেক কম আমাদের। এখনকার মত স্বাধীন স্বাধীন ভাবও চলতো না। কিছু সময় পর রিটন প্রায় ছুট দেবার মত করেই বাস ধরে বাসায় চলে গিয়েছিল। সন্ধ্যা নামার ভয়ে। সে বয়স থেকে আজ অবদি আমাদের সম্পর্ক বা ভালোবাসায় কখনো টান পড়েনি। না ব্যক্তিগত না আদর্শিক না অন্য কোন স্বার্থজনিত কারণে। কখনো ই আমরা বিভাজিত হই নি। আমাদের মধ্যে মত পার্থক্য আছে, মত নিয়ে দ্বিমত আছে। মতান্তর আছে। কিন্তু মন নিয়ে মনান্তর নেই। নেই কারণ রিটনের যে কোন ছড়ায় শতাধিক লাইক বা শ য়ে শ য়ে মুগ্ধতা দেখে আমার মনের হিংস্র ঈর্ষাকাতর বাঘ বা ভালুক লাফিয়ে ওঠে না। আমি মনে করে এটা তার প্রতিভার দ্যুতি। তার মেধা ও শ্রমের স্বীকৃতি। আমাদের বন্ধুত্বের ভেতর ঈর্ষা ঢোকেনি বা বেশি জানা কম জানার দেয়াল নেই বলেই সুদূর কানাডা থেকে রিটনের ফোনে বুদ্ধদেব বসু নিয়ে লেখার আগে তথ্য বিনিময়ের অপার আহ্বান ভেসে আসে। বিনিময়ে খৃদ্ধ হয়েছি আমরা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা এও জেনেছি আমাদের বাঁচার অবলম্বন সখ্যতা। অনাবিল ভালোবাসা। ইতোমধ্যে রিটন তার জায়গা করে নিয়েছে। বাংলাদেশের ছড়া সাহিত্যে লুৎফর রহমান রিটন কিংবদন্তী। আমাদের দেশে কোন কালেই প্রতিভার অভাব ছিল না। আজো ও নেই। প্রতিভাবান ছড়াকাররা বাংলাদেশের ছড়া সাহিত্যে রিটনের চেয়ে ভালো ছড়া লেখেন নি তাও বলিনা। কারো কারো কিছু কিছু ছড়া গগনস্পর্শী ঈর্ষনীয়। কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে লেখা নিয়মিত ভালো লেখা আর বিষয় ও সৃজনে নুতন থাকা ভিন্ন বিষয়। রিটন তা পেরেছে। অন্নদা শংকর রায়ের মত ছড়াকারও তাকে ভালোবাসা দিতে কুন্ঠিত হন নি। আমি এ কথা বলতেই পারি সুকুমার রায় সুকুমার বড়ুয়া’র পর রিটনের ছড়া বাংলাদেশে সবচে অধিক জনপ্রিয় আর সর্বত্রগামি। তার ছড়া বাচ্চাদের যেমন টানে দেশ পেরিয়ে বিদেশের বাংলাদেশীদের নতুন প্রজন্মে আবৃত্তির জন্য উঠে আসে তেমনি দেশে বিদেশে বড়দের ও সমান ভাবে আকর্ষন করে। রাজনীতি সমাজনীতি খেলা ধর্ম অধর্ম হেন বিষয় নেই যা তার ভেতর তার ছড়ার ভেতর প্রান পায় নি। আমার সৌভাগ্য আমি তাকে শুধু ছড়াকার হিসেবে নয় বন্ধু হিসেবে ও কাছে পেয়েছি। প্রবাসে নানা ধরণের জটিলতা উপদ্রব আর বিষাক্ত নিঃশ্বাস আছে। আছে স্বভাবসুলভ বিদ্বেষ। আমার দূঃসময়ে তাকে আমি পেয়েছি হিতৈষি ও সখার ভুমিকায়। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে আমি কি তার জন্য তেমন কিছু করতে পেরেছি? বই মেলায় দেশে গেলে রিটনের উৎসাহ আর উদ্দীপনায় টিভি মুখো হতেই হবে। বন্ধু বলে নয় বাংলাদেশের নবীন প্রবীন সব লেখকদের জন্য রিটনের ভালোবাসার প্রকাশ ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে ফুটে থাকে চ্যানেল আইয়ের পর্দায়। অন্য চ্যানেলগুলোর সাথে তুলনা করলেই বোঝা যাবে রিটন-ই হচ্ছে পার্থক্য। আমরা তাকে কি দিয়েছি? বা কি দিতে পারি? যদিও রিটন বা কেউ-ই কোন প্রাপ্তির আশায় কিছু করে না তবু যার যা প্রাপ্য তাকে তা দেবার নাম ই তো ন্যায়ধর্ম। তাই আমি ঠিক করেছি আগামী বই মেলায় দুই সুকুমার ও রিটনকে নিয়ে তাঁদের ছড়া নিয়ে একটি গ্রন্থ বের করব।
আশির দশকের শেষ দিকে চট্রগ্রামে প্রথম ছড়া উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ছড়াকার সাংবাদিক রাশেদ রউফ তখন টগবগে যুবক। তার সাংগঠনিক শক্তির উন্মেষ কালেও সে ছিল উদার। সম্মেলনের পর দিন অতিথি হয়ে আসা রিটন আমীরুল ইসলাম আর দাদাভাইকে ঘিরে কৌতুহলীদের ভীড়.. অনেকে-ই তাদের অতিথি হিসেবে নিতে চায়। আমাকে চয়েস দেয়া হয়েছিল দাদাভাই না রিটন, আমীরুল? শ্রদ্ধাভাজন সম্পাদক লেখক দাদাভাইয়ের সান্নিধ্য আর স্নেহের লোভ সামলিয়ে রিটন আর আমীরুলকেই চেয়েছিলাম আমি। আমার সে পছন্দ এখনো অটুট। প্রমানিত বন্ধুত্বে উত্তীর্ন। রিটন যে কত ভালো বন্ধু সে আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? ইদানিং তার চিন্তা চেতনা আর প্রকাশের ম্যাচিওরিটিও প্রশংসার। আমাকে সে শিখিয়েছে কলহ দীর্ন বাংগালি সমাজে ও প্রবাসে থাকতে হয় হাঁসের মত। পানি থেকে উঠেই গা ঝাড়া, ফেলে দিতে হয় নোংরা আর্বজনা। তার এই থিওরি আমাকে নতুন প্রাণ দিয়েছে। দিয়েছে বেগ। আমার এই বন্ধুটির হাসি তার বড় সম্পদ। আমি নিজে এমন প্রানখোলা হাসি হাসতে পারি না। তা ছাড়া প্রায় সব পরিবেশে সব অবস্থাতেই রিটন তা পারে। ওর কি দুঃখ নেই? বেদনা নেই? ওকে কি আমরা কষ্ট দেই না? তারপর ও সব পরিবেশে এমন প্রাণবন্ত দিলখোলা হাসির বন্ধুকে শ্রদ্ধা না করে উপায় আছে? হাসি আর আনন্দের প্রতীক রিটন আড্ডাবাজ। ঠাট্রা প্রিয়। কৌতুকপ্রবন নিখাদ বন্ধু। তাই সন্দেহ হয় ওর জন্ম কি সত্যি ১ এপ্রিল? নাকি সে আমাদের বোকা বানাচ্ছে? এপ্রিলের প্রথম দিনে জন্মবলেই তাকে আমার হাসির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখতে পারছি। জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা আর তার মত বন্ধু পাবার জন্য আমি তো কলার নাড়াতেই পারি না কি??
অজয় দাশগুপ্তঃ সিডনী প্রবাসী কলামিষ্ট।।