ছাপাখানার ভূত
সেকালে ছাপাখানায় কাজ শেখা সহজ ছিল না মোটেও। নতুনরা কাজ করতে গিয়ে আনাড়িপনার জন্য ভূত হয়ে থাকতো তেল-কালি মেখে, তারপর কাজ শেষে নেয়েদেয়ে সাফ হতে আস্ত একটা সাবান লাগতো তাদের। ওই বেচারা নবিশদের নাম হয়ে গিয়েছিল তাই ‘‘ছাপাখানার ভূত’’। তারপর ছাপায় কোনও ভুল থাকলে সব দোষ গিয়ে পড়তো ওই ‘ভূত’দের ওপর। বানান ভুল, এক শব্দে আরেক শব্দ ঢুকে পড়া, বাক্য / বাক্যাংশ এমন কি প্যারা শুদ্ধ গায়েব হয়ে যাওয়া – সব মুদ্রণপ্রমাদ তাই ‘‘অনিচ্ছাকৃত’’ অথবা ‘‘অনবধানবশত’’, দায়ী ‘‘ছাপাখানার ভূত’’! ইংরেজিতে একে বলে ‘টাইপোগ্রাফিকাল এরর’, সংক্ষেপে ‘টাইপো’।
তবে ‘ভূত’ পরিচয়ে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। জীবনের এক পর্যায়ে অ্যামব্রোজ বিয়ার্স, বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন, টমাস জেফারসন, ওয়াল্ট হুইটম্যান, মার্ক টোয়েন, লিনডন জনসন প্রমুখের মতো বিশ্ববরেণ্য মানুষও একদিন ছিলেন ছাপাখানার ভূত। আর একটা কথা, এ ভূত কিন্তু ছাড়ে না কাউকে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বাংলা একাডেমী – সবখানে চোখে পড়ে ভূতের আছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কবিতা সংগ্রহ’-এ কবি ফররুখ আহমদের জন্মসন ১৯১৯, বাংলা একাডেমী চরিতাভিধানে তা ১৯১৮। একই ভাবে ওই ‘কবিতা সংগ্রহ’ অনুযায়ী সৈয়দ আলী আহসান-এর জন্মসন ১৯২০, হাবীবুর রহমানের ১৯২২, সানাউল হকের ১৯২৩, আশরাফ সিদ্দিকীর ১৯২৬, মযহারুল ইসলামের ১৯২৭, আবদুস সাত্তারের ১৯৩১, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র ১৯৩২, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ১৯৩৯, শহীদ কাদরীর ১৯৪০। বাংলা একাডেমীর ‘চরিতাভিধান’, ‘লেখক অভিধান’ ও ‘লেখক পরিচিতি’ অনুযায়ী এ সনগুলি যথাক্রমে ১৯২২, ১৯২৬, ১৯২৪, ১৯২৭, ১৯২৮, ১৯২৭, ১৯৩৬, ১৯৪২। এছাড়া ‘কবিতা সংগ্রহ’ সৈয়দ আলী আহসান-এর নামের বানানে একটি অতিরিক্ত হস্-চিহ্ন বসিয়ে ‘আহ্সান’ লিখেছে। আর হাবীবুর রহমান-এর ‘হাবীবুর’কে করেছে ‘হাবিবুর’। ‘চরিতাভিধান’-এ এমন উদাহরণ মিলবে অনেক। একটিই দিচ্ছি। তাঁরা ‘‘শহীদুল্লা কায়সার’’-এর ‘‘শহীদুল্লা’’কে করেছেন হ-যুক্ত – ‘‘শহীদুল্লাহ’’। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে বাংলা একাডেমীর সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৬৯ সালে। কিন্তু সেই বাংলা একাডেমীরই ‘চরিতাভিধান’ বলছে সনটি ১৯৬২!
আবু ইসহাকের উপন্যাসের নাম কি? ‘‘সূর্যদীঘল বাড়ী’’ না ‘‘সূর্য দীঘল বাড়ী’’? ‘‘পূর্ব বাঙলার উপন্যাস’’ গ্রন্থে মনসুর মুসা লিখেছেন দু’ রকম বানানই। ‘‘কথাসাহিত্যের কথকতা’’ গ্রন্থে হাসান আজিজুল হক লিখেছেন ‘‘সূর্য দীঘল বাড়ি’’। তিনি উপন্যাসের নায়িকা ‘‘জয়গুণ’’কে লিখেছেন ‘‘জয়তুন’’।
সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত মাসিক পূর্বাশা পত্রিকার নির্বাচিত রচনা সঙ্কলন ‘‘পূর্বাশা সংকলন ১’’ প্রকাশ করেছে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি। এর ‘মুখবন্ধ’ লিখেছেন সঙ্কলন-সম্পাদক নিত্যপ্রিয় ঘোষ। তাঁর ওই লেখাটিতে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের নাম প্রথম উল্লেখেই হয়েছে ‘সঞ্চয়’!
সাযযাদ কাদিরঃ সাংবাদিক,গবেষক ও সাহিত্যিক।।