ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ০৪

ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ০৪

জবরুল আলম সুমন:

সিলেট নামটির সাথে যে নামটি অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে আছে সেই নামটি হলো হযরত শাহজালাল (রঃ)। সিলেটকে বলা হয় বাংলার আধ্যাত্মিক রাজধানী, কেউ কেউ বলেন পূণ্য ভূমি, পবিত্র ভূমি। আর এই পবিত্র শব্দাবলী দিয়ে নামকরণের কারণ হলো ওলীকূলের শিরোমনী হযরত শাহজালাল (রঃ) এর স্থায়ী আবাস ছিলো সিলেটে। ইয়েমেনের তৎকালীন রাজধানী তাইজ এর অদূরবর্তী কুইন্যা’র শৈলপুরীতে ১২৭১ খৃষ্টাব্দে হযরত শাহজালাল (রঃ) জন্ম জন্মগ্রহণ করেন। হযরত শাহজালাল (রঃ) এর পিতা মোহাম্মদ বিন ইব্রাহিম কোরেশী এবং মাতা সৈয়দা হাসিনা ফাতিমা বিনতে জালালুদ্দিন সুরুখ বোখারী দুজনেই ছিলাম আরবের বিখ্যাত কুরাইশ বংশীয়। মোহাম্মদ বিন ইব্রাহিম কোরেশী ছিলেন তাইজের অদূরে আজজান দূর্গের আমীর এবং ইয়েমেনের সুলতান মালিক মোহাম্মদ শামসুদ্দিনের হাদীস শিক্ষক। হযরত শাহজালাল (রঃ) এর জন্মের পূর্বেই তিনি এক খন্ড যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। হযরত শাহজালালের দাদা ইব্রাহিম কোরেশীও ছিলেন একজন প্রখ্যাত দরবেশ এবং নানা জালালুদ্দিন সুরুখ বোখারীও ছিলেন একজন বড় মাপের ওলী। তিনি পাঞ্জাব ও রাজপুতনায় ইসলাম প্রচার করেন।

হযরত শাহজালাল (রঃ) এর বয়স যখন মাত্র তিন বছর তখন তার মমতাময়ী মাতা শাহাদত বরণ করেন। তখন মামা সৈয়দ আহমদ কবীর হযরত শাহজালাল (রঃ) এর লালন পালনের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন, তিনিও ছিলেন প্রখ্যাত আলেম এবং উঁচু দরের সাধক। হযরত শাহজালাল (রঃ) তার মামার কাছ থেকেই প্রাথমিক শিক্ষার পাঠসহ দ্বীনী তালিম এবং ইলমে মারেফাতের পাঠ গ্রহণ করেন। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কামিলিয়াতি হাসিল করেন এবং কামেলে ওলীর মর্যাদা লাভ করেন। তার বয়স যখন ৩০ বছর তখন তিনি স্বপ্নে হিন্দুস্থানে ইসলাম প্রচারের জন্য আদেশ লাভ করেন। স্বপ্নের কথা মামাকে বর্ণনা করলে তিনি তাকে হিন্দুস্থানে ইসলাম প্রচারের জন্য অনুমতি প্রদান করেন এবং সেই সাথে তাকে এক মুঠো মাটি দিয়ে নির্দেশ দিলেন যে স্বাদে, গন্ধে ও বর্ণে এই মাটি যে মাটির সাথে হুবহু মিলে যাবে সেখানেই বসতি গড়ে ইসলাম প্রচার করতে হবে। হযরত শাহজালাল (রঃ) এর হিন্দুস্থান যাত্রার খবর প্রকাশ হলে তার সাথে আরোও ১২ জন দরবেশ তার সফর সঙ্গী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাদের মধ্যে প্রখ্যাত দরবেশ হাজি ইউসুফ, হাজি দরিয়া ও হাজি খলিল ছিলেন বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। হযরত শাহজালাল (রঃ) তার সঙ্গীদের নিয়ে হিন্দুস্থানে যাত্রার পূর্বে মামার দেয়া মাটি একজন বিশিষ্ট শিষ্যের দায়িত্বে রাখলেন এবং তাকে আদেশ করলেন যাত্রা পদে বিভিন্ন জনপদের মাটির সাথে যেন এই মাটির তুলনা করে মিল খোঁজার চেষ্টা করেন।

সফর সঙ্গী নিয়ে হিন্দুস্থানের লক্ষ্যে যতই অগ্রসর হতে থাকেন ততই তার শিষ্য ও সফর সঙ্গী বাড়তে থাকে। রোম, বাগদাদ, সমরকন্দ, কিরমানশাহ, আরব, আফগানিস্থান, মুলতান, আজমীর হয়ে যখন তিনি দিল্লীতে পৌছান তখন তার শিষ্যের সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে যায়। দিল্লীর বিখ্যাত ওলী নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার কাছে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর আগমনের খবর পৌছালে তিনি শাহজালালের অস্থায়ী আস্তানাতে ছুটে যান এবং তাকে বুকে জড়িয়ে নেন। তাকে তার নিজ আস্তানায় নিয়ে আসেন। হযরত শাহজালাল (রঃ) যে ক’দিন দিল্লীতে ছিলে সে ক’দিন নিজামুদ্দিন আউলিয়ার আস্তানাতেই ধর্মালোচনা, মোরাকাবা, মোশাহাদা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। দিল্লী থেকে বিদায়ের মুহুর্তে নিজামুদ্দিন আউলিয়া হযরত শাহজালালকে দুটি কবুতর উপহার দেন। শাহজালালের দরগা সহ সিলেট অঞ্চলে নীল রংয়ের যে কবতুর দেখা যায় তা হলো ঐ কবুতরদের বংশধর। দিল্লী থেকে বিদায় নিয়ে তিনি বিহারে পৌছালে আরো বেশ কয়েকজন ওলী তার শিষ্যত্ব লাভ করে সফরসঙ্গী হন। বিহার হয়ে তিনি বাংলাদেশের সপ্তগ্রামে উপস্থিত হলে মুসলমান বাদশা তাকে সেখানে স্থায়ীভাবে থাকার অনুরোধ করেন কিন্তু ঐ স্থানের মাটির সাথে মামার দেয়া মাটির মিল না হওয়ায় তিনি সেখানে স্থায়ী হয়ে থাকতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

তৎকালীন সময়ে গৌড়ের রাজা ছিলেন গোবিন্দ। সে ছিলো অত্যান্ত শক্তিশালী, বদমেজাজী ও কুৎসিত। অনাচার, অবিচার ছিলো তার রোজকার ঘটনাবলীর আবশ্যকীয় উপাদান। তার ভয়ে প্রজারা সব সময় ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে থাকতো। তার সময়ে শহরের টুলটিকর মহল্লায় পরিবারসহ বাস করতেন বুরহান উদ্দিন নামের এক মুসলিম। বুরহান উদ্দিনের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হলে তিনি তার পুত্রের আকিকার জন্য গরু জাবাই করেন, গৌড় গোবিন্দের কানে এই সংবাদ পৌছালে গোবিন্দ বুরহান উদ্দিনের শিশু সন্তানকে হত্যা করে এবং বুরহান উদ্দিনের হাত কেটে দেয়। ঐ সময়ে দিল্লীর শাসনকর্তা ছিলেন ফিরোজ শাহ তুঘলক। বুরহান উদ্দিন তখন দিল্লীতে গিয়ে ফিরোজ শাহের সাথে দেখা করে গোবিন্দের অত্যাচারের কথা বর্ণনা করেন এবং এই অত্যাচারের বিচার দাবী করেন। ইতিমধ্যে সম্রাট ফিরোজ শাহের কাছে একই রকমের আরোও একটি অত্যাচারের খবর এসেছিলো। তরপের রাজা আচানক নারায়ণ নূরুদ্দিন নামের এক ব্যক্তিকে তার পুত্রের বিয়েতে গরু জবাই করার কারণে মৃত্যু দন্ডের আদেশ দিয়েছিলো। তখন সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলক তার ভাগনা সিকান্দর গাজীকে গৌড় রাজ্য অভিযানের আদেশ দিলেন। সিকান্দর গাজী ও তার সৈন্যদল বাংলাদেশের বর্ষা আবহাওয়ার যুদ্ধে ভালো অবস্থান নিতে পারেননি তাই তিনি ব্রহ্মপুত্রের তীরে তাঁবু ফেলে সম্রাটকে অবস্থা বর্ণনা করে আরোও সৈন্যদল পাঠানোর আবেদন জানালেন। সম্রাট তখন জ্যোতির্বিদগণের পরামর্শে সৈয়দ নাসিরুদ্দিনকে সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে চৌকশ একদল সৈন্য পাঠালেন।

হযরত শাহজালাল (রঃ) তখন ৩১১ শিষ্যের বহর নিয়ে এলাহবাদে পৌছেছেন। তার আধ্যাত্মিক শক্তির কথা তখন সর্বত্র প্রচারিত। সিপাহসালার নাসিরুদ্দিন তখন এলাহবাদে গিয়ে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করে গৌড় অভিযানের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন। হযরত শাহজালাল (রঃ) তখন তাকে অভয় দান করে গৌড় অভিযানে সকল শিষ্যসহ রওয়ানা দেন। যথা সময়ে সিপাহসালার নাসিরুদ্দিন তার সৈন্যদলসহ হযরত শাহজালালকে সঙ্গে নিয়ে সিকান্দর গাজীর সাথে যুক্ত হন। সামরিক শক্তির সাথে আধ্যাত্মিক শক্তির মিশ্রণে এক পরাশক্তি নিয়ে হযরত শাহজালাল (রঃ) গৌড় অভিযানের লক্ষ্যে সিলেট অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।

হযরত শাহজালাল (রঃ) তার শিষ্য ও সৈন্যদলসহ গৌড় রাজ্যের দক্ষিণ সীমার নবীগঞ্জের নিকট চৌকি নামক স্থানে পৌছালে গৌড় গোবিন্দের গেরিলা বাহিনীর আক্রমণের মুখোমুখি হন। কিন্তু গোবিন্দের গেরিলা বাহিনী হযরত শাহজালালকে ঠেকাতে পারেনি। হযরত শাহজালাল (রঃ) তার শিষ্যসহ সতরসতী পরগণার ফতেপুর গ্রামে পৌছালে সেখানে তাঁবু টাঙ্গিয়ে রাত্রি যাপন করেন এবং ভোরে আবারও রওয়ান হন। বাহাদুরপুরের নিকট বরাক নদীর তীরে পৌছালে দেখতে পান সেখানে নৌকা চলাচল বন্ধ রয়েছে, গৌড় গোবিন্দ হযরত শাহজালাল (রঃ) এর অভিযানের খবর পেয়ে নদীতে নৌকা চলাচল আগে থেকেই বন্ধ করে দিয়েছিলো। হযরত শাহজালাল (রঃ) তখন তার মৃগচর্মের জায়নামাজ পানিতে বিছিয়ে তার শিষ্য ও সৈন্যদল নিয়ে নদী পার হয়ে গেলেন। নদী পাড়ি দিয়ে পূর্ব দিকে যাত্রা করে শেখ ঘাটের দক্ষিণে অবস্থিত বর্তমান রেল ষ্টেশনের নিকটবর্তি সুরমা নদীর তীরে উপস্থিত হন। এখানে এসে দেখলেন সুরমা নদীতেও নদী পারাপার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাই আগের মতোই জায়নামাজ বিছিয়ে সুরমা নদী পাড়ি দিলেন। রাজা গৌড় গোবিন্দ তখন হতাশ হয়ে ছলনার আশ্রয় নিলো। গোবিন্দের একটা লৌহ নির্মিত ধনুক ছিলো। সেই ধনুকে তখন পর্যন্ত কেউই শর সংযোজন করতে পারেনি। তাই সে ঘোষণা করলো যে হযরত শাহজালাল (রঃ) বাহিনীর কেউ যদি এই ধনুকে শর যোজনা করতে পারে তবে বিনা যুদ্ধে সিলেটের শাসনভার ছেড়ে দেয়া হবে। হযরত শাহজালাল (রঃ) তখন সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরুদ্দিনকে নির্দেশ দিলেন শর যোজনার জন্য তিনি খুব সহজেই সেই ধনুকে শর সংযোজন করেন। গোবিন্দ তখন প্রাণ ভয়ে গড় দুয়ারে অবস্থিত তার দূর্গে আশ্রয় নিলো। হযরত শাহজালাল (রঃ) তখন গোবিন্দের প্রধান সেনাপতি মনারায়ের টিলায় উপস্থিত হয়ে শাহচট নামের এক শিষ্যকে আজান দেয়ার আদেশ করলেন। আজানের সুমধুর ধ্বনিতে মনারায়ের লৌহ কঠিন প্রসাদ ধ্বসে পড়লো মুহুর্তেই। সঙ্গে সঙ্গে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর বাহিনী আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে বিনাযুদ্ধে সিলেট জয় করে নিলেন। পরে রাজা গৌড় গোবিন্দ ধৃত হলে সে তার সব অপরাধ স্বীকার করলো এবং হযরত শাহজালাল (রঃ) তাকে ক্ষমা করে দেন। মুক্তি পেয়েও গোবিন্দ নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারলোনা তাই রাতের আঁধারে পালিয়ে সে তখন আট মাইল দূরে পেচাগড় দূর্গে আশ্রয় নিলো। তারপর থেকে গোবিন্দের আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। সিলেটের শাসন ক্ষমতা হাতে এলেও হযরত শাহজালাল (রঃ) নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। কারণ তিনি এসেছেন ইসলামের প্রচারে, বিভ্রান্ত মানুষকে পথের সন্ধান দিতে। তাই তিনি তার শিষ্যকে ইয়েমেন থেকে আনা মাটির সাথে সিলেটের মাটির তুলনা করতে নির্দেশ দেন। কি আশ্চার্য! সেই মাটির সাথে সিলেটের মাটির হুবহু মিল খোঁজে পেলেন স্বাদে, গন্ধে ও বর্ণে এবং সিলেটেই স্থায়ী ভাবে বসবাস করে ইসলাম প্রচারের সিদ্ধান্ত নিলেন।

সিলেট বিজয়ের পর হযরত শাহজালাল (রঃ) তার ভক্তদের মাঝে নুরুল হুদা আবুল কারামত সাঈদী হোসেইনী নামের এক দরবেশেকে সিলেটের শাসনকর্তার দায়িত্ব দেন পরবর্তি কালেই তিনি হায়দার গাজী নামেই পরিচিতি লাভ করেন। এরপর হযরত শাহজালাল (রঃ) স্বীয় আস্তানা স্থাপনে মনযোগী হন। সিলেট শহরে এক উঁচু টিলায় তার হুজরাখানা নির্মাণ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটান। ৩২ বছর বয়সে তিনি সিলেট বিজয় করে দীর্ঘ ৪৩ বছর বাংলা ও আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের বাণী প্রচার করে ৭৫ বছর বয়সে ১৩৪৬ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। সিলেট শহরের যে টিলায় তিনি হুজরা নির্মান করেছিলেন সেই এলাকা এখন দরগা মহল্লা নামে পরিচিত এবং তার মাজার সেখানেই অবস্থিত। তিনি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলার শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন এবং আছেন বলেই আজও বিশ্বের বিভিন্ন স্থান হতে সকল ধর্মের অসংখ্য ভক্তরা প্রতিদিন মাজার জিয়ারত করতে আসেন। সিলেটের ইতিহাসে হযরত শাহজালাল (রঃ) এক অবিস্মরণীয় পবিত্র নাম, বিশ্বের বুকে সিলেট যতদিন থাকবে হযরত শাহজালাল (রঃ) নাম ততদিন শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে উচ্চারিত হবেই।
চলবে…

_______________________________________________________________

পূর্বে প্রকাশিত লিংক সমূহ:–

*ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট- পর্ব ০১

*ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ০২

*ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ০৩


অতিথি লেখক