সাংবাদিক হত্যা বিচারে আর কোনো প্রহসন চাই না

সাংবাদিক হত্যা বিচারে আর কোনো প্রহসন চাই না

সিরাজ প্রামাণিকঃ

 

দীর্ঘ এক যুগেরও বেশী সময় ধরে মফস্বল সাংবাদিকতায় জড়িত থাকায় সাংবাদিকতার সজ্ঞাটি আমার কাছে ভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট-বেদনার কথা যিনি সবাইকে জানিয়ে দেন, তিনি সাংবাদিক। যিনি মানুষকে আহবান করেন মানুষের পাশে দাঁড়াতে, তিনি সাংবাদিক। পৃথিবীর কোথাও আইনের শাসন ও মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটলে যে মানুষটি সেখানে সবার আগে পৌঁছে যায় তিনি একজন সাংবাদিক। কাজেই সাংবাদিকতাই সম্ভবত একমাত্র পেশা যেখানে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি।

এই লেখা লিখতে গিয়ে আজ সবচেয়ে বেশী মনে পড়ছে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকান্ডের কথা। আর মনে পড়ছে ২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর খুনের শিকার হওয়া ফরিদপুরের সাংবাদিক গৌতম দাসের কথা। কারণ এ তিন হত্যাকান্ডে বেশ কয়েকটি বিষয়ে মিল রয়েছে।

গত এক সপ্তাহের বেশী সময় ধরে রুনী-সাগরের নৃশংস-নির্মমভাবে খুন হবার ঘটনাবলির সচিত্র সংবাদ-প্রতিবেদনগুলো দৈনিক আর অনলাইন সংবাদপত্রে পড়ে বা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে দেখে যে তথ্য পেয়েছি তা হলো সাগরকে বুক ও পিঠে অগণিত আর রুনির পেটে ও পাঁজরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করেছে ঘাতকেরা।

লাশ উদ্ধারের সময় নিহত সাগরের শরীরে ২৫টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এছাড়া তার শরীরে বিদ্ধ অবস্থায় ২টি বাঁটবিহীন ছুরি পাওয়া গেছে। এর একটি ৫/৬ ইঞ্চি আরেকটি ৮/৯ ইঞ্চি লম্বা। আর রুনির পেটে ও পাঁজরে পাওয়া গেছে ২টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন। সাগরের হাত ও পা পিছন দিক থেকে বাঁধা ছিল। সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান মেঘ তার মতো করে ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছে, কিংবা এ পর্যন্ত তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ যা জানাচ্ছে, তা থেকেও মনে হয়, চরম প্রতিহিংসার বশে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে এ জোড়া খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে খুনিরা!

অপরদিকে প্রায় বছর সাতেক আগে গৌতমকে সন্ত্রাসীরা তার নিজ কার্যালয়ে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে এবং গলায় নাইলনের রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিল। তার লাশ উদ্ধারের সময় দু’হাত পিছমোড়া করে এবং দুই পা ওই নাইলন আর মশারির দড়ি দিয়েই বাঁধা পাওয়া যায়। কি নির্মম আক্রোশ ছিল খুনিদের, ভাবা যায়!

পাঠক! নিশ্চয়ই মনে আছে সাংবাদিক মানিক সাহা হত্যাকান্ডের কথা। ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি দুপুর সোয়া ১টায় খুলনা প্রেসক্লাবের অদূরে দুস্কৃতকারীদের বোমায় নিহত হওয়ার সময় পর্যন্তও তিনি পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন একজন নিষ্ঠাবান সার্বক্ষণিক সাংবাদিক হিসেবে। হত্যাকান্ডের পর দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। ঢাকা ও খুলনার বিভিন্ন সমাবেশে এই ঘটনার জন্য তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করা হয়েছিল। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও দৈনিক সংবাদের প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যোগ দিয়ে মানিক সাহা হত্যার বিচার চাওয়ার সুযোগও আমার হয়েছিল। সেসময়ের বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন- জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে সাংবাদিক মানিক সাহা’র প্রকৃত খুনীদের গ্রেপ্তার ও বিচার করা হবে। এরপর আটটি বছর পার হয়ে গেলো। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার পার করলো সাড়ে তিন বছর। কিন্তু মানিক সাহার প্রকৃত খুনীরা আজো শনাক্ত হলো না।

তবে আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি প্রতিটি সাংবাদিক খুনের পরপরই পুলিশ আর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাজে ও কথায় বৈপরিত্য দেখা যায়। ফলে খুনের বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয়, আতঙ্ক আর ক্ষোভ সুষ্টি হয়। এটি শুধু গৌতম বা সাগর-রুনি কিংবা মানিক সাহা নয়, যে কোনো হত্যাকান্ডের পরেই কথা ও কাজের মধ্যে চরম অমিল দেখা যায়। এছাড়া রয়েছে তদন্তের দীর্ঘসূত্রতা, হত্যার আলামত নষ্ট বা গায়েব করে দেয়া, অনৈতিক সুবিধা নিয়ে দুর্বল তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা, তদন্তে নানা বাঁধা আসা, বাদী বা নিহতদের স্বজনদের হুমকি দিতে থাকা এবং সর্বোপরি বছরের পর বছর ধরে মামলা চলা, বিচারকাজের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা অজুহাতে মামলার কাজ স্থবির বা দেরি করিয়ে দেওয়া ইত্যাদির কারণে অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার পান না ভিকটিম বা তাদের স্বজনরা, এটাই চলে আসছে আমাদের দেশে যুগের পর যুগ।

অনুরুপ সাগর-রুনি হত্যাকান্ডেরও বেশ কয়েকদিন পেরিয়েছে, তবুও বিচার না পাবার শঙ্কায় আছেন তার স্বজনরা, আর এখন পর্যন্ত শুধু খুনিদের পরিচয় জানবার আকুল আবেদন জানিয়ে রাজপথে আন্দোলন করে যাচ্ছে সারা দেশের সাংবাদিক সহকর্মীরা। কথা উঠেছে, প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় পুলিশ বা গোয়েন্দারা সব রহস্য উদ্ধার করেও খুনিদের ধরছে না। আবার তদন্ত সংস্থাগুলোই এখন পর্যন্ত একেকবার একেক ধরনের তথ্য দিয়ে তদন্তের অগ্রগতি প্রায় শূন্য বলে হতাশার খবর জানিয়েছে। পরিস্থিতি ঠান্ডা করে আরেকটি ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজিয়ে মূল ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার পাঁয়তারা হচ্ছে বলে আশঙ্কায় ভুগছেন সাংবাদিক সমাজ। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৪৮ ঘণ্টা শেষ হওয়ার পর আরো ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে সেটাও ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।

ইতোপূর্বে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন যশোরের শামছুর রহমান কেবল, সাইফুল আলম মুকুল, হুমায়ুন কবির বালু, বেলাল হোসেন প্রমুখ প্রথিতযশা সাংবাদিক। সম্প্রতি কুষ্টিয়া, রংপুর, বরিশাল, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রায়ই সাংবাদিকদের দমন-পীড়ণের স্বীকার হতে হচ্ছে । রাজশাহীর ‘সংবাদ’ প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম আকাশ নির্যাতিত হয়েছেন এলিট ফোর্স ‘র‌্যাব’ কর্তৃক। তিনি ক্ষোভে দু:খে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সেনা সদস্যদের হাতে প্রহৃত হন সাংবাদিক আনিস আলমগীরসহ বেশ ক’জন সাংবাদিক। এই নিবন্ধের লেখক নিজেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেফতার ও পুলিশী নির্যাতনের শিকার হন। ইউএনবি’র ফেনী প্রতিনিধি সাংবাদিক টিপু সুলতান, ফরিদপুরের  ‘দৈনিক জনকন্ঠ’ প্রতিনিধি প্রবীর শিকদার শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়ে পঙ্গু হয়েছেন। অতি সম্প্রতি রংপুরে সাংবাদিক লিয়াকত আলী বাদল ও কুষ্টিয়ায় জহুরুল ইসলাম, হাসান বেলাল পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে প্রহৃত হয়েছেন। বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন ও হচ্ছেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আজও আমাদের রাজপথে দাঁড়িয়ে এই পৈশাচিক হত্যাকান্ডের ও নির্যাতনের বিচার দাবি করতে হচ্ছে। অথচ এসব হত্যাকান্ড ও নির্যাতনের বিচার না হলে সাহসী সাংবাদিক ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার মানুষসহ অসাম্প্রদায়ীক চেতনাধারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। প্রতিষ্ঠিত হবে না আইনের শাসন, ন্যায় বিচার ও মানবাধিকার। তাই সরকার, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন রাখছি, সুষ্ঠু বিচার, প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা ও ব্যবস্থা গ্রহণের।

নতুনদের বলি, ‘কে আছো জওয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ…!’ বিপন্ন সৎ সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নিতে হবে কঠিন হাতে। একশ’ বছর আগে কাঙাল হরিনাথ বলেছিলেন, ‘সৎ সাংবাদিকের কোন বন্ধু থাকতে নেই।’ আজ একশ’ বছর পর সাংবাদিক বন্ধুদের বলি, নিজেদের মধ্যে আর বিচ্ছিন্নতা নয়। প্রতিহিংসা নয়। একে অপরের সহযোগী এবং সহায়ক শক্তি যেন হয়ে উঠতে পারি। পেশাদারী মনোভাব নিয়ে সুস্থ প্রতিযোগিতায় সমৃদ্ধ করতে হবে সাংবাদিকতাকে।

সবশেষে আবারো নজরুলের ভাষায় বলি, ‘বন্ধুগো, বলিতে পারি না, বড়ো বিষজ্বালা এই বুকে। দেখিয়া-শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি- তাই যাহা আসে কই মুখে।’ সত্যকে মেনে নেবার সৎসাহসে সকল শুভ শক্তিকে একসাথে এগিয়ে যেতে হবে অনেকদূর। বিনাশ করতে হবে সকল অশুভ শক্তি, অন্যায় আর হিংসা। বন্দী বিবেককে এবার মুক্ত করে দেওয়া হোক। জয় হোক সত্যের। জয় হোক সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার।

লেখক: (সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী।)

E-mail: seraj.pramanik@gmail.com

প্রধান সম্পাদক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।