আলমগীর কুমকুম : সাহিত্য-সাংস্কৃতিক যোদ্ধা
স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ি যুদ্ধের পর যে ক’টি চলচ্চিত্র নির্মত হয়েছিল, তার মধ্যে বরেণ্য চিত্র পরিচালক আলমগীর কুমকুম পরিচালিত আমার জন্মভূমি অন্যতম। এর মধ্যে জীবন থেকে নেওয়া (১৯৭১) ছিল জহির রায়হান পরিচালিত একটি প্রতিবাদের নাম। মানুষ এ্ চলচ্চিত্র দেখতে এসে শুধু বিনোদনই পায়নি; পেয়েছিল প্রতিবাদের শিক্ষা। সেই শিক্ষার সূত্র ধরে পরবর্তীতে নির্মিত হয়েছে ওরা ১১ জন (১৯৭২) চাষী নজরম্নল ইসলাম পরিচালিত, বাঘা বাঙ্গালী (১৯৭২) আনন্দ পরিচালিত, জয় বাংলা (১৯৭২) ফকরম্নল আলম পরিচালিত, অরম্নণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২) সুভাষ দত্ত পরিচালিত, ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩) আলমগীর কবির পরিচালিত, আমার জন্মভূমি (১৯৭৩) আলমগীর কুমকুম পরিচালিত, সংগ্রাম (১৯৭৩) চাষী নজরম্নল ইসলাম পরিচালিত, আবার তোরা মানুষ (১৯৭৩) খান আতাউর রহমান, আলোর মিছিল (১৯৭৪) নারয়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত, বাংলার ২৪ বছর (১৯৭৪) মোহাম্মদ আলী পরিচালিত, কার হাসি কে হাসে (১৯৭৪) আনন্দ পরিচালিত, মেঘের অনেক রঙ (১৯৭৬) হারম্নন-উর-রশিদ পরিচালিত। সত্তর দশকের সবগুলো চলচ্চিত্রই ছিল স্বাধীনতার রঙধনুময় মমতামাখা কাহিনীর সূত্রতায় গাঁথা। যেখানে মায়ের মত দেশের জন্য সবাই লড়েছিল আমরণ। সেই সাহসকথার অনন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন আলমগীর কুমকুম। ‘আমার জন্মভূমি’ মানুষের মাঝে ব্যাপক আলোচিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নিয়ে কিছু কাজ হয় আশির দশকে। এরমধ্যে বাঁধন হারা (১৯৮১) এ. জে. মিন্টু পরিচালিত; কলমীলতা (১৯৮১) শহীদুল হক খান পরিচালিত এবং চিৎকার (১৯৮১) মতিন রহমান পরিচালিত উলেস্নখযোগ্য। নববই দশকে এসে মেঘের অনেক রঙ (১৯৯৩) হারন-উর-রশিদ পরিচালিত, একাত্তরের যীশু (১৯৯৩) নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু পরিচালিত, নদীর নাম মধুমতি (১৯৯৪) তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত, আগুনের পরশমণি (১৯৯৫) হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত, মুক্তির গান (১৯৯৫) তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত, হাঙ্গর নদীর গ্রেনেড (১৯৯৭) চাষী নজরম্নল ইসলাম পরিচালিত, মুক্তির কথা (১৯৯৯) তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত, শূণ্য দশকে এসে মাটির ময়না (২০০২) তারেক মাসুদ পরিচালিত, জয়যাত্রা (২০০৪) তৌকির আহমেদ পরিচালিত, শ্যামল ছায়া (২০০৪) হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত, খেলাঘর (২০০৬) মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত এবং প্রথম দশকে এসে আমার বন্ধু রাশেদ, গেরিলা এবং মেহেরজান নিয়ে এসেছে আমাদের চলচ্চিত্র। কিন্তুু সময়ের আয়নায় মুখ রাখলে দেখা যায়-যুদ্ধময় জীবনের কথা মূলত উঠে এসেছে ‘আমার জন্মভূমি’তেই। কেননা, চলচ্চিত্রটির নির্মাতা আলমগীর কুমকুম ছিলেন অন্য সবার চেয়ে আলাদা। তিনি একদিকে ছিলেন মক্তিযোদ্ধা; অন্যদিকে ছিলেন খাঁটি আওয়ামী লীগ কর্মী। যে কারনে অন্য নির্মাতাদের মত তিনি কথা ঘুরিয়ে বলেনন। সরাসরি বলেছেন জয়বাংলা’র কথা। সবসময়ই স্বাধীনতার স্বপক্ষে থাকা আলমগীর কুমকুম আমাকে ভালোবাসতেন। তাঁর ভালোবাসাময় সময়ের হাত ধরে এগিয়ে যেতে যেতে একদিন কথা হয় বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিষ্ঠাতা ও মুখপাত্র অরম্নন সরকার রানার সাথে। কুমকুম ভাই চেয়েছিলেন আম অন্যসব ছাত্রনেতাদের মত না হই। আম যেন হই সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চেতনাময় কর্মী। আর তাই অরম্ননদা’কে বলেছিলেন, মেহেদীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় কাজ করার সুযোগ করে দিও। সেই থেকে শুরম্ন সাংগঠনিক পথযাত্রা। এই যাত্রাপথে বিভিন্নসময় তাকে কাছে পেয়েছি। অসুস্থ শরীর নিয়েও চলে আসতেন তিনি। তাঁর এমন অনবদ্যপথ চলা আমাদেরকে্উৎসাহত করতো। তারানা হালিম এমপি আপুকে বিভিন্ন সময় বলতে শুনেছি-‘এমন নিবেদিত নেতা পাওয়া বর্তমানে কেবলই কল্পনা।’একদিকে সারাদিন দলের জন্য কাজ করেছেন, অন্যদিকে রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কর্মীদেরকে সংগঠিত করেছেন। তাঁর পথ ধরে এগিয়ে আসতে দেখেছি অনেককেই, কিন্তুু আলোকিত হতে দেখিনি কাউকে। কারন, বর্তমানের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোন সহনশীলতা নেই। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে তথাকথিত নেতারা। বিশেষ করে জাসাস থেকে আওয়ামী লীগার বনে যাওয়া অনেকেই সুযোগ নিয়ে গড়ে তুলেছে প্রতারণার ফাঁদ। যা বন্ধের জন্যও প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেছেন কুমকুম ভাই। এতকিছুর পরও চলে গেলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কুমকুম। চলে গেলেন আমার আরেকজন অভিভাবক। চলে গেলেন খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক আলমগীর কুমকুম । তিনি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। এসময় সরকারের পক্ষ থেকে তেমন একটা খোঁজ-খবরও নেয়া হয়নি। তিনি তবু আশ্বাস দিয়ে বলতেন, ব্যাসত্মতো সবাই, একটু শামত্ম হলে সবাই-ই আসবে, খোঁজ নিবে।’ তাঁর কথাই ঠিক হলো, নেত্রী খোঁজ নিতে আসলেন তখন, যখন আলমগীর কুমকুম চলে গেলেন অন্ধকারের দিকে। আলমগীর কুমকুম ছিলেন একজন গুণী নির্মাতা। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন শক্তিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংস্কৃতিকর্মীকে হারিয়েছে। চলচ্চিত্র শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিজ কমের্র জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। শুধু এই কথাই শেষ নয়, আলমগীর কুমকুমের মৃত্যুতে দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিবেদিতপ্রাণ একজন চলচ্চিত্র পরিচালককে হারিয়েছে। তিনি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের আলোকিত আগামী গড়ার কারিগর চিত্র পরিচালক ও সংগঠক আলমগীর কুমকুম ১৯৪২ সালের ২২ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের শ্রীনগরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে পরিচালক, প্রযোজক, প্রদর্শক ও পরিবেশক ছিলেন। এছাড়াও রাজনৈতিকভাবে তিনি আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতিও ছিলেন। আলমগীর কুমকুম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘আমার জন্মভূমি’ চলচ্চিত্রের নির্মাতা। সব মিলিয়ে তিনি প্রায় ৪০টি ছবি পরিচালনা করেছেন। তাঁর পরিচালিত উলেস্নখযোগ্য ছবিগুলো হলো ‘গুন্ডা’, ‘সোনার চেয়ে দামী’, ‘জীবন চাবি’, ‘কাবিন, ‘রাজবন্দী’ প্রভৃতি। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন আলমগীর কুমকুম। রাজনৈতিক সচেতন এই মানুষটি ছেষট্টির ছয় দফা ও ঊনসত্তরের গণঅভুত্থানে ভূমিকা রেখেছেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে তিনিই প্রথম বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের মাধ্যমে দেশের বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের ঐক্যবদ্ধ করে জঘন্য এই হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করেন। সোচ্চার ছিলেন জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচার নিয়েও। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতেও রেখেছেন গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা। শ্রীনগরে ‘‘ঝুমরি সিনেমা’’ এবং গজারিয়ার ভবেরচরে ‘আনন্দ মেলা’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর কুমকুম চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরম্নত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়াও ন্যায়ের পক্ষে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল স্মরণ রাখার মতো। আমার স্মৃতিতে তিনি শুধু একজন অভিভাবকই নন, একজন দেবতাতুল্য মানুষও ছিলেন। শেষ দেখা হয়েছিল ফেব্রম্নয়ারীর প্রথম সপ্তাহে। আমার লেখা ‘বঙ্গবন্ধু : রাজনীতি ও ভালোবাসায়’ বইটি যেদিন প্রকাশিত হয়, সেদিন প্রথম কপিটি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে দোয়া আনতে গেলে মলিন মুখে বলেছিলেন, ভালোকাজ সবসময় করতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে সকল বাঁধা পেরিয়ে।’ তাঁর সেই সকল বাঁধা পেরিয়ে শব্দটি এখনো কানে বাজছে। মনে হচ্ছে তিনি বলছেন, কখনো কঠিন কাজ দেখে পিছে হটে যাওয়া চলবে না…
মোমিন মেহেদী : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা mominmahadi@gmail.com