৩৬ ঘণ্টার টানা হরতালঃ শুরুর আগেই নাশকতা,জনমনে আতংক
নিজস্ব প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ ২৩ এপ্রিল (মঙ্গলবার) সকাল ৬টা থেকে আবারও শুরু হচ্ছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা ৩৬ ঘণ্টার টানা হরতাল। চলবে বুধবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। এর মধ্যে বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটলে আরও একদিন হরতাল ডাকার আশঙ্কা আছে বলে বিএনপি দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এদিকে হরতাল শুরুর আগে সোমবার দুপুর থেকেই গাড়িতে আগুন দিয়ে নাশকতা ও জনমনে ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ১০টি গাড়িতে আগুন দেয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের মুক্তি ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রবিবার এ হরতাল আহ্বান করে ১৮ দলীয় জোট। রবিবার বিকেলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে ১৮ দলীয় জোটের বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ কর্মসূচী ঘোষণা করেন। সোমবার বিকেলে পল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, সরকার বিএনপির দাবি অনুযায়ী নেতাকর্মীদের মুক্তি না দিলে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানলে আগামীতে আরও হরতাল দেয়া হবে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, হরতাল বানচাল করতে সরকার মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের প্রবেশ ও বের হতে বাধা প্রয়োগ করছে। এটা সরকারের চরম স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিরোধী দলের ওপর দমনপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরকার তাদের অঙ্গসংগঠনে পরিণত করেছে। আজ দেশের সংখ্যালঘুরাও নিরাপদে নেই। গণমাধ্যমও সরকারের দমনপীড়ন থেকে রক্ষায় পায়নি। তিনি বলেন, সরকার দাবি না মানলে প্রয়োজনে ৭২ ঘণ্টা হরতাল দেয়া হবে। প্রয়োজনে চলমান আন্দোলকে বেগবান করতে আওয়ামী লীগের মতো হরতাল দেয়া হবে। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অভিযোগ করেছেন এ সরকার গণতন্ত্রের কথা বলে কিন্তু গণতন্ত্রের বিরোধী দল চায় না। আদালত চায় ন্যায়বিচার দেখতে চায় না। সরকার শুধু নির্যাতন বোঝে। আর এর শিকার হচ্ছে বিরোধী দল। তিনি বলেন, বিরোধী দলের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা মিথ্যা ও বানোয়াট। সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এসব মামলা দায়ের করেছে। তিনি বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সরকার নিজ থেকেই বুঝতে পারবে নির্দলীয় সরকার ছাড়া দেশে কোন নির্বাচন হবে না। এদিকে বিএনপির অপর স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহ সর্বাত্মক হরতাল পালনের জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সরকার বিচার বিভাগের কাঁধে বন্দুক রেখে দ্বৈত নীতিতে দেশ চালাচ্ছে। যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা ৬ ঘণ্টা ধরে সড়ক অবরোধ করে গাড়ি ভাংচুর করলেও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা করেনি। অথচ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক মামলা দিয়ে জেলে ঢোকাচ্ছে। বিএনপির শীর্ষ নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি এ আহ্বান জানান।
ছাত্রদলের মিছিল, গাড়ি ভাংচুর: টানা ৩৬ ঘণ্টা হরতালের সমর্থনে রাজধানীর নয়াপল্টনে ঝটিকা মিছিল বের করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। বেলা ১২টার দিকে ছাত্রদল কর্মীরা বিএনপির অফিসের বিপরীত পার্শ্বে জোনাকী সিনেমা হলের গলি থেকে মিছিল বের করে। মিছিলটি গলির ভেতর থেকে মূল সড়কে পৌঁছানোর পর পুলিশী বাধার মুখে পড়ে। মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ প্রথমে তাদের ধাওয়া এবং কাঁদানে গ্যাস শেল নিক্ষেপ করে। মিছিল থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে ছাত্রদলের কর্মীরা। পরে পুলিশী ধাওয়ার মুখে পালিয়ে যায় ছাত্রদল নেতাকর্মীরা। যাওয়ার সময় একাধিক যানবাহন ভাংচুর করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে।
হরতালের আগেই ১০ গাড়িতে আগুন: বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকে দুদিনের হরতাল শুরু আগের দিন সোমবার রাজধানীতে ১০টি যানবাহনে আগুন দিয়েছে হরতাল সমর্থনকারী পিকেটাররা। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ, ভাংচুরসহ নানা নাশকতা সৃষ্টি করে হরতাল সমর্থকরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, জাতীয় প্রেসক্লাব, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, বনানী, গুলিস্তান, কাওরান বাজার, গাবতলী এলাকায় এসব যানবাহনে আগুন দিয়েছে হরতাল সমর্থকরা। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, আগুনে পুড়ে যাওয়া এসব যানবাহনের ক্ষতির পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা। টানা দুদিনের হরতালে নাশকতা রোধে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আর তাদের সহায়তার জন্য ৪০ প্লাটুনের একটি বিজিবি দলও এদিন সন্ধ্যা থেকে রাজধানী ঢাকার রাজপথে টহলে থাকবে। এসব নাশকতায় নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এসব ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
অন্যদিকে রাজধানী থেকে ছাত্রশিবিরের দুই নেতাকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে বিপুলসংখ্যক রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী জিহাদী বই ও লিফলেট উদ্ধার হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে জানিয়েছে র্যাব। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, সোমবার বিকেল ৩টার দিকে প্রেসক্লাবের সামনে তোপখানা রোডে যাত্রীবাহী ট্রান্সসিলভা পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় হরতাল সমর্থনকারীরা। এ সময় যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে বাস থেকে নেমে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসে দুই ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে বাসের কয়েকটি সিট ভস্মীভূত হয়। ফায়ার সার্ভিসের হেডকোয়ার্টারের ফায়ারম্যান মোঃ আনিসুর রহমান এ কথা জানান। তিনি বলেন, বিকেল সোয়া ৪টার দিকে গাবতলী পুলিশ বক্সের সামনে ৮ নম্বর রুটের একটি বাসে (ঢাকা মেট্রো জ-১১-১৫২৭) আগুন দেয়া হয়। দুপুর ২.৩৫ মিনিটে কাওরান বাজার এলাকায় প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের একটি চলন্ত মিনিবাস (ঢাকা মেট্রো চ-১১-০১৩৬) থামিয়ে আগুন দেয় পিকেটাররা। এ সময় ইন্স্যুরেন্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাসের ভেতরে ছিল। তারা বাসের পেছনে আগুন দেয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে দ্রুত নেমে যাওয়ায় কেউ হতাহত হয়নি। এদিকে দুপুর পৌনে ২টার দিকে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর আই হাসপাতালে পিকেটাররা একটি লেগুনায় (ঢাকা মেট্রো ছ-১৪-১২৩২) আগুন দেয়। এর পৌনে এক ঘণ্টা আগে দুপুর ১টার দিকে ধানমন্ডির শুক্রাবাদে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির সামনে হরতাল সমর্থনকারীরা একটি প্রাইভেটকারে (ঢাকা মেট্রো ফ-১২-০৪৯৯) আগুন দেয়। এর আধাঘণ্টা পর শুক্রাবাদে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি মাইক্রোবাসে আগুন দেয়। শেরেবাংলা নগর থানার সাব-ইন্সপেক্টর ইউসূফ আলী জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাইক্রোবাসটি সচিবালয়ে যাওয়ার সময় শুক্রাবাদ ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির সামনে হরতালকারীরা প্রথমে মাইক্রোটির গ্লাস ভাংচুর করে। পরে তারা এতে আগুন দেয়। তিনি জানান, খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। অন্যদিকে বিকেল সোয়া ৫টার দিকে গুলিস্তানের মহানগর নাট্যমঞ্চের সামনে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের উৎসব পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী গাড়িতে আগুন দেয় হরতাল সমর্থনকারীরা। তবে এসব ঘটনায় পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি। মোহাম্মদপুর থানার ওসি আজিজুল হক জানান, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আসাদ গেটসংলগ্ন মোহাম্মদপুর প্রি-পারেটরি স্কুলের সামনে ৩-৪ জন যুবক মিডওয়ে পরিবহনের একটি বাসে উঠে আগুন লাগায়। পরে ফায়ার সার্ভিস পৌঁছার আগেই স্থানীয় লোকজন ও বাস কর্মচারীরা বাসের আগুন নিভিয়ে ফেলে। এর আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ধানমন্ডি-২ নম্বর রোড এলাকায় একটি প্রাইভেটকারে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ধানমন্ডি থানার কর্তব্যরত কর্মকর্তা এএসআই নজরুল ইসলাম জানান, হরতাল সমর্থনকারী কয়েকজন মিলে পার্কিং করা প্রাইভেটকার আগুন দিলে লোকজন দ্রুত নিভিয়ে ফেলে। দুপুর একটার দিকে সিটি কলেজের পাশে স্টার কাবাব এ্যান্ড রেস্তরাঁর সামনে একটি মাইক্রোবাসে আগুন দেয়া হয়। তিনি জানান, চালক রেস্তরাঁর সামনে মাইক্রোবাস রেখেছিলেন। হঠাৎ ৩-৪ যুবক এসে পেট্রোল ঢেলে মাইক্রোবাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। তবে আশপাশের লোকজন রেস্তরাঁ থেকে পানি এনে দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলে। দুপুর পৌঁনে একটার দিকে বনানীর কামাল আতাতুর্ক এ্যাভিনিউ পোস্ট অফিস গলি থেকে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদল একটি মিছিল নিয়ে বনানী সুপার মার্কেট যায়। এ সময় তারা একটি প্রাইভেটকারে আগুন দেয় ও চারটি ককটেল বিস্ফোরণ করে। পুলিশ আসার আগেই তারা ঘটনাস্থল থেকে সরে যায়। এদিকে সন্ধ্যায় সাড়ে ৭টার দিকে নয়াপল্টন বিএপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি সিএনজিতে আগুন দেয় হরতাল সমর্থনকারীরা। এ সময় একটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
উল্লেখ্য, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সব নেতাকর্মীর মুক্তি ও তাদের নামে দেয়া মামলা প্রত্যাহার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল, হত্যা, গুম বন্ধ ও সব ক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায়ে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ১৮ দলীয় জোটের হরতাল শুরু হবে আজ থেকে। চলবে টানা দুদিন। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা হরতালের আগে নাশকতামূলক কর্মকা- চালিয়ে জনমনে ভীতির সঞ্চার করছে।