পরলোকে সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ
এসবিডি নিউজ24 ডট কম,ডেক্সঃ প্রবীণ সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ ফয়েজ আহমদ আর নেই। আজ সোমবার ভোরে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ৮৪ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি…রাজিউন)। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছিলেন।
ফয়েজ আহমদের সহকারী আতিকুর রহমান সোহেল জানান, আজ ভোররাত চারটার দিকে তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করেন। এরপর তাঁকে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে ভোর পাঁচটার দিকে তিনি মারা যান।
ফয়েজ আহমদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
ধানমন্ডিতে নিজের প্রতিষ্ঠিত শিল্পাঙ্গন আর্ট গ্যালারিতে সকাল ১০টা পর্যন্ত তাঁর মরদেহ রাখার পর সেখান থেকে তাঁকে জাতীয় প্রেসক্লাব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ নেয়ার কথা রয়েছে। সব শেষে তাঁর মরদেহ কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে নেয়া হবে।
ফয়েজ আহমদের ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর দেহ বাংলাদেশ মেডিকেলে দান করা হবে। এ ছাড়া ইতিমধ্যে তাঁর চক্ষুদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
ফয়েজ আহমদ ১৯২৮ সালের ২ মে মুন্সিগঞ্জের বাসাইলডোগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম গোলাম মোস্তফা চৌধুরী। ছেলেবেলা থেকে পত্রিকা ও লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ফয়েজ আহমদ পরবর্তী জীবনে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেন। গুণীজনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ১৯৪৪ সালে ১৬ বছর বয়সেই ‘শিশু সওগাত’-এ ফয়েজ আহমদের লেখা একটি রচনা প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম মুদ্রিত লেখা। দেশ বিভাগের পর ‘সওগাত’ পত্রিকা ঢাকায় চলে আসে। সওগাত অফিসে প্রগতি ও মুক্তবুদ্ধির ধারক হিসেবে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের জন্ম হয়। ফয়েজ আহমদ সে সময় এই সংসদের প্রথম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঢাকায় একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার প্রয়াস নেন। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি তিনি ১৯৪৮ সাল থেকেই সাংবাদিকতার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন। এ অঞ্চলে সাংবাদিকতাকে দৃঢ় অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ফয়েজ আহমদের অবদান ছিল অনন্য। তিনি ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ ও পরবর্তীকালে পূর্বদেশ পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন। তিনি সাপ্তাহিক ইনসাফ ও ইনসান পত্রিকায় কাজ করেছেন। ফয়েজ আহমদ ১৯৫০ সালে ‘হুল্লোড়’ ও ১৯৭১ সালে ‘স্বরাজ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রথম প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরে দৈনিক বঙ্গবার্তার প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। ফয়েজ আহমদ ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তাঁর নেতৃত্বে এই জোট স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়।
আশির দশকে ফয়েজ আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর সিন্ডিকেটের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি জাতীয় কবিতা উত্সবের প্রথম পাঁচ বছর আহ্বায়ক ছিলেন। এ ছাড়া ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমীর কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হন। পরে এরশাদের সামরিক শাসনের প্রতিবাদে তিনি ওই পদ ত্যাগ করেন। কিশোর বয়স থেকেই ফয়েজ আহমদ বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬০ সালে জেলে থাকা অবস্থায় অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে সদস্য পদ দেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করে। পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক আইয়ুব খানের আমলে তিনি ১৯৫৯ সাল থেকে চার বছর কারাবন্দী ছিলেন। বাংলাদেশেও তিনি সামরিক শাসক এরশাদের আমলে আরেকবার কারাগারে গিয়েছেন।
সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ শক্তি এবং জামায়াতের বিরুদ্ধে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির তিনি সদস্য ছিলেন। এই কমিটি বাংলাদেশ-বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালে গণ-আদালত তৈরি করে। ফয়েজ আহমদ সেই গণ-আদালতের ১১ জন বিচারকের মধ্যে অন্যতম একজন বিচারক ছিলেন। এই গণ-আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে ২৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল, ফয়েজ আহমদ ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন।
ফয়েজ আহমদ ঢাকার প্রাচীন আর্ট গ্যালারি শিল্পাঙ্গনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। ১৯৯২ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ১৯৬৬ সালে পিকিং রেডিওতে বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান শুরু করার জন্যে তিন বছর মেয়াদে নিযুক্ত হন। তাঁর নেতৃত্বের ফলে অল্প সময়েই পিকিং রেডিওতে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ফয়েজ আহমদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। কর্ম ও রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি তিনি প্রধানত শিশু-কিশোরদের জন্য ছড়া ও কবিতা লিখেছেন। তাঁর বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১০০। এর মধ্যে শিশু-কিশোরদের জন্য ৬০টি বই রয়েছে। ফয়েজ আহমদের বইগুলোর মধ্যে ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ সবচেয়ে বিখ্যাত। ছড়ার বইয়ের মধ্যে ‘হে কিশোর’, ‘কামরুল হাসানের চিত্রশালায়’, ‘রিমঝিম’, ‘বোঁ বোঁ কাট্টা’, ‘জোনাকী’, ‘জুড়ি নেই’ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তিনি চীনসহ বিভিন্ন দেশের পাঁচটি বই অনুবাদ করেছেন। এর মধ্যে হো চি মিনের ‘জেলের কবিতা’ উল্লেখযোগ্য।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ফয়েজ আহমদ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, শিশু একাডেমী পুরস্কার, সাব্বির সাহিত্য পুরস্কার অন্যতম। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ১৯৯১ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য ও মোদাব্বের হোসেন আরা শিশুসাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়।