মালয়েশিয়ার সঙ্গে পদ্মা সেতু প্রকল্প এগিয়ে নেয়ার জোর প্রচেষ্টা চলছে
বিশেষ প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতুর চুক্তি বাতিলের সুপারিশ করেছে সেতু বিভাগ। প্রস্তাবটি এখন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অন্যদিকে মালয়েশিয়ার সঙ্গে পদ্মা সেতু প্রকল্প এগিয়ে নেয়ার জোর প্রচেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে রোববার বিকালে সেতু বিভাগের সভাকক্ষে বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে আন্তঃ-মন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও সেতু বিভাগ ছাড়াও আইন মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), বাংলাদেশ ব্যাংক, পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে সেতু সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, গত বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাতিলের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবটি অনুমোদন হলে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হবে। তিনি আরো বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়া অনেকগুলো শর্ত দিয়েছে। এসব বিষয়ে অন্য মন্ত্রণালয়গুলোও জড়িত। তাই এসব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করার জন্যই এই বৈঠক। তবে সমঝোতা স্মারকে এসব শর্ত থাকছে না। মূল চুক্তিতে এ বিষয়গুলো আসবে বলে তিনি জানান। মালয়েশিয়া কী কী শর্ত দিয়েছে জানতে চাইলে সচিব বলেন, অনেকগুলো শর্ত দিয়েছে। তবে তা এখন বলা সম্ভব নয়। তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবনায় লাভ ও বিনিয়োগ তুলে নেয়াসহ ৭টি শর্ত দিয়েছে মালয়েশিয়া। এর মধ্যে রয়েছে নির্মাণের পর ৫০ বছর এ সেতু রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এবং ২৫ বছর পর্যন্ত যানবাহনের টোল আদায়ের নিশ্চয়তা। এছাড়া শর্তের মধ্যে রয়েছে প্রকল্পটি লাভজনক করতে প্রয়োজনীয় স্থানে রাজস্ব ভর্তুকি দিতে হবে। নির্মাণসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি আমদানিও ট্যাক্সমুক্ত রাখতে হবে। শুল্কবৃদ্ধির কারণে বিনিয়োগকারীদের যাতে লোকসান না হয় তারও নিশ্চিয়তা দিতে হবে। পরিবেশগত ও মানবাধিকারসহ এ ধরনের কোনো কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত না হয়, সে ব্যাপারসহ সরকারকে অর্থপ্রবাহের নিরাপত্তারও নিশ্চয়তা দিতে হবে। বিওওটি পদ্ধতিতে কাজ শুরুর ৫৪ মাসে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেবে মালয়েশিয়া। তাদের প্রস্তাবনাপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে উন্নয়নের লক্ষ্যে মাওয়া ও জাজিরার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে প্রমত্তা পদ্মার ওপর রেললাইনসহ পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে চায় বাংলাদেশ সরকার। পদ্মা সেতু প্রকল্প বিশ্বমানের একটি ঐতিহাসিক নদীর ওপর হবে, যা বাংলাদেশকে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে রুট এ-১-এর মাধ্যমে যুক্ত করবে। এটি বাস্তবায়ন হলে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্যবিমোচন, বিদ্যুৎ লাইন, গ্যাস পাইপলাইন, টেলিযোগাযোগ লাইন এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বাড়বে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে ২০ অক্টোবর এক বৈঠকে কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাবের ভিত্তিতে মালয়েশিয়া পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ বিবেচনায় নিয়ে মালয়েশিয়া সরকার এ প্রস্তাব দেয় বলে বলা হয়েছে। প্রকল্পের রূপরেখায় বলা হয়, ইস্পাতের রেললাইন স্থাপন করে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার মাওয়া ও জাজিরাকে সংযোগ করে দীর্ঘ এ সেতু নির্মাণ করা হবে। সেতুর উভয় পাশে ১২ দশমিক ১৬ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড সেতু প্রকল্পে সংযোগ থাকবে। এতে বিনোদনের জন্য বিশেষ এলাকা, পার্কিং স্থান, রেঁস্তোরা, দোকান, টয়লেট এবং গ্যাস স্টেশন অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এ জন্য ১৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ নদী তীর সংরক্ষণ কাজ ও ৯৫ লাখ ঘনমিটার নদী খনন করা হবে। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ২৩ হাজার ৫২০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ধরে), যার মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে ৫৯৪ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের টাকা। প্রকল্পটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হতে ৫৪ মাস বা সাড়ে চার বছর লাগবে। প্রকল্পটি দুই দেশের সরকার-টু-সরকার পর্যায়ে ‘বিশেষ প্রস্তাবিত পরিবহন (এসপিভি)’ পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করা হবে। এই এসপিভি মালয়েশিয়ান প্রকল্প বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিকভাবে অভিজ্ঞ বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে যৌথ কনসোর্টিয়াম গঠন করবে। এই কনসোর্টিয়াম মালয়েশিয়া সরকারের কাছে কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা না নিয়ে নিজেরাই এটি বাস্তবায়ন করবে। ইউইএম হোল্ডিংস অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিনাপুরি অ্যান্ড ইভারসেন্ডাই করপোরেশন ইস্পাত কাঠামো নির্মাণে যৌথ এবং এককভাবে কাজ করবে। উভয় প্রতিষ্ঠানই এ সংক্রান্ত কাজে বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত কোম্পানি। আন্তর্জাতিকভাবে আর্থিক কাঠামো এবং দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় তাদের সামর্থ্য রয়েছে। প্রস্তাবনায় আরো বলা হয়- ২০১৫ সাল নাগাদ প্রতিদিন এ সেতুর ওপর দিয়ে ২১ হাজার ৩০০ যানবাহন চলাচল করতে পারবে। ২০২৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রতিদিন ৪১ হাজার ৬০০টিতে। পদ্মা সেতু নির্মাণ ও আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণে ৬২০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এ কারণে ৫ হাজার পরিবারকে নির্মাণ এলাকা থেকে ১৭৫ হেক্টর দূরে স্থানান্তর করতে হবে। জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে প্রকল্প এলাকা থেকে স্থানান্তরের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের ঝুঁকি এড়াতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে নিবিড় সমন্বয় সাধন করতে বলা হয়েছে প্রস্তাবনায়। এতে বলা হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষায়িত যন্ত্রপাতি যেমন বার্জ মাউনটেড পাইলিং ফ্রেইম, বৃহৎ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্রেন, ব্যাচিং প্ল্যান্ট, লাংচিং গিরডার, তিন ঘনমিটার স্টিলের পাইলস, নদী শাসনের জন্য পাথরসহ অন্যান্য সরঞ্জাম সমুদ্রগামী বার্জের মাধ্যমে বাংলাদেশের বন্দরে আনা হবে। সমুদ্র থেকে ছোট বার্জের মাধ্যমে এসব যন্ত্রপাতি নির্মাণ এলাকায় নেয়া হবে। এ কনসোর্টিয়াম পরিবেশগত করণীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। এ প্রকল্পের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হবে অবকাঠামো বন্ডের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান থেকে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য একটি অবকাঠামো বন্ড প্রস্তুত করতে হবে। এই অবকাঠামো বন্ডের হার নির্ধারণ করবে একটি সুপরিচিত আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সির মাধ্যমে। এ বন্ডের সময়সীমা হবে ৬ বছর, নির্মাণে এবং বন্ডের অর্থ ফেরত আনতে আরো ২৫ বছর সময় লাগবে। টোল আদায়ের মাধ্যমে অর্থপ্রবাহ নিশ্চিত হবে। অবকাঠামো বন্ডকে আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত করতে হবে। সুষ্ঠু বাণিজ্য এবং তারল্য দেবে যে কোনো স্থানে এ বন্ড থেকে। বাংলাদেশ সরকারের সমর্থন ও অংশগ্রহণের ওপরই এ অর্থায়ন ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করছে বলে এতে বলা হয়েছে।