যৌন নির্যাতন বন্ধে সকলকে সোচ্চার হতে হবে
একটি বাস্তব ঘটনাঃ হতদরিদ্র পরিবারের ষোড়শী নারী রুনা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। ঘরে অসুস্থ মা ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বাবার ভিক্ষার অন্নের ওপর নির্ভরশীল রুণার ভরণপোষন। তাদের প্রতিবেশী গ্রাম্য মাতব্বর রহিম তালুকদারের কলেজ পড়ুয়া ছেলে রিপনের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে রুনার উপর। একদিন সন্ধ্যায় রুনা টেলিভিশন দেখার জন্য ওই প্রতিবেশী রহিম তালুকদারের বাড়িতে গিয়েছিল। সেখান থেকেই রিপন রুনাকে নানা লোভ দেখিয়ে ফসলের মাঠের দিকে ডেকে নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ করে। রুনার চিৎকার শুনে ওর ফুপাতো ভাই রহিম ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করে এবং চিনতে পারে ধর্ষক রিপনকে। সঙ্গে সঙ্গেই রুনাকে নিয়ে রহিম থানায় যায় অভিযোগ করতে। থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর কথা বলেন, কিন্তু উপজেলা হাসপাতালে নয়, ডাক্তারী পরীক্ষা করাতে হবে জেলা সদরে। সেদিন রাত হয়ে যাওয়ায় তাদের পক্ষে ৪০ কিলোমিটার দূরে জেনারেল হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পরদিন তারা যখন জেলা শহরের জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারী পরীক্ষা করাতে সক্ষম হয়, ততক্ষণে ধর্ষণের আলামত মুছে গেছে। অবশ্য নির্যাতনের শিকার রুনা ও তার পরিবারের লোকজন ডাক্তারী পরীক্ষার নেগেটিভ রিপোর্ট সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট থানার মাধ্যমে জানতে পারে ঘটনার ২ সপ্তাহ পর। এরপর আইনের মাধ্যমে এ সহিংসতার প্রতিকার পাওয়ার আর কোনো পথ খোলা থাকে না। একই সঙ্গে গরিব এ পরিবারটি একটি সচ্ছল পরিবারের কলেজ পড়–য়া যুবকের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে যাওয়ার ধৃষ্টতা দেখানোয় সামাজিকভাবে তিরস্কৃত হয়!
আইনের অপ্রতুলতাঃ নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হলে অপরাধ প্রমাণ করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর প্রমাণ হিসেবে ডাক্তারী পরীক্ষার সনদপত্রকে বিবেচনা করা হয়। সনাক্তকৃত আলামত অভিযুক্তের কি-না তা প্রমাণ করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে। বাস্তবে নারী ও শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনসহ অন্যান্য শারীরিক নির্যাতন প্রতিকারে মেডিকেল পরীক্ষার ব্যবস্থা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সহায়ক নয়। আইন বা রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা যথাযথভাবে পালিত না হওয়ার জন্যই নির্যাতিতরা ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে একদিকে যেমন বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে অপরাধীরা উৎসাহিত বোধ করে।
সামাজিক সীমাবদ্ধতাঃ মানব জাতির শুরু থেকেই নারী ধর্ষন সমস্যার জন্ম এবং ক্রমান্বয়ে তা বেড়েই চলেছে। আইনানুযায়ী ধর্ষণ, হত্যা, দূর্ঘটনার মামলা অথবা ছেলে বা মেয়ের বয়স নির্ধারণে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ থেকে সনদ নিতে হয়। আইনের চোখে এ সনদ গুরুত্বপূর্ণ দলিল। অনেকে মনে করেন, এ দলিল পেতে দ্বিতীয়বার ধর্ষণের শিকার হন নারী। গত ১৬ এপ্রিল ধর্ষণ ও ধর্ষিতার বয়স নির্ধারণের জন্য ফরেনসিক পরীক্ষা পুরুষ চিকিৎসক দিয়ে করানোকে কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের আদালত স্বত:প্রণোদিত হয়ে এ রুল জারি করেন। দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বাস্থ্যসচিব, ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচালক ও প্রিন্সিপাল, ফরেনসিক বিভাগের প্রধানকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ও ফরেনসিক বিভাগের প্রধানকে ২৮ এপ্রিল তলব করেছেন আদালত। বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে কোনো নারী চিকিৎসক নেই। কোনো নারী নার্স, এমনকি আয়াও নেই। অধ্যাপকসহ নয়টি চিকিৎসকের পদের একটিতেও নারী নেই। ১৫ বছর আগে বিভাগটি প্রতিষ্ঠিত হলেও এত দিনে পিয়ন পদে একজন নারী ছাড়া আর কোনো পদে কোনো নারীকে পদায়ন করা হয়নি। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ডিএমসি) ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে ধর্ষণের শিকার নারীর শারীরিক পরীক্ষা করেন পুরুষ চিকিৎসক। ওই চিকিৎসককে সহায়তা করেন পুরুষ ওয়ার্ডবয়। দেশের সবচেয়ে গৌরবময় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ধর্ষণের প্রমাণপত্র নিতে এসে নারীকে চরম লজ্জা আর অপমানের মুখোমুখি হতে হয় প্রায়ই।
দুর্নীতি এবং অনিয়মঃ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০০২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জারিকৃত পরিপত্রে ধর্ষণ কিংবা এসিড বা এ জাতীয় অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও ডাক্তারী পরীক্ষা সংক্রান্ত বিধান কার্যকর করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘পুলিশের রেফারেন্স ছাড়াও ধর্ষণ এবং অন্যান্য সহিংসতার শিকার কোনো নারী ও শিশু যে কোনো সরকারী স্থাপনায় কিংবা সরকার কর্তৃক এতদুদ্দেশ্যে স্বীকৃত কোনো বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্তব্যরত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তাৎক্ষণিকভাবে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে যথানিয়মে পরীক্ষা করবেন এবং মেডিকেল সার্টিফিকেট সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও নিকটস্থ থানায় প্রেরণ করাসহ, যাকে পরীক্ষা করবেন তাকেও ১ কপি প্রদান করবেন। চিকিৎসক ও তার ক্লিনিক্যাল সহকারীরা নির্যাতনের নারী বা শিশুকে যথাসাধ্য সেবা দেবেন।’ কিন্তু উপরে উল্লিখিত ঘটনা থেকে সহজেই অনুমেয়। এ নির্দেশনা মোটেই অনুসৃত হচ্ছে না। প্রথমত, নির্যাতনের শিকার কেউ হাসপাতালে গেলে থানার রেফারেন্স ছাড়া কর্তব্যরত ডাক্তার মেডিকেল পরীক্ষা করতে রাজি হন না। দ্বিতীয়ত, যাকে পরীক্ষা করছেন ‘তাকেও’ মেডিকেল সার্টিফিকেটের কপি কোনো অবস্থাতেই সরবরাহ করা হয় না। এর কোনো কারণই সুস্পষ্ট নয়। তৃতীয়ত, জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ছাড়া উপজেলা বা আর কোথাও এই পরীক্ষা করা হয় না।
নির্দেশনা কার্যকর করার কোনো পদক্ষেপ নেইঃ নির্যাতনের শিকার বা তার পরিবারে কারও হাতে মেডিকেল সার্টিফিকেট প্রদান করা কেন সম্ভব নয়- এ ধরণের প্রশ্নে ডাক্তারদের স্পষ্ট জবাব, আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবে?’ অর্থাৎ নির্যাতনের শিকার ডাক্তারী পরীক্ষার রিপোর্ট জেনে গেলে, তিনি ধরে নিচ্ছেন, সংশ্লিষ্ট ডাক্তার নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে যাবেন। তাহলে কে বা কারা এ ক্ষেত্রে ডাক্তারের নিরাপত্তার জন্য হুমকি, সেটাও স্পষ্ট হওয়া দরকার। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩২ ধারায় ষ্পষ্ট বলা আছে যে, ধর্ষিতা নারী ও শিশুর মেডিক্যাল পরীক্ষার ক্ষেত্রে ধর্ষণ সংঘটিত হবার পর যথাশীঘ্র সম্ভব তা সম্পন্ন করতে হবে এবং যথাশীঘ্র মেডিক্যাল পরীক্ষা না করলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও কথা বলা হয়েছে। এছাড়া আইন আরও বলা আছে, মেডিকোলিগ্যাল দায়িত্ব পালন করতে পারেন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগীয় কর্মকর্তা, জেলা হাসপাতালের আরএমও এবং মেডিকেল অফিসার ও নির্দিষ্ট কর্মকর্তা। সেক্ষেত্রে মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা করার যোগ্যতাসম্পন্ন ডাক্তার উপজেলা পর্যায়ে তো আছেই, এমনি অনেক ইউনিয়ন পর্যায়েও আছে। উপজেলা পর্যায়ে মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষার উপকরণও আছে। সুতরাং এ জাতীয় পরীক্ষা উপজেলা হাসপাতাল থেকে করে সার্টিফিকেট দিতে আইন বাধা তো নেই-ই, বরং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আছে। কিন্তু নির্দেশনা কার্যকর করার কোনো পদক্ষেপ নেই।
সরকারী হাসপাতাল গুলোর বাস্তব চিত্রঃ দেশের সরকারী চিকিৎসালয়গুলোতে, বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে, সাপ্তাহিক ছুটির দিন, অন্যান্য ছুটির দিন এবং কর্মদিবসগুলোতে দুপুর ২টার পর কোনো চিকিৎসক খুঁজে পাওয়া যায় না, মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা তো দূরের কথা। গ্রাম পর্যায়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে দূরত্ব, যানবাহন, অর্থ সংকট ইত্যাদি কারণে এবং বহুদূর থেকে জেলা সদরে এসে হাসপাতালে ডাক্তার অনুপস্থিত থাকার কারণে ডাক্তারী পরীক্ষা সময়মতো একেবারেই সম্ভব হয় না। ফলে স্বভাবতই নির্যাতিতা নারী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়, অপরাধ উৎসাহিত হয়।
আমাদের প্রত্যাশাঃ আমরা আশা করতে চাই, আইন, নীতিমালা, নির্দেশনা, অবকাঠামো ইত্যাদির সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনসহ সব ধরনের নির্যাতন বন্ধে ডাক্তার, পুলিশ সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন।
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।