ইতিহাস,অভিজ্ঞতা এবং আশঙ্কা
মুনীব রেজওয়ানঃ গণচীন বিশাল বড় একটি দেশ। যারা বেইজিং পর্যন্ত গেছেন নিশ্চয় গিয়ে থাকবেন ১০৯ একরের সুবিশাল তিয়ানামেন স্কোয়ারে। এখানে চীনের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক ইভেন্টগুলোর আয়োজন করা হয়। ১৬৫১ সালে এই স্কোয়ারটির মূল নক্সা এবং নির্মাণ সম্পন্ন হলেও গত শতকের ৫০ এর দশকে এর আয়তন চারগুণ প্রশস্ত করা হয়। এই চত্বরটিই পৃথিবীর সবচে বড় সিটি চত্বর। যখন ফাঁকা থাকে প্রায়—এই চত্বরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালে মনে হতে পারে পৃথিবীটা সত্যি অনেক বড়–সেই সাথে নিজের ভিতর থেকে বেড়িয়ে এসে কেউ কেউ বুকের মাঝে বিশ্বলোকের সাড়াও পেতে পারেন। চত্বরটির একপাশে রয়েছে তিয়ানানমেন টাওয়ার কিম্বা যাকে বলা হয় স্বর্গশান্তি দ্বার ( Gate Of Heavenly Peace) যেখানে অনেক বড় করে চেয়ারম্যান মাও যে দং এর একটি ছবি ঝোলানো আছে। চাইনিজদের মুখে শুনেছিলাম–একবার নাকি এই ছবিটা পরে গিয়েছিল নিচে আর প্রায় সাথে সাথেই বেইজিং ঢেকে গিয়েছিল কাল মেঘের আঁধারে। জানিনা ঘটনার সত্যতা। আমার কাছে কাকতালীয়ই মনে হয়েছে বিষয়টি তবে আপনি প্রায় ট্যাক্সিক্যাবেই ড্রাউভারের মিরর ছুঁয়ে ঝুলতে দেখবেন মাও যে দং এর ছবি। তাঁকে চাইনিজদের অনেকেই এখনো ঈশ্বরের মতো পুজো করে। যাহোক! এখানেই এক পাশে চীনের সুবিশাল জাতীয় যাদুঘর। আমাকে মাঝে মধ্যেই যেতে হতো–কখনো গেস্ট এলে তাদের নিয়ে। যাদুঘর তো আমার সবচে বড় নেশা। ব্যাক্তিগত ভাবে এখানে আমার অনেক স্মৃতি জড়িত। আজ হঠাৎ কেন মনে পড়ে গেল এই চত্বরের কথা জানিনা। এখানেই ঘটেছিল এক হৃদয় বিদারক হত্যাযজ্ঞ। ৪ জুন, ১৯৮৯। ছাত্ররা গণতন্ত্রের দাবীতে তখন সোচ্চার। আমাদের দেশে এখন প্রজন্ম চত্বরে যেমনটি হচ্ছে এর চেয়েও অনেক বড় ছিল সেই আন্দোলন। সেখানে তিন থেকে চার হাজার ছাত্রের সপ্তাহব্যাপী গনঅনশনও হয়েছিল। তখনকার সেই আন্দোলন সমগ্র চীনব্যাপী ছড়িয়ে পরেছিল এবং সারা দেশ থেকে মূলত ছাত্ররা এস যোগ দিচ্ছিল এই চত্বরে। ছাত্রদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছিল শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, রিক্সাওয়ালা (চীনের অনেক শহরে এখনো রিক্সা চলে, বেইজিং এ তো বটেই) থেকে শুরু করে প্রায় সর্বস্তরের জনতা। ‘গণতন্ত্রের দেবী’ ( Goddess Of Democracy ) নামে স্ট্যাচ্যু অব লিবার্টির অনুকরণে এই চত্বরে তখন একটি ভাস্কর্য স্থান করে ছাত্ররা যা সেই আন্দোলনের মূর্ত প্রতিক হয়ে ওঠে তখন। বিষয়টি এতোই ব্যাপকতা পায় যে তৎকালীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরেও করনীয় নিয়ে বিতর্ক লেগে যায়। সে অনেক ঘটনা। পরে কখনো বিস্তারিত বলা যেতে পারে প্রসংগ এলে। যাহোক! চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তখন এই আন্দোলন দমাতে তিন লক্ষ আর্মি নিয়ে আসে বাইরের প্রভিন্সগুলো থেকে এই কারণে যে বেইজিং এর আর্মিদের অনেকেই তখন ছাত্রদের এই আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল বিবেচনায়, ৩ জুন রাত ১০ টা তিরিশ আর্মি রাস্তা না পেয়ে সরাসরি ট্যাংক তুলে দেয় আন্দোলনকারীদের উপর—ব্রাশ ফায়ার, বেয়নেট চার্জ—-শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। চীনা পার্টি বলে তারা ৩০০ ছাত্র/জনতা হত্যা করেছে কিন্তু সমর্থিত সূত্র বলে এই সংখ্যা ৪,০০০ এর কম নয় কিছুতেই, কারণ সৈন্যরা তিয়ানানমেন স্কোয়ারের আশেপাশের এলাকাতেও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে সেই রাতে। তারপর লাশ অজ্ঞাত স্থানে পুতে ফেলে। ৪ জুন, ১৯৮৯ ভোর ছটায় তিয়ানানমেন স্কোয়ার এভাবেই খালি করা হয়েছিল সেদিন। না—আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তবতায় তিয়ানানমেন স্কোয়ারের মত ঘটনার কোন ঘটনার মিল নেই কারণ আমরা একটি গণতান্ত্রীক সরকারের শাসনে বসবাস করছি। তবে একটা আন্দোলন চত্বর আমাদের হয়েছে –বিষয়টি এমন নয় যে তারা সরকার বৈরী বরং সরকার প্রধান নিজেও সংসদে দাঁড়িয়ে এই আন্দলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন।
মূলত আমি একটি তিয়ানানমেন স্কোয়ারের আন্দলনের মোটিভের ঠিক উল্টো একটি বিষয় দেখতে পাচ্ছি। আগামী ছয় তারিখে হেফাজতে ইসলাম নামের আড়ালে জামাতে ইসলামি লক্ষ লক্ষ লোক নিয়ে হাজির হবে আমাদের রাজধানী অচল করে সরকার ফেলে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে, সাথে সকল রাজনৈতিক আচার ভব্যতা ভেঙ্গে এই জামাতি হেফাজতের সাথে যোগ দেবে আমাদের দেশের আরো কিছু দল যাদের উদ্দেশ্যও সরকারের পতন। বড়ই আতংকগ্রস্ত হয়ে পরি ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের আন্দলনের কথা শুনলেই। সেদিন সরকারকে যদি কোন কারনে সেনাবাহিনী মাঠে নামাতে হয় কি হবে কেউ জানিনা আমরা। যাহোক! বিশ্বাস করতে চাই আমাদের দেশের সরকার বিচক্ষণতার সাথে আরো শক্ত হাতে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী, ধর্ব্যাবসায়ীদের শায়েস্তা করার ক্ষমতা রাখে। সাথে তরুণ প্রজন্ম রয়েছে জাগ্রত–যদিও খুব দুঃখের সাথে বলতে হয় –এই সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও এখনো যুদ্ধাপরাধী দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেনি–আইনের ফ্যাক্টরী তাদের হাতে, আগেও সন্ত্রাসী সংগঠন এই সরকার নিষিদ্ধ করার নজির রেখেছে–উন্মদ ‘আমার দেশ’ ‘সংগ্রাম’ কিম্বা নয়া/দিগন্তের মতো মিথ্যা, উস্কানীমূলক সংবাদ প্রচারকারীদেরও নিষিদ্ধ করছে না—আগে যদিও তাদের ইচ্ছায় মিডিয়া নিষিদ্ধ করার নজির এই সরকারের আছে। জানিনা এখন সরকারের মনে কি–মাঝে মধ্যে মনে হয় জামাতিদের সাথে গোপন আঁতাত নেই তো? আঁতাত নেইতো ধর্মান্দ ইসলামী দলগুলোর সাথে?–সময়ই সব স্পষ্ট করবে। তাকিয়ে আছি সামনের দিকে।
মুনীব রেজওয়ানঃ গবেষক ও প্রাবন্ধিক।।