অজ্ঞতার হেফাজত: প্রতিহিংসার রাজনীতি, বিপন্ন মানবতা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত

অজ্ঞতার হেফাজত: প্রতিহিংসার রাজনীতি, বিপন্ন মানবতা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত

সৈকত রুশদীঃ

অবরুদ্ধ ঢাকায় ধর্মের নামে সহিংসতা, নিপীড়ক রাষ্ট্রের প্রশাসন ও সম্পদকে দলীয় উদ্দেশ্যে নৃশংস ব্যবহার ও আলটিমেটামের নামে ক্ষমতালিপ্সার রাজনীতি ৫ ও ৬ মে যেভাবে ভুলুন্ঠিত করেছে মানবতা, সন্ত্রস্ত করেছে নাগরিক জীবন, ধ্বংস করেছে সম্পদ তা’ কেবলমাত্র ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় । বিয়াল্লিশ বছর পরে বিপরীত অবস্থান থেকে ধর্মের দোহাই দিয়ে পশ্চাদপদতার রোঁয়াব এবং তা’ মোকাবেলায় শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কৌশলের পরিবর্তে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করে রাতের অন্ধকারে পুলিশী হামলার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগের নৃশংসতায়  প্রায় একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে ক্ষোভে, দু:খে ও লজ্জায় অবনত হয়ে আসে বাংলাদেশের বাঙালি পরিচয় ! পক্ষপাতমূলক গণমাধ্যম ও কিছু সংবাদকর্মীর একপেশে আচরণ তাদের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে পরিচয়টিই শুধু বড় করে তুলে ধরেনি, পরিহারযোগ্য একটি সংঘাতকে উস্কে দিতে সহায়তা করেছে ।

অজ্ঞতাপ্রসূত ১৩-দফা দাবি কেন ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা ধর্ম নিরপেক্ষতা ভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশে আর গ্রহণযোগ্য নয়, কোন রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনকে তা’ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট করে তুলে ধরে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে দেখা যায়নি । চিন্তা, চেতনা, ধর্ম পালন  কিংবা  না পালন, বাক ও সমাবেশ করার স্বাধীনতা, প্রতিটি বাংলাদেশীর মৌলিক অধিকার । নব্য সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সদস্যদেরও । একই সাথে বাংলাদেশ শুধু মুসলমানের দেশ নয়, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, এমনকি নাস্তিকদেরও দেশ । সেখানে সব ধরনের অধিকার কেবল পুরুষ নয়, নারীদেরও সমান । সেই সহজ কথাগুলো হেফাজতে ইসলামের দাবি খন্ডনে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়নি ।

শাসক দল আওয়ামী লীগ হয় হেফাজতের অজ্ঞতার শক্তিকে ভয় পেয়েছিল, অথবা তাদেরকে তোয়াজের মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য বিপদের মাত্রা সম্পর্কে  চোখ বন্ধ রেখে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল এই শক্তির উত্থানের পরিণতি । ধর্ম নিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী দল হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ একটি ধর্ম ভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার প্রচারণা চালিয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের ভূমিকার কথা বলে, অথচ ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির সামগ্রিক বিপদ সম্পর্কে নিশ্চুপ থেকেছে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে । অসংগঠিত বিরোধী দল বিএনপি সেই স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকার জন্য নিন্দিত জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে হেফাজতের কর্মসূচীর ঘাড়ে বন্দুক রেখে, অপরিনামদর্শী ৪৮-ঘন্টার আলটিমেটামের ফায়দা লুটতে চেয়েছিল । পক্ষপাতহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা দেশের বেশিরভাগ মানুষের দাবি হলেও নিজেদের শাসনকালের নেতিবাচক রেকর্ডের কারণে সেই দাবিতে নেতৃত্বদানে উল্লেখযোগ্য জনসমর্থন পেতে ব্যর্থ দলটি হেফাজতের অবরোধ কর্মসূচীর উপর ভরসা করেছিল । আর আধুনিক শিক্ষা ও অগ্রসর চিন্তা-ভাবনা বঞ্চিত লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ভবিষ্যত কর্ম সংস্থানের অনিশ্চয়তায় যে ধর্মীয় উগ্রবাদের দিকে কিভাবে  ধাবিত হতে পারে, ৬ মে ভোরের  মতিঝিল তার জ্বলন্ত সাক্ষী !

হেফাজত ও পুলিশী তান্ডবে অন্তত:পক্ষে যে চার ব্যক্তির (অবশ্য বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পুলিশী আক্রমন ও হেফাজত সমর্থকদের তান্ডবে নিহত ও আহতের সংখ্যা অনেক বেশি বলে উল্লেখ করছে) অকাল মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে, সেই চার ব্যক্তিও  বাংলাদেশের নাগরিক । তাঁদের স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করা হয়েছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক ভাবে ।

কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার নেতাদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য পোষণকারী  এই হেফাজত সমর্থক দের প্রতি সরকারের নৃশংস নিপীড়ন, আস্তিক ও নাস্তিক ভিত্তিতে দেশকে বিভাজনের হেফাজতী দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করতে আগুনে ঘৃতাহুতি যোগাবে সন্দেহ নেই । হেফাজত সমর্থকদের ঢাকায় আসতে না দেওয়া অথবা ঘর থেকে বের হতে না দেওয়ার হুমকি পরিস্থিতিকে আরও বিস্ফোরন্মুখ করে তুলতে পারে । দুর্বল ব্যবস্থাপনায় ও পক্ষপাতমূলক আচরণে প্রশ্নবিদ্ধ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে সক্রিয় দল জামায়াতে ইসলামীও  সক্রিয় এই বিভাজন থেকে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে । নিপীড়ক রাষ্ট্র কিংবা  শাসক ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতৃত্বে, এমনকি কিছু গণমাধ্যমে এবং বেশিরভাগ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কোন দায়িত্বশীল ভুমিকা দেখা যাচ্ছে  না । শাসক দল ও সাম্প্রদায়িক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম উভয়েরই পেশী শক্তির ব্যবহারে বিপন্ন হচ্ছে মানবাধিকার । সংঘাত, সহিংসতা ও অবরুদ্ধ পরিবেশে লংঘিত হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের এবং শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের অধিকার ।

সাভারে ভবন ধ্বসে প্রায় এক হাজার কর্মরত শ্রমিকের মৃত্যু ও আরও তিন হাজার শ্রমিকের আহত হওয়ার ঘটনায় শোকাহত জাতি বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তার অভাবের কারণে সবচেয়ে বড় রফতানী আয় খাতের ভবিষ্যত অন্ধকার দেখতে পাচ্ছে  | যখন শাসক দলের একটি রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে বিরোধী দলকে সাথে নিয়ে একযোগে এই দুর্যোগময় পরিস্থিতি মোকাবেলায় কাজ করা প্রয়োজন, তখন  দেশবাসীকে দুই কিংবা তিনভাগে বিভক্ত করার প্রক্রিয়ায় তাদের উত্তুঙ্গ দেখা যাচ্ছে । ভিন্নমত প্রকাশে শুধু বাধা দেওয়া নয়, ভিন্নমত প্রকাশকারী রাজনীতিক, সম্পাদক ও ব্লগারদের ধরে বেঁধে, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে কারাগার থেকে হাসপাতালে শয্যাশায়ী করে ব্ফেলা হচ্ছে । বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে ভিন্নমতের গণমাধ্যম । সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে । পরস্পরের প্রতি রাজনৈতিক বিষোদ্গার ছাড়াও শ্লীলতার মাত্রা ছাড়ানো বক্তব্য দিয়ে ব্যক্তি বিশেষদের চরিত্রে  কালিমা লেপনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে !

প্রতীয়মান হচ্ছে, অজ্ঞতা কেবলমাত্র হেফাজতে ইসলাম নয়, শাসক দল সহ শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কিছু গণমাধ্যমকেও ভর করেছে । তারা শক্তি প্রয়োগ ও সহিংসতাকে উস্কে দিয়ে দেশের অপার সম্ভাবনাময় অর্থনীতি এবং নারীর ক্ষমতায়ন সহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অর্জিত অগ্রগতির সামনে যে অশনি সংকেত দেখা যাচ্ছে  তা সম্পর্কে অজ্ঞতার ভান করছে । রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বশীলতার পরিবর্তে একপেশে দৃষ্টি দিয়ে ঘটনাপ্রবাহ বিচারকালে দেশের ভবিষ্যত প্রশ্নে একটি চোখ বন্ধ রাখছে । কিন্তু অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ থাকেনা !


লেখকঃ সৈকত রুশদী: কানাডার টরন্টো’য় বসবাসকারী রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সম্পাদক, বেতার-টিভি ভাষ্যকার ও লেখক ।

টরন্টো, ৬ মে ২০১৩ ।।

অতিথি লেখক