সুকান্ত একটি আধুনিক কাব্য ভাষার সৃষ্টি করেছেন
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ:
কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী, কিশোর সংগঠন কিশোর বাহিনীর সংগঠক সুকান্তর কবিতা আর জীবন তাই একাকার। মৃদুস¡রে, ধ্যানের ভঙ্গিমায় যে কবিতা লিখিত হয় তাও যেমন শিল; তেমনি উচকিত ভাষায় অস্তিত্ব নিংড়ে যে ভাষা ওঠে তাও শিল। সুকান্ত তা বোঝালেন। এমনকি ওই বয়সে, শে−ষের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন ঔপনিবেশিক ‘ইউরোপের উদ্দেশ্যে’, ‘ওখানে এখন মে-মাস তুষার-গলানো দিন/এখানে অগ্নি-ঝরা বৈশাখ নিদ্রাহীন;’ (ইউরোপের উদ্দেশ্যে)।
তরুণের আয়ুনাশের মতো অপচয় আর নাই। তরুণ কবির মৃত্যুর ক্ষতি তার চেয়েও বেশি। যেমন কিটসের মৃত্যু, যেমন ডিরোজিওর মৃত্যু। জীবন হিসেবে যতই অসম্পূর্ণ হোক, কৃতিত্বের বিচারে সুকান্তের কবিতা এক নতুন ধারার কবিতার সূচনা। সব কবিই যেন গোপনে তাঁর কবিতার ভেতরে রেখে যান নিজের বিদায়লিপি— এপিটাফ। সুকান্তও লিখেছিলেন, ‘চলে যাবতবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,… অবশেষে সব কাজ সেরে/আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে/করে যাব আশীর্বাদ, তারপর হবো ইতিহাস।’ আজ, সত্যিই তিনি ইতিহাস।
মার্কসবাদী সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা সাহিত্যের প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ কবি। পিতা-নিবারন ভট্টাচার্য, মা-সুনীতি দেবী। ১৯২৬ সালের ১৪ আগস্ট ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীটের মাতামহের বাড়ীতে তার জন্ম।। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়ায়। পিতা নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য কলকাতায় পুস্তক ব্যবসায় করতেন। সুকান্তের বাল্যশিক্ষা শুরু হয় কলকাতার কমলা বিদ্যামন্দিরে। পরে তিনি বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
দ্বিতীয় বিশ¡যুদ্ধ, তেতালি−শের মম্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। ১৯৪৪ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। সেই বছর আকাল নামক একটি সংকলনগ্রন্থ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স¡াধীনতার (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স¡তন্ত্র অবস্থান করে নেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উলে−খযোগ্য হলো: ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিলিসঙের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন।
সুকান্তের সাহিত্য-সাধনার মূল ক্ষেত্র ছিল কবিতা। সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, যন্ত্রণা ও বিক্ষোভ তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু। তাঁর রচনাকর্মে শ্রেণী সংগ্রাম, গণমানুষের আশা-আকাঙ্কার বাণীসহ শোষণহীন এক নতুন সমাজ গড়ার অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়েছে। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বৈপ−বিক ভাবধারাটি যাঁদের সৃষ্টিশীল রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, সুকান্ত তাঁদের অন্যতম। তাঁর কবিতার ছন্দ, ভাষা, রচনাশৈলী এত স¡চ্ছন্দ, বলিষ্ঠ ও নিখুঁত যে, তাঁর বয়সের বিবেচনায় এরূপ রচনা বিস্ময়কর ও অসাধারণ বলে মনে হয়। পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯৪৭ সালের ১৩ মে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
কবির চেহারা বুঝি এমন হয়? গালে হাত দিয়ে বসে, হাসি হাসি মুখ। ঠোঁটের ওপরে সদ্য গোঁফ ওঠা কালো রেখা। সুকান্তের এ ছাড়া আর কোনো ছবি আমরা পাইনি। তাঁকে চিনতে তাই সেই বিষণœ হাসিমাখা মুখের দিকেই আমাদের তাকাতে হবে। কিন্তু সেই মুখের গভীরে যেন আরও কার কার মুখচ্ছবি ভাসে। সেটা ছিল ক্ষুদিরাম-সূর্যসেনদের শহীদ হওয়ার যুগ। সেটা ছিল নজরুলের বিদ্রহী উত্থানের যুগ, নেতাজি সুভাষ বসুর ফেরার হওয়ার যুগ। চিরকালের বিপ−বীরা, চিরকালের শহীদেরা বুঝি এমনই হন। তাঁদের মুখে শান্ত, কোমল, অপাপবিদ্ধ সংকলের ছায়া। বুকের আগুনে সময়কে তাঁরা আরও শুদ্ধ করে দিয়ে যান। তাই তিনি লেখেন, ‘বিদ্রহ আজ বিদ্রহ চারিদিকে,/আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে’। তিনি চেয়েছেন বিদ্রহ, চেয়েছেন এই সমাজসংসারের খোল ও নলচে একত্রে বদলানোর দিন। মাত্র বিশ বছর দশ মাস বয়সে জরজর দেহ ফেলে চলে গেলেও অমর হয়ে গেছে তাঁর কবিতা। তাঁর আর ক্ষয় নেই। তাঁকে পাঠ করে সেই অবিনাশী আগুনের ছোঁয়া পাই। সেই আগুন যুগে যুগে জনপুঞ্জের ভেতর থেকে একটি একটি তরুণকে ইতিহাস ডাক পাঠায়। কেননা, তরুণই প্রথম টের পায় তার মুক্তিকে আটকে রাখে অন্যায়-অসম ব্যবস্থা। এখনো তরুণের মুখেই নায়কের আভা খোঁজে আমাদের সমাজ। তাই ইতিহাসের তরঙ্গ ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, নজরুল, সুকান্তদের তুলে নিয়ে যায়। তরুণের প্রাণের দাম ছাড়া পরিবর্তন আর সৃষ্টির বীজ কোথায় কবে উপ্ত হয়েছে?
কবিতা আর বিপ−ব এই এক জোড়া শালিক তাঁর রক্তের ভেতর ধুমিয়ে আলোবাদ্যির উৎসব জাগিয়েছিল। সময় কারও কাছে মাটির গভীরে উদ্ভিদের শেকড় ছড়ানোর মতো ধীর ও নিঃশব্দ। কিন্তু কারও কারও কাছে সময় দেখা দেয় ঝড়-বিজলি-বারুদের তীব্রতা আর গতি নিয়ে। সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর সময়কে সে রকম তীব্রতাতেই পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে, বাংলার দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ নর-নারী-শিশুর মৃত্যু সইতে হচ্ছে, ওদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ব্রিটিশবিরোধী ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের ঢেউ, চলছে তেভাগা আন্দোলন, ঘটছে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, দেশবিভাগের ধাক্কায় মানচিত্র কাঁপছে, মানুষ কাঁপছে, সমাজ ভাঙছে। সেই ভাঙাগড়ার মধ্যে কবির হূদয় স্থির থাকতে পারেনি। তাই লিখে যান, ‘ইতিহাস! নেই অমরত্বের লোভ,/আজ রেখে যাই আজকের বিক্ষোভ।’ (বিক্ষোভ, ঘুম নেই) সুকান্তের কবিতার চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা তাই কেবল তাঁর মনের চাঞ্চল্য নয়, সেটা তাঁর সময়েরই উত্তেজনা। তাঁর বয়সের বিবেচনা এখানে প্রধান নয়। ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রহের পটভূমিতে যেমন নজরুল তাঁর ‘বিদ্রহী’ কবিতা লেখেন, তেমনি সুকান্ত লেখেন তাঁর ‘ছাড়পত্র’, ‘আগ্নেয়গিরি’, ‘হে পৃথিবী’র মতো কবিতা। দুর্ভিক্ষের বাংলায় অভূতপূর্ব তাঁর সেই উপমা ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। ক্ষুধিত পাষাণ হয়ে যাওয়া মানুষের মনে এই কবিতা কেবল কবিতা নয়, প্রচণ্ড ক্ষোভ আর প্রতিবাদ থেকে উঠে আসা সত্যভাষণ। সুকান্ত তাই নিছক কবি নন, সময়ের কবি। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় সুকান্তের মধ্যে দেখেছেন ‘প্রতিশ্রুতি’ আর কবি বিষু দে দেখেছেন ‘পরিণতি’। কিন্তু যে জীবনাবেগ তাঁর কবিতার মধ্যে শরীরের ভেতর শিরা-উপশিরার মতো বইছিল তাকে পরিণতি আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বোঝা যাবে না, তা ‘ঘটনা’। বাংলা সাহিত্যে সুকান্তের আবির্ভাব তাই একটি ঘটনা যা একবারই কেবল ঘটে।
সময়ের বিষ শিবের মতো পান করে যিনি অমৃত ফলাচ্ছেন, অথচ মনের ভেতর তিনি একা। প্রেম হারিয়ে যাচ্ছে, অসুস্থ মা মারা যাচ্ছেন, দারিদ্র এমনভাবে ঘিরে ধরছে যে তিনি বন্ধুকে লিখতে বাধ্য হন, ‘কি করে ভুলি, দেহ আর মনে আমি দুর্বল: একান্ত অসহায় আমি? আমার প্রেম সম্পর্কে সম্প্রতি আমি উদাসীন। অর্থোপার্জন সম্পর্কেই কেবল আগ্রহশীল। কেবলই অনুভব করছে টাকার প্রয়োজন…একখানাও জামা নেই…অর্থের অভাবে কেবলই নিরর্থক মনে হচ্ছে জীবনটা। (সুকান্ত: জীবনকথা। সুকান্ত রচনাসমগ্র, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা) অথচ ইনিই সেই কবি, যিনি লিখেছিলেন, ‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,’। হ্যাঁ, সেই ঝুঁকি তিনি আমৃত্যুই নিয়েছিলেন। আর বরণ করেছিলেন জীবনের থেকে পাওয়া শ্রেষ্ঠ পুরস্কার: মৃত্যু। যক্ষায় ভুগে ভুগে, যেন পুড়ে পুড়ে শেষ হলো একটি আগুনের জীবন। ১৯২৬-এর ১৫ আগস্ট জন্মে ১৯৪৭ সালের ১৩ মে মৃত্যু তাঁকে ডেকে নিয়ে গেল। অথচ কী আশ্চর্য, মৃত্যুদিনে তাঁর প্রিয় শহর কলকাতায় চলছিল দাঙ্গা। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী পর্যায়ে সুকান্তের আবির্ভাব স্মরণীয়। কবিতার বিষয় ও বক্তব্যের বহুমাত্রিকতা একটি নতুন সম্ভবনার ইঙ্গিত দেয়। সুকান্ত ভট্টাচার্য এক বিদ্রহী কবির নাম। বুর্জোয়া রাজনীতির প্রভাব বলয় ভেঙ্গে নতুন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে নিবেদিত কবি সুকান্ত আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন, সমাজচেতনা ও মূল্যবোধ জাগরণে নিবেদিত থেকেছেন। স¡ল আয়ু কবি এই প্রিথিবীতের চলমান ঘটনা আর রাজনীততে সচেতন ছিলেন। কাব্যচর্চার সময় তাঁর খুব দীর্ঘ ছিল না। তাঁর কবিতা পাঠকের আগ্রহ সঞ্চার করেছে। গবেষকরা নতুন দিক ও বিষয়কে আবিষার করেছেন। কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়নি তাঁর কবিতা। প্রতিনিয়ত সুষমা ও ব্যঞ্জনায় পুষ্ট হয়ে মাধুর্যমন্ডিত হয়েছে । তিরিশের কবিদের কাব্যশক্তি পাঠককে আকৃষ্ট করেছিল। চলি−শে সুকান্তের কবিতায় উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। তিরিশের কবিরা মানবিক মূল্যবোধ ও আশা নিরাশার দোলাচলে আদোলিত হয়ে কবিতাকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখেছেন। কিন্তু সুকান্ত কবিতার জগতে প্রবেশ করে জীবনের সুন্দর দিক, পৃথিবীর রূপ রহস্য ও মানবিক কল্যাণ বন্দনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। জীবন দর্শনজাত তাঁর কবিতায় ব্যঙ্গ বিদ্রূপ, দেশীয় ঐতিহ্য ও সমাজ চেতনার উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। সুকান্ত একটি আধুনিক কাব্য ভাষার সৃষ্টি করেছেন। চলি−শের অন্য কবিদের থেকে তার স¡তন্ত্রতা তিনি গণমানুষের মুক্তি প্রণোদনা সৃষ্টিতে মগ্ন ছিলেন। তাঁর প্রতিবাদী কন্ঠ সমকাল ও ইতিহাসকে বন্দী করে রেখেছে।।
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।