সুস্থ রাজনীতি কাম্য
মীর আব্দুল আলীমঃ প্লিজ নেত্রীদ্বয় সংঘাতের এ পথ পরিহার করুন। এ পথ সঠিক নয়। আপনাদের একগুয়ে সিদ্ধান্তে আলোহীন অন্ধকার আর ভুল পথে চলছে বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী অন্ধকার থেকে আলোর পথে কি দেশকে ফিরিয়ে আনা যায় না? কর্দমাক্ত রাজনীতি আর সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে দেশকে উদ্ধার করা অবশ্যই সম্ভাব। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশর গণতন্ত্র আর বাঁচা-মরা নির্ভর করছে আপনাদের পরিচালিত দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ আর বিএনপির উপর। কিন্তু আপনারা কেউই সুস্থ রাজনীতি করছে বলে মনে হয়না। ক্ষমতার রাজনীতিই আপনাদেও কাছে মুখ্য বলে মনে হচ্ছে। তাই সম্প্রতি দলীয় নানা কর্মসূচি নিয়ে অগ্নিগর্ভ হচ্ছে রাজপথ। মরছে মানুষ; রক্তাক্ত হচ্ছে জনপথ; জ্বলছে গাড়ি,ব্যাংক, শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কেবল সম্পদই নষ্ট হচ্ছে না প্রতি দিনই দেশের ভাবমূর্তি ক্ষয়ে ক্ষয়ে নি:স্ব হচ্ছে। হোচট খাচ্ছে দেশীয় অর্র্থনীতি। ব্যবসা বণিজ্যে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। একদিকে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে বিএনপি মোল¬াতন্ত্রকে আঁকড়ে ধরেছে। আর আওয়ামী লীগ হেফাজত ইসলাম আর জামায়াতে ইসলামের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে নিজেরাই মোল্ল¬া সাজার প্রচেষ্টা করছে! তা না হলে ‘ব¬াসফেমি’ আইনের জবাবে ‘মদীনা সনদে’র কথা বলা হলো কেন? বিএনপি ক্ষমতার লোভে যুদ্ধাপরাধিদের বাঁচাতে মরিয়া। তারা কখনো ক্ষমতায় গেলেও হেফাজত ইসলামের ১৩ দফা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় জেনেও তাতে পূর্ণ সমর্থনের হেতু কি? ক্ষমতায় গেলে ১৩ দফা বাস্তবায়ন বিএনপির পক্ষে কি অদৌ সম্ভব?
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কোথাও কথায় কাজে মিল পাওয়া যাচ্ছে না। ক্ষমতায় টিকে থাকা আর ক্ষমতার লোভ আমাদের দলগুলোকে অন্ধ করে দিয়েছে। বোধ করি দলগুলো বিবেকবোধ হারিয়ে ফেলেছে। প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত লাশ দেখেও তাদের বিবেক জাগ্রত হচ্ছে না। যা হচ্ছে তা কেবল ক্ষমতার জন্যই হচ্ছে। জনসম্পদ, রাষ্ট্রিয় সম্পদ, দেশের অর্থনীতি, দেশের ভাবমূর্তি কোনটারই তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। এর আগেও দেশে এই চিত্র আমরা লক্ষ করেছি। এ জন্য সমরিক সরকার এবং ওয়ান-ইলেভেন এসেছিল জাতির জীবনে। ১/১১ এর সেই দুই বছরের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জেল-জুলুম-নির্যাতন সয়ে এলেও আজকের সরকার ও বিরোধী দল শিক্ষা নেওয়া দূরে থাক, সমঝোতার ধারেকাছেও আসেনি। সেবার বিএনপি ছিল একগুঁয়ে, আওয়ামী লীগ নিয়েছিল রাজপথে ফয়সালার পথ। এবার আওয়ামী লীগের সরকার একগুঁয়ে, বিএনপি নিয়েছে রাজপথে ফয়সালার পথ। সেবার বিএনপি পুলিশ দিয়ে বিরোধী দল দমনের পথ নিয়েছিল। এবার নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেবারও রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা ঠেকানো যায়নি। এবার ঠেকানো যাচ্ছে না। সমঝোতার বদলে সংঘাতের পথে হাঁটছে দেশের রাজনীতি। সব মহলে তাই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। শান্তি-সুস্থিতির মানদন্ডে কোন জমানাটা তুলনায় ভালো? আগেরটা; না এটা? তা নিয়ে অযথা কলহ বাড়িয়ে লাভ নেই। বাঙ্গালীর ভাগ্য যে পোড়খাওয়া তা সহজেই বলতে পারি। স্বস্থ্যি মেলেনা কখনই। আজ এ সমস্যাতো, কাল ওসমস্যা। দেশে দাঙ্গা-হাঙ্গা ফ্যাসাদ লেগেই থাকে বারমাস। এখনকার সমস্যাটা একটু জটিল। একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার গোটা দেশ। অন্যদিকে বিচার বানচাল করতে মরিয়া জামায়াত-শিবির। বিরোধীদল ক্ষমতা পেতে মরিয়া মরিয়া। অন্যদিকে নাস্তিক ব্লগারদেও শাস্তি সহ ১৩ দফা দাবি আদায়ে মরিয়ে হেফাজতে ইসলাম নাকে একটি সংগঠন। সরকারও এতে প্রতিহত করতে হেনো কাজ নেই যা করছে না। সবাই কিঞ্চিৎ বেশিই বেপরোয়া বলা যায়। এতে রাজনীতির প্রাঙ্গনটিও যথেষ্ট কর্দমাক্ত। উত্তাল। গত ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধকে ঘিওে যা ঘটে গেলো তা দেশের জন্য দুভাগ্যই বলা যায়। ধর্মগন্থ পোড়ানো থেকে শুরু কওে ব্যাংক, বুথ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান,ভবনে াাগুন দেয়া ভাংচুরসহ যে তান্ডব চালানো হয়েছে। তা রাজধানী ঢাকার ২শ’ বছরেরর ইতিহাসে তা কখনই ঘটেনি। তা কেবল দেশবাসী নয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনও তা দেখে হতভম্ব হয়ে পরেছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনিকে এ জন্য অগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে হয়েছে। ঘটেছে হতাহতের ঘটনা। কেবল হেফাজত কর্মি নয় নিয়ে সারাদেশে সেনা পুলিশ বর্ডারগার্ডসদস্যও নিহত হয়েছেন। সেদিন হেফাজত কর্মীরা নির্বিচারে ভাঙচুর ও অগ্নিকান্ড ঘটায়। তাদের দেয়া আগুনে পুড়ে যায় ফুটপাতের দোকানিদের সর্বস্ব; বিভিন্ন বইয়ের দোকান, এটিএম বুথ, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। নিজেদের ১৩ দফা দাবি আদায়ে গত ৫ মে রোববার ঢাকা অবরোধের নামে হেফাজতে ইসলাম রাজধানীর প্রবেশমুখসহ পল্টন, নয়াপল্টন, বিজয়নগর, বায়তুল মোকাররম ও মতিঝিলের শাপলা চত্বর জুড়ে যে নারকীয় তান্ড করেছে তা কোনভাবেই দাবি আদায়ের সুস্থ পন্থা বলে মনে হয়নি দেশবাসীর কাছে। হেফাজত একটি অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন। সেই সংগঠনের কর্মসূচি অনেকটাই রাজনৈতিক কর্মসূচির রূপ নিয়েছিল রবিবার। হেফাজতকর্মীদের তান্ড যেকোনো সময়ের সহিংসতাকে ছাড়িয়ে গেছে। জনগণের জানমাল এর আগে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হয় না।
রাজনীতিতে সমঝোতার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। অসহিষ্ণু রাজনীতি সংঘাতের পথে হাঁটছে। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া পরিষ্কার বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের বিষয়টি না আসলে সংলাপ সম্ভব নয়। সরকারও এ ইসুটি মানতে নারাজ। এঅবস্থায় রাজনীতিকে সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করাও কঠিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আদালতের দোহাই দিয়ে সংবিধান থেকে একতরফাভাবে সরকার মুছে দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, দলীয় সরকারের অধীনেই সামনের নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার অনড়। সংঘাত এড়াতে এ অবস্থা থেকে সরকারকে সরে আসা প্রয়োজন। পর্যবেক্ষক মহলও বলছে, সরকার ও বিরোধী দলের প্রতি পরস্পরের এবং সাধারণ মানুষের আস্থা প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত অন্তত আরও দু-তিন মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখা উচিত। সে যাই হউক,তত্বাবধায়ক সরকারের দাবি, যুদ্ধারাধিদের বিচার বাঞ্চালের নামে জামায়াত শিবিরের দেশজুড়ে তান্ডব, রাজনৈতিক দলর গুলোর অসহিষ্ণু সংলাপ, হেফাজতের কর্মসূচি দেশেকে এক অন্ধকারের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। ব্যবসাবানিজ্যে ইতোমধ্যেই টান পরেছে। এভাবে চলতে থাকলে বড়ধরনের অর্থনীতি মন্দায় পরবে দেশ। আর তা আম-জনতা সহজ দৃষ্টিতে দেখবে এ কথা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবা মানেই মূর্খামি। জনমানুষের নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এ বিষয়ে সব পক্ষের সংযম একান্তই প্রযোজন।সবার সুবিবেচনা ও সুমতি দেশ ও জাতিকে কঠিন সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে। দানবীয় কর্মসূচি, জানমাল আর সম্পদ নষ্টের কর্মসূচিসহ হরতালের কবল থেকে দেশকে রক্ষ করতে হবে। তা না হলে গণতান্ত্রিক শাসনের কান্না ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। দেশের অগ্রগতি পিছিয়ে যাবে। রাষ্ট্র শাসকদের এটা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে দেশে সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিবেশ দীর্ঘায়িত হলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ বিঘিœত হবে। শিল্প কারখানায় উত্তেজনা বাড়বে ও উৎপাদন কমবে। ব্যবসা বাণিজ্যের বিপুল ক্ষতি হবে। মানুষের স্বাভাবিক নিরাপত্তা প্রতিনিয়ত ভুলুন্ঠিত হবে। দেশে অপশাসনের সুযোগ অবারিত ও উন্মুক্ত হবে। মুলত রাষ্ট্র ও মানুষের কল্যাণেই রাজনীতি। কিন্তু দেশে বিরাজিত রাজনৈতিক পরিবেশ যদি সে কল্যাণকে বিকশিত করতে না পারে তবে সে রাজনীতি ব্যর্থতায় পর্যবশিত হবে। মানুষ এমন রাজনীতির প্রতি আস্থা হারাবে। একসময় প্রচন্ড বিদ্রোহে ফেটে পড়বে। তাই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের আত্মমর্যাদা রক্ষা ও দেশের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে সংঘাতের রাজনীতি পরিহার করে সুস্থ রাজনীতির পরশে দেশের মানুষের জীবন মানের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এখনই উপযুক্ত সময় একটি পথ বের করা। আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলের দু’নেত্রীকে বলতে চাই, কোন অবস্থাতেই ধ্বংষযঞ্জ আর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের দিকে বাংলাদেশকে ঠেলে দেয়া যাবে না। আপনাদেরকে আনেক বেশী সংযমী হতে হবে। আমরা বাঙ্গালীরা জানি, রাজনীতি মানেই ক্ষমতায় যাওয়ার এবং অনন্তকাল টিকে থাকার খেলা। এই খেলা বন্ধ হওয়া দরকার। বিরোধীদলের যেমন উচিত, সরকারের উচিত ‘জাতীয় সঙ্কট মোকাবেলা কমিটি’ গঠন করা; সংকট উত্তরনে আলোচনা করা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাই ধৈর্য ও বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকেরও দায়িত্ব চলমান নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। কোন ভাবেই নৈরাজ্য-সহিংসতা গ্রহনযেগ্য নয়। আমাদেও দায়িত্বশীল রাজনৈতিকদেও সদায় সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে।এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশী দরকার তা হলো আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্তরিক ভাবে সংলাপের বসা। ধ্বংস, নৈরাজ্য, উস্কানি ছেড়ে আলোচনায় বসুন। আর এর কোন বিকল্প নেই। গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব শুধু সরকারি দলের নয়। এ দায়িত্ব বিরোধী দলেরও। ১/১১ এর পরের কথা, জেলখানায় পাশাপাশি সেলে অবস্থান করে, দুই নেত্রী যদি নিজেদের বাসার খাবার ভাগাভাগি করে খেতে পারেন, তবে দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে দুই নেত্রী এক হতে পারবেন না কেন? আমরা মনে করি দ্রুত দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব, যদি সদিচ্ছা নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এগিয়ে আসে। আগামী নির্বাচন নির্দলীয় না অন্তবতীকালীন সরকারের অধীনে হবে, সে ব্যাপারে সরকারিও বিরোধীদলকে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। লোক দেখানো প্রস্তাব নয়, সংলাপের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকার অর্থবহ উদ্যোগ নেবে-এটাই সবার প্রত্যাশা।
(লেখক- মীর আব্দুল আলীম, কলামিষ্ট ও প্রেসিডেন্ট- লায়ন্স ক্লাব অব ঢাকা লিবার্টি)
e-mail-newsstore09@gmail.com