শিক্ষার মান নিশ্চিত করা আবশ্যক

শিক্ষার মান নিশ্চিত করা আবশ্যক

মুহম্মদ মাছুম বিল্লাহঃ

 

উক্ত শিরোনামে জনাব আবু আহমদ স্যারের একটি লেখা দৈনিক কালের কন্ঠে ১৩ই ২০১২ ফেব্রুয়ারী তারিখে আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সমালোচনামূলক লেখা আমিও লিখি, মানসম্মত শিক্ষা দেয়ার পক্ষে আমিও, সার্টিফিকেট  বাণিজ্য বন্ধ করা আমরা যারা মানসম্মত শিক্ষার কথা বলি তারা সবাই চাই কিন্তু তাই বলে আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বন্ধ করে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে নয়। প্রয়োজনের তাগিদে আমাদের দেশে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তব অবস্থা, অর্থনৈতিক কারন, জমির স্বল্পতা, সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদের পার্শ্ববতী দেশে গিয়ে পড়া এবং দেশী মুদ্রা বিদেশে চলে যাওয়া, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সীমিত আসন সংখ্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য সেশন জট ইত্যাদি কারনগুলো বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে কাজ করেছে। এ ছাড়াও নিত্য-নতুন প্রয়োজন , চাহিদা ও সমস্যা সৃষ্টি হচেছ এ লাইনে। সবগুলো বিবেচনায় নিয়ে আমাদের কথা বলতে হবে।

উন্নত বিশ্বে যেমন প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় আছে তেমনি কিচেন মার্কেটের ওপর, ঘোপের ভিতর , চিপা গলির মধ্যেও অনেক বেসরকারী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আমরা  যখন পারলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম তখন আমাদের দেশে কোন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ছিলনা। তখন শুনতাম এবং পত্রিকার পাতায় দেখতাম  খোদ মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা সার্টিফিকেট বিক্রি করে। তখন দেখতাম অনেক অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলেময়ে যারা বাংলাদেশী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চান্স পেত না তারা উন্নত বিশ্বে চলে যেত। কয়েক বছর পর বড় সর সার্টিফেকেট নিয়ে কেউ দেশে ফিরত আবার কেউ ফিরত না। গ্রেট ব্রিটেনে আমাদের দেশের শত শত ছাত্রছাত্রী গিয়ে দেখেছে নামকাওয়াসেত্ম বেসরকারী কলেজ  এবং  বিশ্ববিদ্যালয় আছে, আবার কোথাও তারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের  কোন অসিত্মত্বই পায়নি, মারাত্মকভাবে  প্রতারিত হয়েছে এসব ছাত্রছাত্রী। উন্নত বিশ্বের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তথা  শিক্ষা ব্যবসার  যখন এই অবস্থা তখন আমাদের মতো দরিদ্র একটি দেশের এই অবস্থা কতটা খারাপ হওয়ার কথা, কিন্তু সেই অনুপাতে অবস্থা  অতটা খারাপ নয় ।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় সমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হতে  এবং পূর্ণঙ্গতা পেতে ৫০ থেকে ১০০ বছর সময় লেগে যায় । আমাদের দেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাস মাত্র ১৫-২০ বছরের। এই অল্প সময়ের  আমারা খুব বেশী একটা আশা করতে পারিনা। তার মধ্যেই বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় বেশ ভালেই করছে। যেমন নর্থ সাউথ, ব্য্রাক বিশ্ববিদ্যালয়, আহসানউলস্নাত ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট,সাউথ-ইস্ট, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, আই ইউ বি, ইউ ল্যাব। এর মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ক্যাম্পাসও তৈরি করে ফেলেছে। এটি কম সাফল্য নয়। সমস্যা হচেছ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিওর ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি পড়াচেছনা ।শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র ব্যবসা শিক্ষা কিংবা উচচতর কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করছে ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মানবিক গুণাবলীর বিকাশ কম হচেছ। কিন্তু এটিও তো যুগের চাহিদা। একটি নির্দিষ্ট সময় পার হলে নিশ্চয়ই তারাও সেদিকে দৃষ্টি দেবে। আমরা তো রাতারাতি সবকিছুর পরিবর্তন আশা করতে পারিনা।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বলে অনেক ছাত্রছাত্রী দেশে পড়াশুনা করছে, দেশী মুদ্রা বাঁাচাচেছ। প্রতিবছর তারা হাজার হাজার ডলারের দেশী মুদ্রা বঁচাচেছ। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ব্যতিক্রম ছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও ইংরেজিতে অতিকতর পারদর্শী । বর্তমান যুগে এ দুটি হচেছ সারভাইভাল স্কীল। তারা ছোটখাট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেও এ স্কীল দুটো ভালোই অর্জন করছে।তাছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতা এমনকি বুয়েটসহ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করছে।  রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া ছাত্রছাত্রীরা  আবাসিক হলে থাকতে পারছেনা । বিশাল ক্যাম্পাস , খেলার মাঠ, লাইব্রেরী এগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পজিটিভ সাইড কিন্তু সাধারন ছাত্রছাত্রী এর কতটা সদ্ব্যবহার করছে বা করতে পারছে সেখানে কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচেছ। আমরা কি মানের ছাত্রছাত্রী প্রডিউস করছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সেটাও দেখতে হবে। শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন  শিক্ষকদের, লবিং, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়গুলোতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ই বেশী হচেছ, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে এগুলোর স্থান তেমন একটা নেই। আমত্মর্জাতিক র‌্যংকিংয়ে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় ৩০০০ হাজারের মধ্যেও নেই । এই যখন অবস্থা তখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের  একজন শিক্ষক কিভাবে দেশের সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে বলেন, বুঝতে একটু কস্ট হচেছ।

আমাদের দেশে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দরকার নেই, প্রয়োজনে বিদেশী শিক্ষক আনা যেতে পারে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক’জন শিক্ষক গবেষণা করছেন, ক’জন পড়াশুনা করছেন এবং নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করছেন এ নিয়ে প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়। আমরা যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছি ( জাহাঙ্গীরনগর) তখনও দেখেছি অনেক শিক্ষক দিনের পর দিন ক্লাস নিতেন না । নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যসত্ম থাকতেন। অনেকে আবার তাড়াহুড়ো করে দু একটি প্রিয়ড নিতেন। কোন জবাবদিহিতা নেই। বিভাগের চেয়ারম্যান নিয়ে রাজনীতি, শেষে হাইকোর্টের নির্দেশে যথাযথ শিক্ষককে চেয়ারম্যান পদে বসানো হয়। ভিসি হবার জন্য লবিং এবং সরকারী ছাত্রসংগঠনের পুতুল হিসেবে থাকা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোর যেখানে বৈশিষ্ট সেগুলোর পরিবর্তনের কোন সমাধানমূলক আলোচনা না করে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়ার প্রসত্মাব নিতামত্মই অমূলক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের  যেসব শিক্ষক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠোর সমালোচনা করেন, অবসরে যাওয়ার পর তারাই সেখানে গিয়ে পড়াচেছন। তাহলে মান তো খারাপ হওয়ার কথা নয় । আর সার্টিফিকেট বিক্রির কাজ যদি কেউ করেই থাকে তাহলে তারা ও তো তাতে জড়িত।

লেখক ইউ জিসি কে শাক্তিশালী করার প্রসত্মাব করেছেন এটি সমর্থনযোগ্য। তবে এটিও ঠিক  যে ইউ জিসি যখন শক্তিশালী হবে তখনসেখানে লবিং বেশী হবে, দুর্নীতি প্রবেশ করবে, রাজনীতি আরও বেশী প্রবেশ করবে।বর্তমানেও তো ইউ জি সি-র চেয়ারম্যান হতে হলে সরকারী দলের শিক্ষক হতে হয়,  তাই না? অন্য গ্রম্নপের যত বড় পন্ডিতই হোক না কেন তাকে তো চেয়ারম্যান করা হয় না।

প্রয়োজনের তাগিদে হোটেল-বাজারের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনসংখ্যা অনুপাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা  আমাদের দেশে এখনও  কম । বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার জন্য  ইউ জিসি যে পরিমান জমির কথা বলেছে তা বাংলাদেশের জন্য কতটা বাসত্মব তাও ভেবে দেখতে হবে। প্রতিবছর আমরা ১ শতাংশ হারে আবাদযোগ্য জমি হারাচিছ, তারওপর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মিল কারকখানা ও স্কুল কলেজ আগেকার দিনের মতো প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে এত জমি কোথায় আমাদের? স্বল্প জমির ওপর আমাদের সামাজিক সংগঠনগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিশালকায় বির্নিমানের  ধারনা এখান পাল্টাতে হবে। আমাদের দেশে পূর্বে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনেও একটি বড় খেলার মাঠ আছে, হাই স্কুলে খেলার মাঠ, পুকুর, বাগান, মসজিদ এবং অনেক স্কুলে আলাদা ভবনে প্রধান শিক্ষকের বসার স্থান এবং অফিস কক্ষ। বর্তমানে আমরা কি এটি চিমত্মা করতে পারি? তবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লাইব্রেবরী সুবিধা আরও প্রসারিত করতে হবে, ইনডোর  গেইমসের  আরও ভালো ব্যবস্থা করতে হবে যেহেতু আইটডোর গেইমসের ব্যবস্থা সব বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। চৌদ্দ কোটি জনসংখ্যার দেশে এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রজানীতিকরণের যুগে কোনভাবেই আমরা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার সুপারিশ করতে পারিনা।

লেখকঃ গবেষক।

mmbillah2000@yahoo.com

বিভাগীয় প্রধান

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।