আমাদের স্বাধীনতায় আমাদের নারী সমাজ
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতার এই বর্তমানে একটি আলোচিত নাম ক্যাপটেন ড: সিতারা বেগম ‘বীর প্রতীক’। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য নরনারী অংশ গ্রহন করেছেন,যুদ্ধ করেছেন। এক এক জনের ত্যাগ এক এক রকম। বিশেষ করে যদি মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান এর কথা বলি তাহলে অসংখ্য বীরাঙ্গনার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। কিন্তু নারীরা কি শুধু বীরাঙ্গনা হয়েই ইতিহাসে থাকবেন ? না ঠিক তেমনটি নয়। নারীরাও সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছেন,রাইফেল হাতে পুরম্নষের পাশাপাশি যুদ্ধ করেছেন। যেমন-তারামন বিবি। যিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরম্নত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর প্রতীক’ উপাধি পেয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে। ডঃ ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম হলেন বীর প্রতীক প্রাপ্ত এরকম আর এক নারী মুক্তিযোদ্ধা। যে নারী মুক্তিযোদ্ধা মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য বীর প্রতীক প্রাপ্ত তিনি হলেন ডঃ ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম। সিতারা ১৯৪৫ সালে কলকাতা শহরে জন্মগ্রহন করেন। তিন বোন ও ২ ভাইয়ের ভেতর তিনি ছিলেন তৃতীয় । তাঁর বাবা মোঃ ইসরাইল মিয়ার পেশায় ছিলেন আইনজীবী।তাঁর সাথে কিশোরগঞ্জে সিতারা বেগম তার শৈশব কাটান। সেখান থেকে মেট্রিক পাশ করার পর হলি ক্রশ কলেজে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন।ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করার পর তিনি সেনামেডিকেলে(Army Medical) লেফটেন্যান্ট হিসাবে যোগ দেন।১৯৭০ সালের উত্তাল দিনগুলোতে সিতারা বেগম কুলিলস্না ক্যান্টনমেন্টে নিয়োজিত ছিলেন। সেই সময় তাঁর বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা মেজর এ,টি,এম, হায়দার পাকিসত্মান থেকে কুমিলস্নায় বদলি হয়ে আসেন। তিনি কুমিলস্নার ৩য় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নে যোগ দেন।১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারীতে সিতারা ও তার ভাই হায়দার ঈদের ছুটি পালন করার জন্য তাদের কিশোরগঞ্জের বাড়িতে যান।কিন্তু সেই সময়ে দেশ জুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরম্ন হয়ে গেছে।হায়দার তার বোনকে ক্যান্টনমেন্টে আর ফিরে না যাবার জন্য বলেন।পরবর্তিতে তিনি তার বোন সিতারা ,বাবা-মা ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে পার্শবর্তী দেশ ইন্ডিয়াতে পাঠান।কিশোরগঞ্জ থেকে মেঘালয়া পৌচ্ছাতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লেগে যায়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য সেখানে বাংলাদেশ মেডিকেল (The Bangladesh Medical) নামে প্রায় ৪০০ বেডের একটি হাসপাতাল ছিলো।ঢাকা মেডিকেলের শেষ বষের্র অনেক ছাত্র সেখানে ছিলো।ক্যাপ্তেন ডঃ সিতারা সেক্টর-২ এর অধীনে সেখানের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন।তাঁকে নিয়মিত আগরতলা থেকে মেডিসিন আনার কাজ করতে হতো।হাসপাতালে একটি অপারেশন থিয়েটর ছিলো।যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা,বাঙালী ছাড়াও সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লোক জন চিকিৎসাসেবা নিত।১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর ডঃ সিতারা রেডিওতে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সংবাদ শুনে ঢাকা চলে আসেন।পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে তাঁর ভাই মেজর হায়দায় খুন হলে ডঃ সিতারা ও তাঁর পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান এবং আমেরিকায় স্থায়ী ভাবে থাকা শুরম্ন করেন। ডঃ সিতারা বেগম সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন নি।আসলে যুদ্ধের জন্য কাউকে যেমন রাইফেল ,স্টেন গান হাতে নামতে হয়ে ছিলো,কেউ আবার নিরলস ভাবে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন। কেউ গান শুনিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক ভাবে প্রসত্মুত করতেন।এদের সবাই মুক্তিযোদ্ধা।১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ক্যাপ্টেন ডঃ সিতারা বেগমের অসামান্য অবদানের জন্য তৎকালীন সরকার তাঁকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভুষিত করে। মুক্তিযোদ্ধার মা ও মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারী হচ্ছে দেশের শ্রেষ্ঠ নারী। সেই নারীদের স্বীকৃতি না দিলে স্বাধীনতা অর্জন অপূর্ণ থেকে যাবে। একই সঙ্গে তারা সরকারের কাছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত কার্যকর করার আহবান জানিয়ে আসছে দেশের নারী সংগঠনগুলো। মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজের অবদান আজও আনুষ্ঠানিকভাবে মূল্যায়িত হয়নি। সেই সময় অস্ত্র হাতে যারা যুদ্ধ করেছিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়া, অস্ত্র সংরক্ষণ, শত্রুর অবস্থান ও গতিবিধির তথ্য সংগ্রহ, অর্থ-খাদ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের যারা সাহায্য করেছিল তারা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা। সেই অর্থে আমাদের দেশের শত করা ৫০ জন ষাটোর্ধ নারী-ই মুক্তিযোদ্ধা। কেননা, যুদ্ধের সময় পুরম্নষগুলো দু’ভাগে ভাগ হলেও নারীরা ছিলো এক এবং অভিন্ন সিদ্ধামেত্ম অটল। তারা দেশকে ভালোবেসে এগিয়ে গেছেন স্বপ্নময় সকালের মত করে। সেই তাদের-ই একজন আমেনা বেগম। যিনি বিয়ের মাত্র ১২ দিন পর যুদ্ধে যোগদান করেন। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা মা আমেনা বেগম মুক্তিযুদ্ধে গিয়েই ক্ষাত্ম থাকেননি। দিয়েছেন প্রচন্ড শ্রম, এই দেশ এই মাটি আর মায়ের জন্য। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারী যোদ্ধাদের ছিল অবিস্মরণীয় অবদান। সম্মুখ যুদ্ধে খুব বেশি সক্রিয় না থাকলেও গেরিলাদের জন্য অস্ত্র পরিবহণ,তথ্য সংগ্রহ এবং আদান প্রদান ইত্যাদি বিপজ্জনক কাজে নারীরা সহায়তা করতেন নিয়মিত। এসব কাজে ঝুঁকিও ছিল মারাত্মক। অস্ত্রসহ ধরা পরলে বিনা বিচারে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো ক্যাম্পে এবং চলতো অমানুষিক নির্যাতন। তার উপর অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার ব্যাপারে পরিবার থেকেও ছিল নিষেধাজ্ঞা। এসব হাজার হাজার প্রতিকূলতার মাঝেও কিছু নারী নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেসময় নিয়মিত সাহায্য করে গিয়েছিলেন আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের। অনেকে আবার নিয়মিত বাহিনীর সাথে ট্রেনিংও নিয়েছিলেন, তাদেরই একজন মুক্তিযোদ্ধা আমেনা বেগম। সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার বাহিরগোলার আমিনা বেগম মিনা (৫৯) একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর মুক্তিযুদ্ধ সনদ নম্বর : ম ৭২৬২৫। তাঁর স্বামী আজিজুল হক বকুলও একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন কোন কিছু পাওয়ার আশায় নয়; কেবলই মায়ের মত মাটি আর বাংলাদেশকে ভালোবেসে। আর তাই বিয়ের মেহেদী হাতেই অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। জীবনকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন মাটি আর মায়ের জন্য। এমন অসংখ্য আমেনা বেগম মিনা আমাদের দেশের আনাচে কানাচে রয়েছেন। যাদের মূল লÿ্য একটি স্বাধীন ভূখন্ড ছিল; কোন লোভ বা মোহ নয়। যদিও আজ মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে বিভিন্নভাবে ফায়দা হাসিলের চিত্র দেখা যায়। কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা দেশের জন্য লড়েছেন বলেই থাকেন সবার চেয়ে আলাদাভাবে। সেই আলাদাভাবে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা প্রয়োজনে রিক্সা চালাচ্ছেন, তবুও কারো সাথে আপোষ করছেন না। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কখনোই টাকার জন্য, একটু আরাম আয়েশের জন্য কারো সাথে আপোষ করেন না। দৃঢ় চিত্তে কথাগুলো বললেন আমিনা বেগম মিনা। তাঁর এই সাহসকথাই প্রমাণ করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কখনোই কিছু পাওয়া লক্ষা থেকে যুদ্ধে অংশ নেননি। আমাদের তারামন বিবি বা আমেনা বেগম মিনাদের মত সিতারা বেগমদের মত শত শত মা- বোন বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন তখন। সেই রক্তক্ষায়ি যুদ্ধসময়গুলোতে তাদের অবদান ছিল অনস্বিকার্য। সেই সাহসের পথ ধরেই আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেখেছে আলোকিত লাল সূর্য। তারপর ১৯৭২ এ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে পাবনার বেড়া, সুজানগর, সাঁথিয়ার ফসলি জমিন যমুনার পস্নাবন থেকে রক্ষার জন্য নগরবাড়ি ঘাট থেকে কাজীরহাট বাঁধ নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করতে গিয়ে নিজ হাতে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে টুকরি ভরে বাঁধ এর জন্য খননকৃত স্থানে ফেলেছেন। তারপর মঞ্চে ভাষণ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ জনসমাবেশ ঠেলে মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছাতে চাওয়া কজন নারী বাধাগ্রস্থ হচ্ছিলো, আয়োজক কমিটি সেবকদের দ্বারা আর সেদিকেই বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি পড়ায় তিনি তক্ষুণি মাইকে নির্দেশ দেন ‘ ওদের আসতে দাও ‘ বলে। আঁচলে চোখ মুছতে-মুছতে বঙ্গবন্ধুর কাছে মঞ্চে নতজানু হয়ে বসে তারা শোনায় আলবদর-আলশামস-রাজাকারদের যোগসাজশে পাকবাহিনীর হাতে তাদের চরম লাঞ্ছিত হওয়ার কষ্টময় কাহিনী। শুনে বাকরম্নদ্ধ প্রায় বঙ্গবন্ধু তখনই ঘোষণা দেন ‘ আজ থেকে পাকবাহিনী নির্যাতিত মহিলারা সাধারণ মহিলা নয় তারা আজ থেকেই বীরাঙ্গনা খেতাব এ ভূষিত।’ সেদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন ‘ দেশের জন্য তারা ইজ্জত দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে তাদের অবদান কম নয়, বরং কয়েক ধাপ উপরে, যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবেনা। তাই তাদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে, যথারীতি সন্মান দেখাতে হবে। আর সেই স্বামী বা পিতাদের উদ্দেশ্যে বলছি যে আপনারাও ধন্য। কেননা এমন ত্যাগী ও মহৎ স্ত্রীর স্বামী বা কন্যার পিতা হয়েছেন।’ আজ বঙ্গবন্ধু নেই। পিতৃহীন জাতি চলিস্নশ বর্ষের অনেক অপালন অনেক অন্যায় বিভ্রামিত্মর শিকার হয়ে ইতিহাসের গৌরবজনক শিক্ষাবঞ্চিত বলা যায়। তাইতো আজও আমরা জানিইনা এদেশে কতজন বীরাঙ্গনা মা-বোন এর মৃত্যু হয়েছে, কতজন তলিয়ে গেছে আত্মমর্যাদার অভাবে, শিকার হয়েছে ধর্মান্ধতার-অশিক্ষা-কুশিক্ষার-অপমানিত জীবন-জীবিকার অনলে। যে ক’জন নারী আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বিকৃতি পেয়েছেন সেই ক’জন নারীকে নিয়ে প্রতিবছর স্বাধীনতার এই মাসে অমত্মত একটা অনুষ্টানের আয়োজন হতে পারে। যেখানে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে জাতির নতুন প্রজন্মের সাথে। সেখানে এই বীর নারীরা বলবেন, যুদ্ধদিনের সাহসকথা…
mominmahadi@gmail.com