জামায়াতের রক্ষাকবচ প্রথম আলো!

জামায়াতের রক্ষাকবচ প্রথম আলো!

প্রভাষ আমিনঃ আমার অবস্থা হয়েছে মেরিনা ইয়াসমিনের মত। একসময় চাকরি সূত্রে, বর্তমানে বৈবাহিক সূত্রে প্রথম আলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক। প্রথম আলো ভালো কিছু করলে প্রশংসার বানে ভেসে যান, কলার নেড়ে নেড়ে তা গ্রহণ করেন। আবার খারাপ কিছু করলে সবার সমালোচনার ঝাপটাটাও তাকে সইতে হয়। এই যেমন আমি প্রথম আলো কিছু করলে মেরিনা আপাকে ফোন করি। উনি চালাক মানুষ, বুঝে যান, ফোন ধরেই বলেন, আমি প্রথম আলোর কেউ না। আমাকে ফোন করছিস কেন।

আমার অবস্থাও তার মতই। একসময় দীর্ঘদিন প্রথম আলোতে কাজ করেছি। সেই সুবাদে প্রথম আলোর কিছু হলে অনেকেই আমাকে ফোন করেন। প্রশংসা-নিন্দা দুটিই জোটে। প্রথম আলোতে কাজ করেছি- শুধু এটুকু বললে মনে হয় কম বলা হয়। প্রথম আলোর গড়ে ওঠার কালে ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া বাকি পুরোটা সময় প্রথম আলোকেই দিয়েছি। ছুটি, ডে অফ বলে যে কিছু আছে, তখনও সেটা বুঝতাম না। স্ত্রী-সন্তানের সময়ও প্রথম আলোকে দিয়েছি। মেধার ঘাটতি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতাম সময়, আন্তরিকতা আর পরিশ্রম দিয়ে। কেউ যেন ভেবে বসবেন না, আমি নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করছি। আমি আসলে প্রথম আলোর খুব সামান্য একজন কর্মী ছিলাম। আজকে প্রথম আলো যে মহাসমূদ্রের নাম, আমার অবদান তাতে বড় জোর আধা ফোটা শিশির। স্ত্রী-সন্তানকে প্রথম আলোর কারণে বঞ্চিত করলেও তারা দুজনই আবার আমার মত প্রথম আলোর ভক্ত ও নিয়মিত পাঠক। ছেলে পড়ে খেলার পাতা, আর স্ত্রী মুক্তি তো আমার চেয়ে বেশি রাজনীতির অলিগলির খোঁজ রাখে। আমার স্ত্রী আসলে প্রথম আলোর আগে মতি ভাইয়ের ভক্ত, সেই সূত্রেই প্রথম আলো। প্রথম দেখায় মতি ভাই তাকে বলেছিলেন, আমি সবসময় বোনদের পক্ষে। যে কোনো সমস্যায় আমাকে জানাবেন। কথার কথা নয়, মতি ভাই তার প্রমাণও রেখেছেন।

আমি সংসদ অধিবেশন কাভারে ব্যস্ত থাকতে থাকতে মিরপুরের বাসায় গাড়ি পাঠিয়ে আমার অসুস্থ ছেলেকে ডাক্তার দেখিয়ে আবার বাসায় পাঠিয়েছেন। আমি কিছুই জানতে পারিনি। জেনেছি গভীর রাতে বাসায় ফেরার পর। এমন অনেক উদাহরণ আছে। প্রথম আলো ভালো কিছু করলে আমার স্ত্রী খুব খুশী হয়। বিশেষ বিশেষ আয়োজনে মুগ্ধ হয়ে একাধিকবার সে অফিসে গিয়ে মতি ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে এসেছে। মতি ভাইয়ের প্রতি আমারও ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সেটা এই পরিসরে লেখা সম্ভব নয়।

মতি ভাইয়ের প্রতি আমাদের পারিবারিক কৃতজ্ঞতা আছে, থাকবে। কিন্তু প্রথম আলোর প্রতি মুগ্ধতাটা বোধহয় আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। টুকটাক সমালোচনা, ফিসফাস ছিলই। বড় ধাক্কাটা খেয়েছি গত ১৪ এপ্রিল নববর্ষ সংখ্যায় হাসনাত আবদুল হাইয়ের উদ্দেশ্যমূলক গল্প ‘ক্যামেরার সামনে মেয়েটি’ পড়ে। ছোটগল্প হিসেবে ছাপা হলেও হাসনাত আবদুল হাইয়ের লেখাটিকে আমার কাছে গল্প মনে হয়নি। আমি ভুলও হতে পারি। অত বড় লেখকের সাহিত্য বিচারের যোগ্যতা হয়তো আমার নেই। কিন্তু যারা বিচারের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেননি। সবাই হাসনাত আবদুল হাই নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন বলে পার পেয়ে গেছেন অদিতি ফাল্গুনী। একই সংখ্যায় ‘উন্মাদিনী কাল’ নামে তারও একটি গদ্য ছাপা হয়েছে। সেটিকেও ছোটগল্প বলে দাবি করা হয়েছে। আমি জানি না এই সময়ে ছোট গল্পের সংজ্ঞা বদলে গেছে কিনা। যে কোনো হিজিবিজি লিখে ওপরে পরিচিত লেখকের নাম দিয়ে দিলেই কী তা গল্প হয়ে যায়?

তবে এই ক্ষেত্রেও আমার ভুল হতে পারে। বিখ্যাত সাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদার এবং তার ভাবশিষ্য আমার বন্ধু রোকন রহমান- এই দুজনের গদ্যই আমার মাথায় ঢোকে না, মাথার অনেক ওপর দিয়ে যায়। হয়তো অদিতি ফাল্গুনীর গল্পটিও তেমন উচ্চমার্গের, আমার মাথার ওপর দিয়ে গেছে। নয়তো অতি নিম্নমার্গের, প্রথম আলো কেন বাংলাদেশের কোনো পত্রিকাতেই এটি ছাপা হওয়ার যোগ্য নয়। আমার পক্ষপাত নিম্নমার্গের দিকে। যদি উচ্চমার্গেরও হয়, তাও তা প্রথম আলোতে ছাপা ঠিক হয়নি। প্রথম আলো তো আমাদের মত আম পাঠকের জন্য, এটি তো শাহবাগ থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন নয়। আমপাঠক বুঝবে না, এমন একটি গল্প প্রথম আলোর মত বহুল প্রচারিত দৈনিক ছাপবে কেন? সমস্যা কিন্তু গদ্য দুটির সাহিত্য মূল্য নিয়ে নয়। সমস্যা হলো উদ্দেশ্যে। একই সংখ্যার দুটি গল্পে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের চেতনায় আঘাত করা হয়েছে, অপমান করা হয়েছে, হেয় করা হয়েছে। হাসনাত আবদুল হাই নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠার পর তার গল্প নামের নোংরা গদ্যটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। আর প্রথম আলো নামকাওয়াস্তে ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে গেছে। কিন্তু চোখের আড়ালে থাকা অদিতির নোংরাতম গদ্যটি রয়েই গেছে। তারমানে সেটি প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যায়। তারমানে পরিস্কার সম্পাদকীয় নীতি টিতি কিছু না, প্রথম আলো শক্তের ভক্ত। চাপে পড়েই হাসনাত আবদুল হাইয়ের গদ্যটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঠিকমত চাপ দিতে পারলে অদিতিরটাও প্রত্যাহার করা হতো। শাহবাগীরা নিছক ‘গান্ধিবাদী’ বলে সে যাত্রায় বেঁচে গেছে প্রথম আলো। নইলে একই সংখ্যায় একটি চেতনাকে আঘাত করে দুটি গদ্য ছাপা কাকতালীয় তো নয়ই, অসাবধানতাও হতে পারে না।

এটি অবশ্যই পরিকল্পিত, আমার ধারণা দুই লেখককেই এসাইনমেন্ট দিয়ে লেখানো হয়েছে। হাসনাত আবদুল হাই ইস্যুর পর আমি ‘গরু মেরে জুতো দান’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম। পড়ে অনেকেই বলেছেন, ভাই আপনি প্রথম আলোর পেছনে লেগেছেন কেন? তাদের বলেছি, আমি প্রথম আলোর পেছনে লাগিনি, পাশে দাঁড়িয়েছি। সমালোচক দুই কিসিমের- বন্ধু সমালোচক, শত্রু সমালোচক। আমি বন্ধু সমালোচক। আমি প্রথম আলোর ভুলটা ধরিয়ে দিতে চাই। কোনটা ভুল, কোনটা অপরাধ; কোনটা অসাবধানতা, কোনটা ইচ্ছাকৃত- তা ধরিয়ে দিতে চাই। প্রথম আলোতে যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেই ফোন করে আমার সেই লেখার প্রশংসা করেছেন। কিন্তু চাকরি করেন বলে তা প্রকাশ্যে বলতে পারেননি। এমনকি মতি ভাই যখন সবার নাম পাল্টে দিলেন (ডাক নাম বা নামের শেষাংশ কর্তন), চাকরির মায়ায় তখনও তারা কিছু বলতে পারেননি। তাদের দোষ দেই না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি মতি ভাইয়ের মুখের ওপর কিছু বলা প্রায় অসম্ভব। আমি যখন চাকরি করেছি, তখনও মুখ বুজে অনেক অন্যায় সয়েছি। তাই তো প্রথম আলো আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় হলেও, প্রথম আলো ছাড়ার পরই সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি। বাবা-মায়ের কড়া শাসন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ওঠার স্বাধীনতার মত। আমার ধারণা একই অনুভূতি প্রথম আলোর সকল সাবেক সহকর্মীদের।

যেটা বলছিলাম, প্রথম আলোর বর্তমান কর্মীরা না পারলেও আমরা যারা সাবেক কর্মী তাদের প্রথম আলোকে ঠিক পথে রাখার চেষ্টা করে যেতে হবে। ধান ভানতে অনেক লম্বা শিবের গীত গাওয়া হলো। এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। যে ধাক্কা দিয়ে বছর শুরু হয়েছিল, এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তার চেয়েও বড় ধাক্কা দিলো প্রথম আলো। এবার গল্প নয়, জনমত জরিপ আকারে। গত ১১ মে প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট পরিচালিত জরিপের ফলাফল ছাপা হয়েছে পত্রিকাটির প্রথম পাতায়। প্রথম আলো প্রায় নিয়মিত জরিপ করে। বাংলাদেশে জরিপ নিয়ে নানান গল্প চালু আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বসে শত শত জরিপের ফরম পূরণ করার অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। তবু আমি ওআরজি-কোয়েস্ট পরিচালিত জরিপের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। আমি ধরেই নিচ্ছি তারা ৩ হাজার ব্যক্তির কাছেই গেছে প্রশ্ন নিয়ে। আমার আপত্তি প্রথম আলোর হঠাৎ জরিপের উদ্দেশ্য নিয়ে, নির্ধারিত প্রশ্ন নিয়ে। দেশ যখন সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে জটিল এবং সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে, তখন এমন একটি উদ্দেশ্যমূলক জরিপ সে সঙ্কটে নতুন প্যাচ তৈরি করবে শুধু। সাধারনত সরকারের বর্ষপূর্তি বা বছরের শুরুতে বা কোনো নির্বাচনের আগে জরিপ করা হয়। কিন্তু হঠাৎ ৯-২০ এপ্রিল জরিপ করে তা ১১ মে ছাপতে হবে কেন?

প্রিয় পাঠক, একটু খেয়াল করে দেখেন প্রথম আলোর এই জরিপ পরিচালিত হয়েছে ৯-২০ এপ্রিল আর হাসনাত আবদুল হাই ও অদিতি ফাল্গুনীর গল্প ছাপা হয়েছে ১৪ এপ্রিল। তারমানে জরিপ আর নববর্ষ সংখ্যা- দুটির পরিকল্পনা হয়েছে একই সময়ে। হয়তো এক টেবিল থেকে, হয়তো এক মাথা থেকে। টার্গেট খুব পরিস্কার- শাহবাগের চেতনাকে ধ্বংস করে দাও। শুরু থেকেই প্রথম আলো শাহবাগের বিরুদ্ধে। প্রথম দিন মানে ৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম পাতায় কাদের মোল্লার ‘ভি’ চিহ্নের ছবি আর দুই কলামে শাহবাগের প্রতিবাদের কথা ছেপে অনেক নিন্দা কুড়িয়েছে প্রথম আলো। সেদিন শাহবাগে অনেকে প্রথম আলো পুড়িয়েছে, পাড়িয়েছে। পরে কর্মীদের চাপে আর অংশগ্রহণের সংখ্যাধিকের কারণে প্রথম আলোতে শাহবাগ কিছুটা গুরুত্ব পেয়েছে। আসলে এত বড় জনসমাবেশ উপেক্ষার উপায়ও ছিল না। যদিও এই প্রথম কোনো ইস্যুতে প্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকাগুলো প্রথম আলোর চেয়ে এগিয়ে ছিল। শাহবাগকে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি প্রথম আলো রাস্তা আটকে গণজাগরণ মঞ্চ করা, হাসপাতালের রোগীদের অসুবিধা নিয়ে রিপোর্ট করতেও ছাড়েনি। প্রথম আলো বলতে পারে, আমরা কাউকে ছেড়ে কথা কই না। সত্য বলতে ভয় পাই না। কিন্তু এটা কী সব ক্ষেত্রে সত্যি? প্রথম আলোর বেশির ভাগ কর্মীকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাদের ৯৯ ভাগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। প্রথম আলোর অনেকের সঙ্গে রাত চারটার সময় শাহবাগে আড্ডা মেরেছি, অনেকে অফিস সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময়টা শাহবাগেই কাটিয়েছেন। তাহলে প্রথম আলো শাহবাগের বিরুদ্ধে লাগলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। অনেকে অনেক কথা বলেন। প্রথম দিনের পোড়ানো-পাড়ানোর একটা ক্ষোভ তো থাকতেই পারে। তবে আমার কাছে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে, প্রথম আলো ছাড়াই যে বাংলাদেশে ভালো একটা কিছু হতে পারে তা দেখিয়ে দিয়েছে শাহবাগ। আর তাতে আঘাত লেগেছে প্রথম আলোর অহং-এ। আমি নিশ্চিত শাহবাগীরা যদি মতি ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে আন্দোলন শুরু করতেন। আর যদি আন্দোলনের নাম হতো ‘গ্রামীণফোন-প্রথম আলো গণজাগরণ মঞ্চ’ তাহলেই আর সমস্যা থাকতো না।

কিন্তু শাহবাগে যে স্বতস্ফুর্ত গণজাগরণ হয়েছে তাতো কোনো দলের নয়, কোনো একটি পত্রিকার নয়; গোটা দেশের। সারাবিশ্বের সকল বাঙালির ঘরে ঘরে পৌছে গেছে শাহবাগের ডাক। মতি ভাই ৬৯এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০এর গণ আন্দোলনের মাঠের সৈনিক। কিন্তু ২০১৩এর গণজাগরণে তাকে এক সেকেন্ডের জন্যও দেখিনি। কেন? এমন তো নয় মতি ভাইয়ের অনেক বয়স হয়ে গেছে কোথাও যান না। বরং পত্রিকার স্বার্থে অনেক অগুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও তাকে যেতে দেখি। মতি ভাইদের গণ অভ্যুত্থান অনেক মহৎ ছিল। গণ অভ্যুত্থানের বছর জন্ম বলে আমি অনেক গর্ব করি। কিন্তু তাই বলে আমাদের নতুন প্রজন্মের গণ জাগরণের মহত্বও তো কম নয়, অন্তত মতি ভাইয়ের না যাওয়ার মত অত খারাপ না।

প্রথম আলোর শাহবাগের বিরোধিতা করার আরেকটা যৌক্তিক কারণ আছে। প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ সার্কুলেশনের হিসাবটা খুব ভালো বোঝেন। তাই তো তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক নাম্বার। কিন্তু শাহবাগের গণজাগরণ শুরুর পর প্রথম আলোর সার্কুলেশন কমে যায়, বেড়ে যায় আমার দেশের সার্কুলেশন। তাই তো সার্কুলেশন পুনরুদ্ধারের জন্য আমার দেশ বেঁচে থাকলে যা যা করতো তার সবই করছে প্রথম আলো। ভালো তো, ভালো না?

হায়, সার্কুলেশনই কী সব। আদর্শ, চেতনা বলে বুঝি কিছু কি থাকতে নেই?!

আবার আসি জরিপ প্রসঙ্গে। সারাবিশ্বেই জরিপ হয়। তার অনেককিছু কাছাকাছি মিলেও যায়। কিন্তু জরিপের আবার একটি হাস্যকর দিকও আছে। যেমন মেরিল-প্রথম আলো তারকা জরিপ। একসময় এই জরিপ ইভেন্টের বাধা রিপোর্টার ছিলাম আমি। কে প্রথম হবে, সেটা জানতে দারুণ কৌতুহল নিয়ে বসে থাকতাম। এখন অবশ্য তারকাদের খোঁজ নেয়ার খুব একটা সময় পাই না। পেলেও মেরিল-প্রথম আলো জরিপে কে প্রথম হবেন তা নিয়ে কৌতুহল দেখাবো না। কারণ আমি বিশ্বাস করি এটা পূর্ব নির্ধারিত। না না পাঠকের ভোট নিয়ে কারচুপি হয়, এমন নয়। কে প্রথম হবেন, সেটা আপনিও জানতে পারবেন যদি পুরস্কার ঘোষণার আগের কয়েক মাসের প্রথম আলোর আনন্দ পাতা ফলো করেন। প্রথম আলো কাকে প্রথম বানাবে, তা ঠিক হয়ে যায় আগেই। তারপর চলে আনন্দ পাতায় তার ব্যাপক কাভারেজ। পাঠক মুগ্ধ হয়ে যান, সেই তারকার নানা গুণের কথা জেনে, চমৎকার সব ছবি দেখে। প্রথম আলোর পাঠকদের তাই মানসিকভাবে অন্য কাউকে ভোট দেয়ার সুযোগ থাকে না। তাই পাঠকদের ভোটও যেমন সত্যি, আবার প্রথম আলোর পূর্ব নির্ধারিত তারকার পুরস্কার প্রাপ্তিও সত্যি। তবে রাজনৈতিক জরিপের ক্ষেত্রে বিষয়টি অত সহজ নয়। তবু জরিপ থেকে আপনি কী ফলাফল চান, সেটা আগেই ঠিক করে রেখে; সম্পুর্ণ সততার সঙ্গে জরিপ চালিয়েও সেই ফলাফলই তুলে আনা সম্ভব। আপনি কী উত্তর চান প্রশ্নটা সেভাবে করলেই পেয়ে যাবেন কাঙ্খিত উত্তর। অনেক সময় প্রশ্নেই লুকিয়ে থাকে উত্তর। আপনি কী এখনও আগের মত বউ পেটান? এই প্রশ্নের উত্তর কী।

আমি বিশ্বাস করি ওআরজি-কোয়েস্ট ৩ হাজার লোকের কাছেই গেছে। প্রথম আলোর রিপোর্টে বলা হয়েছে ৩০টি জেলা শহর ও গ্রামের ৩ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর জরিপ চালানো হয়েছে। এই ৩ হাজার মানুষের মধ্যে ৫০১ জন (১৬.৭ ভাগ) মানুষ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন সম্পর্কে কিছুই জানেন না। শাহবাগের পক্ষে থাকতে পারেন, বিপক্ষে থাকতে পারেন, নিশ্চুপ থাকতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে বাস করে শাহবাগ সম্পর্কে কিছু জানে না, এমন এলিয়েনদের ওপর চালানো জরিপের ফল প্রথম আলো প্রথম পাতায় বড় করে ছাপবে, আর প্রতিক্রিয়াশীলরা সেই জরিপ নিয়ে নিয়ে উল্লাস করবে। হায় জরিপ, হায় প্রথম আলো।

আমার কাছে টাকা থাকলে আমি এই ওআরজি-কোয়েস্টকে দিয়েই ৬ হাজার লোকের ওপর একটি জরিপ করাতাম। আমার প্রশ্ন থাকতো দুটি: ১. আপনি কী মনে করেন, হাসনাত আবদুল হাইয়ের গল্প ছেপে প্রথম আলো অপরাধ করেছে এবং এই অপরাধে দায়ী ব্যক্তির শাস্তি হওয়া উচিত? ২. আপনি কী মনে করেন জামায়াতকে বাঁচাতে জরিপ করে প্রথম আলো অপরাধ করেছে এবং এই অপরাধে দায়ী ব্যক্তির শাস্তি হওয়া উচিত? আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি ৮০ ভাগ লোক ‘হ্যা’ উত্তর দেবে। আর আমি শিরোণাম করবো ‘দেশের ৮০ ভাগ লোক প্রথম আলোর শাস্তি চায়।‘

সত্যি আমি বিশ্বাস করি, প্রথম আলো জামায়াতকে বাঁচাতেই এই জরিপ করেছে। জরিপে মোট ৯টি প্রশ্নের একটি ছিল ‘জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি কি নিষিদ্ধ করা উচিত?’ ৬৪.৮ ভাগ লোক জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে! ১৬ কোটি মানুষের দেশে ৩ হাজার মানুষের (তাদের মধ্যে আবার ৫০১ জন এলিয়েন আছেন) ওপর জরিপ চালিয়ে আপনি ফলাফল দেবেন, ৬৪.৮ ভাগ মানুষ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে। এটা হওয়া উচিত না। প্রথম আলোর স্লোগান হলো ‘যা কিছু ভালো তার সঙ্গে প্রথম আলো। ‘দেশের ৬৪.৮ জামায়াতকে ভালো বলেছে, প্রথম আলো নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে থাকবে। জামায়াতের এখন অস্তিত্বের সঙ্কট। তাদের শীর্ষ নেতারা সবাই জেলে। দুজন ফাঁসির রায় নিয়ে কনডেম সেলে দিন গুণছে। একজনের যাবজ্জীবনের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। বাকিদের বিচার চলছে। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে জোরেসোরে। সংগঠন হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকায় জামায়াতের বিচারের আইনী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই সময়ে প্রথম আলোর মত বহুল প্রচারিত একটি দৈনিকের কাছ থেকে এত বড় একটি সার্টিফিকেট তাদের কাছে লাস্ট লাইফলাইন হিসাবে বিবেচিত হবে।

অনেকে বলছেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে, দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করবে, এই আশঙ্কায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেক মানুষও চায় না, জামায়াত নিষিদ্ধ হোক। অকাট্য যুক্তি। কিন্তু ভাই জামায়াত গত কয়েক মাসে দেশজুড়ে যে তাণ্ডব করেছে, আন্ডারগ্রাউন্ডে গেলে এরচেয়ে বেশি আর কি করবে। বাংলাদেশে এর আগে কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি কি এরচেয়ে বেশি তাণ্ডব করেছে? জামায়াত ভয় দেখাচ্ছে, আর সেই ভয়ে কাবু হয়ে তাদের পক্ষ নিয়ে নিতে হবে? ব্যথা লাগবে সেই ভয়ে কী অপারেশন না করে ক্যান্সারের পিণ্ড শরীরে বয়ে বেড়াবো? যে জরিপের ৬৪.৮ ভাগ মানুষ জামায়াতের পক্ষে সে জরিপের বেশিরভাগ মানুষ তো শাহবাগের বিপক্ষে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মাত্র ৫৭.৫ ভাগ মানুষ শাহবাগের বিপক্ষে কেন? জামায়াতের পক্ষের ৬৪.৮ ভাগের সবারই তো শাহবাগের বিপক্ষে থাকার কথা। মাঝখানের এই ২১৯ এলিয়েন কোত্থেকে এলো যারা জামায়াতের পক্ষে কিন্তু শাহবাগের বিপক্ষে না। হা হা হা।

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি খুব খারাপ, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি, যুদ্ধাপরাধের রায় পরবর্তী পরিস্থিতি সরকার মোকাবিলা করতে পারেনি- এ সবই তো বাস্তবতা। আওয়ামী লীগ সরকারের এই ব্যর্থতা চিহ্নিত করতে জরিপ করা লাগে না। সবাই দেখছে। কিন্তু প্রথম আলোর আসল লক্ষ্য তো জামায়াতকে বাঁচানো। তাই বাকি ডামি প্রশ্নগুলো আনা হয়েছে। সবসময়ই এটা নিয়ম- মূল লক্ষ্যকে ঠিক রাখতে আপনাকে অনেক কৌশলে অনেক ক্যামোফ্লেজ তৈরি করতে হবে। যুদ্ধাপরাধের রায় পরবর্তী পরিস্থিতি সরকার মোকাবেলা করতে পেরেছে কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে ৮১.১ ভাগ মানুষ বলেছে, পারেনি। আসলে ৯৯ ভাগ মানুষের বলা উচিত ছিল পারেনি। এক্ষেত্রে তো সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের কোনো প্রস্তুতিই ছিল না। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের রায়ের পর জামায়াত-শিবির যা করেছে তা সমর্থন করেন কিনা এমন প্রশ্ন কিন্তু জরিপে ছিল না। কারণ চালাক প্রথম আলো জানে এমন একটি প্রশ্ন করলে জামায়াতের বিপক্ষে রায় চলে আসবে।

আচ্ছা, জরিপের ফলাফল হাতে পাওয়ার পর যদি প্রথম আলো জামায়াতের রাজনীতি আর শাহবাগের আন্দোলনের প্রশ্ন দুটি চেপে যেতো, তাহলে তাদের কী ক্ষতি হতো। আমরা তো কেউ গিয়ে তাদের গলা চেপে ধরতাম না, কেন তোমরা জরিপে কারচুপি করলে? কারণ আমরা তো জানিই না কী প্রশ্নে জরিপ হয়েছে। বা এই দুটি পশ্ন না রাখলেই কী হতো। প্রথম আলো বলতে পারে, বর্তমান সময়ের আলোচিত এই দুটি প্রসঙ্গ বাদ দেয়া সম্ভব ছিল না। তাহলে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা জরিপে নাই কেন? জরিপ পরিচালিত হয়েছে ৯-২০ এপ্রিল। আর হেফাজত ১৩ দফা দিয়েছে ৫ এপ্রিল। তাহলে জরিপের আগে সর্বশেষ সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টিই জরিপে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। কেন? কারণ প্রথম আলো জানে, ৯০ ভাগ লোক যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে, তেমনি ৯০ ভাগ লোক ১৩ দফার বিপক্ষে হবে। প্রথম আলো হয়তো হেফাজতে ইসলামের বিপক্ষে গিয়ে সার্কুলেশন খোয়াতে বা বায়তুল মোকাররমে গিয়ে মাফ চেয়ে আসার মত পরিস্থিতিতে আর পরতে চায় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গ যখন এলই তখন ছোট্ট একটা ভবিষ্যদ্বাণী করে রাখি। মিলে গেলে কেউ কাউসার আহমেদ চৌধুরী ভেবে আমার কাছে হাত দেখাতে আইসেন না যেন। জরিপে দেখা গেছে, ৯০ ভাগ লোক তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। তার মানে, হয় দেশের ৯০ ভাগ লোক আওয়ামী লীগের বিপক্ষে অথবা আওয়ামী লীগারদের অনেকেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান। হতে পারে। সবাই যেভাবে বর্তমান সঙ্কটের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুপস্থিতিতে দায়ী করছেন, তাতে বেশিরভাগ লোক এর পুনর্বহাল চাইতেই পারেন। কিন্তু ছোট মুখে বড় কথা হলো, ৯০ ভাগ লোক চাইলেও আগের স্টাইলের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর ফিরে আসবে না বাংলাদেশে। তাই বলে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেও নির্বাচন হবে না।

আগের লেখায় লিখেছিলাম, ফরহাদ মজহারের ভাবশিষ্যরা প্রথম আলোর সাহিত্য পাতার ভাবগুরু। এখন দেখছি শুধু সাহিত্য পাতা নয়, গোটা প্রথম আলোকেই গিলে খেতে চাইছে সেই অশুভ চক্রটি। যার হাত দিয়ে হাসনাত আবদুল হাই আর অদিতি ফাল্গুনীর নোংরা গদ্য ছাপা হয়েছে, তার নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত হয়েছে এই জামায়াতি জরিপ। জরিপের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে এমন সংশয়পূর্ণ অবস্থা তৈরি হয় যে জরিপের পটভূমি ব্যাখ্যা করতে হয়েছে, পত্রিকার শীর্ষস্থানীয় একজনকে। তিনি আবার বিভিন্ন টেলিভিশনে ঘুরে ঘুরে সেই জরিপের যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করেন। না হয় জামায়াতের এসাইনমেন্টেই জরিপটি হয়েছে। তাই বলে যেই জরিপে ৬৪.৮ ভাগ মানুষ জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হোক তা চায় না, সেই জরিপের পক্ষে আবার সাফাইও গাইতে হবে? মানুষের লজ্জা, ঘেন্না জাতীয় অনুভূতিগুলো কি উঠে গেলো নাকি। কেউ কেউ বলছেন, আগেরবার মহা অপরাধ করেও শুধু ক্ষমাতে পার পেয়ে যাওয়ায় অপরাধীরা সাহস পেয়ে গেছেন। তারা বুঝে গেছেন অহিংস শাহবাগীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াতে কোনো ঝূঁকি নেই। তাই তারা এবার আরো বড় অপরাধ করেছেন। ভবিষ্যতে হয়তো আরো করবেন। তবে তাদের কাছে হয়তো জামায়াতের পক্ষে অবস্থান নেয়াটা অপরাধ নয়, গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম আলোর জামায়াতের পক্ষে দাঁড়ানোটা এক ধরনের অপরাধই। প্রথম আলো বড় পত্রিকা, বিশ্বজুড়ে তার পাঠক। সেই পাঠককে প্রভাবিত করার জন্য নানা আয়োজনও করেন তারা। তাই তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেক সোচ্চার বন্ধুকে জানি যারা ফেসবুকে জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস দিয়েই বিপ্লব করে ফেলতে চান। কিন্তু প্রথম আলো প্রসঙ্গ এলেই চুপ মেরে যান, বলেন, ইনবক্সে আসেন বা ফোন করেন। তাদের ধারণা প্রথম আলোকে ক্ষেপানো যাবে না। এমনে এমনে যতটুকু কাভারেজ পাওয়া যায় ততটুকুই ভালো। এতবড় পত্রিকা একেবারে শাহবাগের বিপক্ষে চলে গেলে বিপদ। কিন্তু ভাইয়েরা প্রথম আলো যখন আমার দেশ-এর শুন্যস্থান পূরণ করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন তাকে ঠেকাতে ক্ষেপানোর ঝূঁকি নিতেই হবে। অতিবিপ্লবী অনেকে আবার প্রথম আলো বর্জনের ডাক দেন। বর্জন করে কী আমরা প্রথম আলোকে জামায়াতের কোলে তুলে দিবো? প্রথম আলোর যেন মতিভ্রম না হয় সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ৯৯ ভাগ কর্মীর শ্রমে ঘামে তৈরি প্রথম আলোকে জামায়াতের রক্ষাকবচ বানাতে দেয়া যাবে না। প্রথম আলোর পেছনে লাগা নয়, প্রথম আলোর পাশে দাঁড়াতে হবে।

প্রভাষ আমিনঃ সাংবাদিক,এটিএন নিউজ।।

probhash2000@gmail.com

অতিথি লেখক