মুরগীর জীবন, মানুষের জীবন অথবা কুকুরের জীবন!
কানাডার আলবার্টা প্রদেশের চারুকলা ও নকশা বিষয়ক মহাবিদ্যালয়ে এক ছাত্র ক্যাফেটেরিয়াতে একটি জ্যান্ত মুরগী হত্যা করে রক্তাক্ত অবস্থায় তা একটি পাত্রে রেখে উপস্থাপন করে শিল্পকর্ম হিসেবে । নিষ্ঠুরতা শিক্ষণের কারণে ঐ কোর্সের প্রশিক্ষক একজন গুনী শিক্ষককে চাকুরীচ্যুত করেছে মহাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ । তবে যে ছাত্রটি এই ‘শিল্পকর্ম’টি উপস্থাপন করেছে, কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা জানা যায়নি । মহাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য এই পদক্ষেপের জন্য সমালোচিত হয়েছে ।
আর বাংলাদেশে ! ঐ মুরগীর জীবন যতোটা মূল্য পেয়েছে, মানুষের জীবন তার কানাকড়ি মূল্য পাচ্ছে না । প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকনমিস্ট-এর ভাষ্য মতে, সরকার বিরোধী আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়, ইসলামী শাসনব্যবস্থা চালুর দাবি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান সংশ্লিষ্ট সহিংসতায় ২০১৩ সালের প্রথম পাঁচ মাসে “কমপক্ষে ১৫০ জন” মানুষ নিহত হয়েছেন । তাঁরা সকলেই বাংলাদেশের নাগরিক । কেউ সহিংসতায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশ নিয়েছেন, কেউ চাকুরীগত কারণে সরকারী নির্দেশ অনুসারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার অভিযানে দায়িত্ব পালন করছিলেন, আবার কেউ স্রেফ দুই পক্ষের সহিংসতার শিকার হয়েছেন । এর মধ্যে ২৪ এপ্রিল সাভার ভবন ধ্বসে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতার কারণে প্রায় এক হাজার পোশাক শ্রমিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন । আহত হয়েছেন আরও প্রায় তিন হাজার । এই সকল হত্যাকান্ডের জন্য কী একজন মানুষও কোন বিচার বিভাগীয় অথবা উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত ও বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন এখন পর্যন্ত ? না । বরং আমরা দেখছি বাংলাদেশের শাসক ও বিরোধী দল, গণ মাধ্যম এবং প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন স্বাক্ষর মানুষদের একটা বড় অংশ এই সকল অনভিপ্রেত মৃত্যু ও হত্যাকান্ড নিয়ে পরপস্পরের উপর দোষ চাপাচ্ছে, মানুষের মৃত্যুর ঘটনা, হোক না সে একজন, চেয়ে মৃতের সংখ্যা নিয়ে যোগ-বিয়োগের ভুল ধরে পরস্পরকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করছে । কেউ কেউ এই সকল হত্যাকান্ডের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেদেরকে কোন এক পক্ষের সবচেয়ে বড় অনুসারীর তকমা দখলের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । আবার কেউ এই ধরনের মৃত্যু ও হত্যাকান্ডের আরও প্রয়োজন আছে বলে সোচ্চার দাবি জানাচ্ছে । আমাদের কোন গ্লানি নেই !
বাংলাদেশে সহিংসতা ও মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে যাঁরা অকালে প্রাণ হারিয়েছেন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন, তাঁদের জীবন আলবার্টা’র এই মুরগীর চেয়েও কী অধম ? তাঁরাও তো কারও সন্তান, ভাই অথবা বোন, বাবা তথবা মা !
মানুষের হত্যাকান্ডে মানুষের এই নিষ্ঠুরতার উল্লাসে অত্যন্ত বেদনাবিধুর হৃদয়ে সুনীলের সেই পংক্তিটি স্মরণ করছি আজ আবার,
“আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি
তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবার জন্য !”
[সৈকত রুশদীঃ কানাডার টরন্টো বসবাসকারী রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সম্পাদক, বেতার-টিভি ভাষ্যকার ও লেখক ।]