নৈসর্গিক সৌন্দর্য হারাতে বসেছে সুন্দরবন
শুভাশিস ব্যানার্জি
পরিবেশবিদ ও জীববিদদের মতে, সুন্দরবন সমুদ্র উপকুলবতী নোনা পরিবেশের একটি বড় অখন্ড ম্যানগ্রোভ বন। বাংলাদেশ ও ভারতের বিশাল অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত সমুদ্র অববাহিকার সম্মুখে অবস্থিত এ বনভুমি ব্রম্রপুত্র ও গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত। সারা পৃথিবীর ৩টি ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে সুন্দরবনের অবস্থান সবচেয়ে মর্যাদা সম্পন্ন । যার ৬২শতাংশ বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থীত। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন যার আছে অপরিসীম নৈসর্গিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, যাকে ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষনা দেয়া হয়। ১০ হাজার ২৮০ বর্গ কিলোমিটারের এই বনে রয়েছে বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী হরিণ, ভয়ঙ্কর ও সুন্দর অজগর, কুমির,বানর সহ প্রায় ১ হাজার প্রজাতীর পশু, সাড়ে তিনশত প্রজাতির পাখি, আছে সুন্দরী, গরান, গেওয়া, কেওরা, ধুন্দল, গোলপাতাসহ মনজুড়ানো ৩৫০ প্রজাতির গাছ। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, জলযান ও কিছু অসাধু মানুষের নানা রকম অপরকর্মের কারণে আমদের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ধীরে ধীরে হারাতে বসেছে তার অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য।
সুন্দরবনের ৪ শতাধিক নদী, হাজার হাজার খালের অসহণীয় লবণাক্ততা, সিডর-আইলাসহ মানুষ্য সৃষ্টি নানা রকম দুর্যোগে গত ৪০ বছর ধরে নীরবে ধ্বংস হচ্ছে আমাদের প্রিয় সুন্দরবন। এদিকে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে হারিয়ে যাবে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ। বর্তমানে সুন্দরবনে ঢুকলেই চোখে পড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব। ২০০৭ সালের সিডর ও ২০০৯ সালের আইলার ক্ষত এখনো মোছেনি সুন্দরবনের বুক থেকে। বনের অনেক জায়গায় পরে আছে সুকনো ও আধমরা সুন্দরী, গেওয়া, বাইনসহ নানা রকম গাছ। যে গাছগুলো দক্ষিণাঞ্চলের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে সবসময় দাড়িয়ে থাকত মাথা উচু করে, কিন্ত সিডর ও আইলা কেড়ে নিয়েছে ওদের ডালপাতা, কিছু গাছ উপরে পরেছে, আর কিছু শুকিয়ে গেছে। এই আধমরা গাছগুলির প্রান ফিরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করে হলেও প্রতিকুল জলবায়ু, সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি, অনেক খাল ও নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, কিছু নদীতে আবার লবন পানির প্রবাহ আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে যাওয়া, বায়ুমন্ডলে কার্বনের পরিমান বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে তা সফল হচ্ছে না। তাই গাছগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে আর সুন্দরবন হারাচ্ছে তার স্বাভাবিকতা। ধ্বংস হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী সব প্রাণীকুলের সম্ভার। বন বিভাগের পরিসংখ্যন অনুযায়ী এর মধ্যেই সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের সবচেয়ে গহিনে অবস্থিত মান্দারবাড়িয়া ক্যাম্প সমুদ্রবক্ষে হারিয়ে গেছে। যার অবস্থান ছিল বঙ্গপসাগর থেকে মাইল কয়েক দূরে। মান্দারবাড়িয়ায় ছিল একটি মিষ্টি পানির পুকুর, যার পানি খেয়ে হাজার হাজার জেলে, বনরক্ষী, বাওয়ালী, মৌয়ালসহ ওই এলাকার বাসিন্দারা মিষ্টি পানির অভাব পূরণ করত। সুন্দরবনে মাছ ধরতে আসা জেলেদের মতে মান্দারবাড়িয়ার মিষ্টি পুকুরসহ সেখানকার ১৫-২০কি.মি. এলাকা সমুদ্রগর্ভে ডুবে গেছে, এছাড়াও নদী ভঙণের ফলে পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের হাজার হাজার খাল ও চার শতাধিক নদী। ফলে ভরা আমাবস্যা ও পুর্ণিমান জোয়ারে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভেসে গেলেও পথ না থাকায় ভাটার সময় সে পানি আর নামতে পারে না, যার ফলে সৃষ্টি হয় ভয়ঙ্কর লোনা পানির জলাবদ্ধতা। এর কারণে স্বভাবতই ম্যানগ্রোভ গাছ শ্বাস ছাড়তে না পেরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের অতন্দ্র প্রহরী সুন্দরী গাছ। বন রাণীর আদরের ধন গাজী, কালু, চম্পাবতী, মৌয়াল, বাওয়ালী, সুন্দরী, কুমির, বানর , হরিণ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বনমোরগসহ হাজার প্রজাতীর প্রাণী আজ হুমকির মুখে। ডেপুটি রেঞ্জার আব্দুর রব বলেন, “প্রায় ৪০বছর ধরে সুন্দরবনের এ ধ্বংসাত্মক প্রবনতা লক্ষ্য করা যায় তবে তখন এ প্রবনতা ছিল ক্ষীণ। সুন্দরী গাছের প্রায় সবই কালো হয়ে মারা যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বনের প্রায় ৭৩ শতাংশ গাছই সুন্দরী গাছ। আর সুন্দরী ছাড়াও সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির গাছ আছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ ভূমিই গাছশূন্য মরুভূমিতে পরিনত হবে।” গুন্দরী গাছের এ অকাল মৃত্যুর জন্য বিশেষজ্ঞরা এখানকার নদী ও বঙ্গপসাগরের পানির উচ্চতা বাড়া এবং স্বর্গীয় গঙ্গা নদীর উপর দেয়া ভারতীয় ফারাক্কা বাধকে দায়ী করেন। নদী বিশারদ ড. আইনুন নিশাতের মতে, ফারাক্কা বাধের পরই প্রথম খুলনা, বাগেরহাট, ও সাতক্ষিরা অঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। যেহেতু উজানের পানির সাথে এখন আর সুন্দবনের নদীগুলোর কোন সম্পর্ক নাই তবে বর্ষা মৌসুমে মাথাভাঙ্গা ও জলাঙ্গী নদী থেকে সামান্য মিষ্টি পানিআসে। তাই ১৯৭৫সালের পর থেকেই নিয়মিত বেড়ে চলেছে সুন্দরবনের লবণাক্ততা এবং নদীর পানিতে উচ্চমাত্রার এলকোহল পাওয়া গেছে। এছাড়াও মংলা বন্দর ও বঙ্গপসাগরের সাথে সংযোগ রক্ষাকারী বনের মধ্যে থেকে প্রবাহিত একমাত্র নদী পশুরের বুকে জেগেছে বিশাল চর। যা সুন্দরবনের জন্য হুমকি স্বরুপ। জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য প্রতিকুল আচরণের কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এবনের প্রধান আকর্ষন রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মিষ্টি পানির কুমির, লোনা পানির কুমির, ঘরিয়াল, হরিন, চিত্রা হরিন, মায়া হরিন, বানর, বন্য শূক্কুর, অজগর, খাডাস, বন বিড়াল, হনুমান, বন মহিষসহ সব রকমের আকর্ষণীয় প্রাণীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। এবনের সবখানে পাওয়া যেত , বন মরোগ, ময়না, টিয়া, মাছরাঙ্গা, মদনটাক, মাস্ক ফিনফুট, পানকড়ি, বালিহাস, কাকাতুয়া, ডাহুকসহ অনেক পাখি এখন আর আগের মত পাওয়া যায় না। আর সাদা শকু’ন, শঙ্খচিল, ঈগল, সাদা ঈগলতো এখন বিরলপ্রায়। নদী ও খালে মাছের উপস্থিতি কমেছে আশংকাজনকভাবে। বন কর্মকর্তা রব বলেন, সুন্দরবনের ৩১.১৫ ভাগ এলাকা জুড়ে আছে নদী, নদীতে পাওয়া যেত ১৩ প্রজাতির কাকড়া, ১০ প্রজাতির চিংড়ি, ৪২প্রজাতির অন্যান্য মাছ। নদী ও খালে সহজেই পাওয়াযেত, চিত্রা, মাগুর, পাঙ্গাস, ছুরি, লইট্টা, সেট পারসে, ভাঙা, পোয়া, তাপসী, বাটাসহ নানা প্রজাতির সুস্বাদু মাছ। তিনি আরও বলেন সুন্দরবন থেকে সংগৃহিত মাছ থেকে শুটকি, কাকড়া, বাগদা ও গলদা চিংড়ি আহরণ করে রপ্তানি করে জিবীকা নির্বাহ করত ১০ লক্ষাধিক জেলে। এখন তা প্রায় হারিয়ে গেছে। জনাব রবের মতে, ৩৩৪ প্রজাতির গাছ, ১৫৬ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড আজ হুমকির মুখে আছে। ধ্বংস হচ্ছে ৭৩শতাংস জায়গা দখলকারী সুন্দরী, ১৬শতাংস জায়গা দখলকারী গেওয়া, বাকি ১১ শতাংশ জায়গা দখলকারী গরান, কেওড়া, বাইন, কাকড়া, ধুন্দল, গোলপাতা, সিংড়া, হারগোল্লা, হোতাল, ধানসী, হারগোজা, আমুর ইত্যাদি। এদিকে খুলনা বিশ্ব বিদ্যালয়ের এনভায়রণমেন্টাল সাইন্স ডিসিপ্লিনের ওয়ার্কিং গ্রুপ দাবি করেছে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ভেঙে পরেছে সুন্দরবনের ইকো সিস্টেম। সুন্দরবনের সাতটি নদীর পানি ল্যবরেটরিতে পরীক্ষা করে তাতে এ্যালকোহলের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা জলজ প্রাণী ও মাছের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ অঞ্চলের সাগরের পানিতে এ্যালকোহল না থাকলেও নদীর পানিতে এ্যালকোহল খুবই বিস্ময়কর। এভাবে চলতে থাকলে সুন্দরবনের প্রাণজুড়ানো জীবগুলোর ৮০শতাংস আগামী ৫০বছরের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিষেজ্ঞরা। এছাড়াও প্রতিনিয়ত বনদস্যুরা সুন্দরবনের কোটি কোটি টাকার গাছ কেটে পাচার করে দিচ্ছে। স্থানীয় এক বাসিন্দাদের মতে, প্রতি বছর ৫০কোটি টাকার কাঠ পাচার হয়। গত পাচ বছরে বিভিন্ন সময় সুন্দরবন বন বিভাগের বিভিন্ন অভিযানে ১লাখ ৮৪হাজার ৩৫২ ঘনফুট কাঠ আটক হয়েছে, গ্রেফতার হয়েছে ৩১৭জন, মামলা হয়েছে ৫১৯৭টি, তবে এসব মামলা ও মামলায় আটককারীরা বিভন্ন কারণে লঘু শাস্তির মাধ্যমে পার পেয়ে যায়, অনেক ক্ষেত্রেত মোটা অংকের উৎকোচের মাধ্যমে পার পেয়ে বন অপরাধীরা। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বন থেকে কাঠ পাচার তুলনামূলক কমলেও বর্তমান নির্বাচিত সরকারের আমলে তা আবার আগেরমত হয়ে গেছে। স্থানীয় সূত্রমতে, পাচারকারীরা জেলে, বাওয়ালী, মৌয়ালীসহ অন্যান্য বনজীবি সেজে বনবিভাগের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বনের ভিতরে ঢোকে এবং কাঠ কেটে পাচার করে পালিয়ে যায়। আর একাজে সহায়তা করার জন্য বনের কাছেই স্থাপিত হয়েছে অনেক সমিল। কিন্তু আইনে বাধা থাকা সত্বেও বনের খুব কাছেই এসব সমিল থাকলেও তেমন কোন পদক্ষেপ সংশ্লিষ্টরা নিচ্ছেনা। কাঠ পাচারের সাথে সাথে পাচার হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, পাখিসহ বিভিন্ন দামী প্রানী। খাদ্যাভাবে বা অন্যকোন কারণে প্রায়ই বাঘের লোকালয়ে আসার খবর পাওয়া যায়। লোকালয়ে আসার খবর যেমন পাওয়া যায় তেমনি বনে ফিরতে না পারার খবরও পাওয়া যায়। প্রতিনিয়ত জনগনের পিটুনিতে মারা যাচ্ছে সুন্দরবনের বাঘ। এছাড়া সম্প্রতিক সময়ে বাঘের চামড়া, হাড় ও মাথার খুলি পাচারের নেশায় মেতেছে এক শ্রেণীর লোক। ভারতের বাজারে এর মূল্য অনেক। কয়েকদিন আগে সন্দরবন পূর্ববন বিভাগ বাঘের চামড়া, হাড় ও মাথার খুলি উদ্ধার করেছে। তাই বেঁচে থাকার লড়াইয়ে বার বার পরাস্থ সুন্দরবনের অতন্ত্র প্রহরী রয়েল বেঙ্গল টাইগার আজ চরম অস্তিত্ব সংকটে । উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞ মহল আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী এক যুগে সুন্দরবনে বাঘের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। তবে আশা বা হতাশার কথাই হোক বাঘ রক্ষার জন্য একটি প্রস্তাবিত ‘টাইগার প্রজেক্ট’ প্রকল্প রয়েছে। যা বিশ বছরেও আলোর মুখ দেখে নি। প্রস্তাবিত ‘টাইগার প্রজেক্ট’ প্রকল্প আলোর মুখ দেখবে কি-না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় একটি সংস্থা তৃতীয় দফায় সুন্দরবনের একাংশ থেকে বাঘ গননা কাজ শেষ করেছে। তাদের ধারণা এই মুহুর্তে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা সাড়ে তিনশ থেকে পাঁচ’শর মধ্যে থাকতে পারে। একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, গত দুই যুগ ধরে বিভিন্ন কারণে সুন্দরবনের শতাধিক বাঘ মারা পড়েছে। এদের মধ্যে বেশ কিছু মৃত বাঘের ময়না তদন্ত রিপোর্টে দেখা গেছে লিভার জনিত কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। বাঘ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রক্ষণাবেক্ষণ ও বাসযোগ্য পরিবেশের অভাবে বাঘের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। চোরাশিকারীসহ জনতার হাতে নিহত হয়ে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা যে হারে কমছে সে হারে বংশ বিস্তার হচ্ছে না। বাঘিনীরা একসঙ্গে ৪-৫টি বাচ্চা প্রসব করলেও পুরুষ বাঘেরা অধিকাংশ বাচ্চা খেয়ে ফেলার কারণে বাঘ বৃদ্ধি পাচ্ছেনা। গণহারে বাঘ নিধনের কারণ সম্পর্কে বনবিভাগ এবং অভিজ্ঞ মহল জানান, আন্তজার্তিক বাজারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া ও কংকালের উচ্চ মূল্য রয়েছে। ফলে তাদের সাথে হাত মিলিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিতভাবে বাঘ শিকার করছে। অভয়ারণ্য না থাকায় প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাবে এবং বনদস্যু ও শিকারীদের তাড়া খেয়ে বাঘ সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামে অহরহ প্রবেশ করছে। এসময় স্থানীয় জনতার পিটুনিতে ওইসব বাঘ মারা পড়ছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দূর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়, জ্বলোচ্ছাসের কারণে বিভিন্ন সময়ে অনেক বাঘ মারা গেছে। সিডরে মারা যাওয়া বাঘের কঙ্কালটি দেখা যায় করমজল জাদুঘরে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শরনখোলা রেঞ্জের এক বন কর্মকর্তা বলেন, জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ-অদূর ভবিষ্যতে সুন্দরবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে এই প্রবাদটি কেউই বলবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনে বাঘসহ অন্যান্য প্রাণী শিকার বেড়েছে। তিনি বলেন, আগে সুন্দরবনে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যেতো। এখন অতিরিক্ত লবনাক্ততার কারণে সে অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। তাছাড়া জলদস্যুতো রয়েছেই। মাছ ধরার মত আদি পেশা ছেড়ে জেলেসহ বনজীবীরা এখন বাঘ শিকারের নেশায় মেতেছে। লবনাক্তার কারণে গোলপাতা ও গরান বন ধ্বংসের পথে, ফলে বাওয়ালীরাও জেলে-মাঝিদের পথ অনুসরণ করছে। আর্ন্তজাতিক বাজারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার চড়া মূল্য থাকায় এখন চোরা শিকারিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের বাঘ। সম্প্রতি তিন টি বাঘের চামড়া সহ কয়েকজন শিকারী সুন্দরবন পূর্ব বণ বিভাগের বন প্রহরীদের হাতে আটক হয়েছে। সূত্রে জানা গেছে, বাঘ শিকারীরা জেলে সেজে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বনে যায়। এরপর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে, ফাঁদ পেতে, বন্দুক দিয়ে গুলি করে বাঘ হত্যা ঘরে। বাঘ শিকারিরা বাঘ হত্যার পর স্থানীয় পদ্ধতিতেই বাঘের চামড়া সংরক্ষণ করে। পরে তা পাচারকারী চক্রের সাহায্যে বিদেশে পাচার হয়। স্থানীয়ভাবে একটি চামড়ার জন্য শিকারিরা দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা পেলেও বিদেশে একটি চামড়া ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। পরিবেশবাদিদের মতে, ১৯৭৫ সালের পর সুন্দরবনে আর বাঘ বাড়েনি। প্রাকৃতিক কারণে মারা গেছে বছরে প্রায় দুইটি করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, আর চোরা শিকারিদের হাতে বছরে মারা পড়ে প্রায় ১০টি বাঘ। কিন্তু বন বিভাগ এ সংখ্যা তিন থেকে চারটি বলে জানিয়েছে। আর্ন্তজাতিক পরিবেশ সংরক্ষন ইউনিয়ন, আইইউসিএন এর লাল তালিকা অনুযায়ী পৃথিবীতে বর্তমানে আড়াই হাজার বাঘ আছে। আর বাংলাদেশে এর সংখ্যা মাত্র ২০০। দক্ষিনাঞ্চলসহ এ উপমহাদেশের গনমানুষের চাওয়া এখন সুন্দরবনকে রক্ষা করা। তাদের চাওয়া এখন যে কোন মূল্যে সুন্দরবনের সৌন্দর্য্য ফিরিয়ে আনা।