ভয়াবহ ঝুঁকিতে মেঘনা সেতুর তিনটি পিয়ারঃ ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে চালু হচ্ছে ফেরি সার্ভিস!
বিশেষ প্রতিনিধি, এসবিডি নিউজ২৪ ডট কমঃ প্রায় আট বছর ধরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় থাকা মেঘনা সেতুর মেরামত কাজ কবে শুরু হবে তার সঠিক সময় বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে সেতুর তিনটি পিয়ার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যোগাযোগ করা হলে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, সেতু মেরামতের জন্য জাইকার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মেঘনা সেতুসহ তিনটি বড় সেতুর বিকল্প আরও তিনটি সেতু নির্মাণের ব্যাপারেও আলাপ-আলোচনা চলছে। ৯ ফেব্রুয়ারী থেকে মেঘনা সেতু এলাকায় অতিরিক্ত ওজনবাহী যানবাহনের জন্য ফেরি সার্ভিস চালু করার কথা থাকলেও সরেজমিন দেখা গেছে, গত সোমবার পর্যন্ত ঘাট প্রস্তুত হয়নি। সড়ক ও জনপথ বিভাগের চারটি ফেরি এলেও চলাচল উপযোগী হয়েছে দুটি। বিআইডবি্লউটিএর দুটি পন্টুন মেঘনা নদীতে ভাসতে দেখা গেলেও আসেনি বিআইডবি্লউটিসির কোনো ফেরি। সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী আমিনুর রহমান লস্কর জানান, জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে শুধু অতিরিক্ত ওজনবাহী যানবাহনের জন্য ৯ ফেব্রুয়ারি ফেরি সার্ভিস চালু হচ্ছে।
যে কারণে ঝুঁকিতে মেঘনা সেতু : ২০০৪ সালে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নিজস্ব পরিদর্শন রিপোর্ট এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সাল থেকেই সেতুটি অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ২০০৮ সালে নামকাওয়াস্তে মেরামত করা হলেও বর্তমানে সেতুর ৭, ৮ ও ৯নং পিয়ারের নিচের অংশ মাটিশূন্য অবস্থায় রয়েছে। এর ফলে যে কোনো মুহূর্তে এ সেতুতে ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক জরুরি বৈঠক করে সেতুর ৭, ৮ ও ৯নং পিয়ারের মধ্যবর্তী অংশ দিয়ে সব ধরনের নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত ওজনবাহী ট্রলার চলার কারণে প্রপেলারের আঘাতে সেতুর পিয়ারের মাটি সরে গেছে। ডুবুরিরা পর্যবেক্ষণ করে এসে জানিয়েছেন, ওই তিনটি পিয়ার এক অর্থে ঝুলন্ত অবস্থায় আছে। ৭নং পিয়ারের সঙ্গে কিছু মাটি থাকলেও ৮ ও ৯নং পিয়ার একেবারেই ঝুলন্ত অবস্থায়। জাপানের অর্থায়নে নির্মিত মেঘনা সেতু দিয়ে ১৯৯১ সালে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। ১ ফেব্রুয়ারি এই সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। জাপান সরকারের অর্থায়নে সেতু নির্মাণের দায়িত্বে ছিল জাপানের নিপ্পন কোই কোম্পানি। সেতুটি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের সময় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের গাইডলাইনে বলা হয়, যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে কমপক্ষে ৫০ বছর বড় ধরনের সংস্কার ছাড়াই সেতুটি সচল থাকবে। ২০০৪ সালের বিশেষজ্ঞ রিপোর্টের পর ২০০৫ সালের শুরুতে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের একটি বিশেষজ্ঞ দল পরিদর্শনে এসে সেতু ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণ হিসেবে যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি বলে মন্তব্য করে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৩ সালের মে-জুন মাস থেকে এ সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচলের সময় কম্পন অনুভূত হয়। ধীরে ধীরে কম্পন বাড়লে এবং এক্সপানশন জয়েন্টের নাট-বোল্ট খুলে যেতে শুরু করলে সড়ক ও জনপথ বিভাগ একটি বিশেষজ্ঞ পরিদর্শন দল পাঠায় সেতু এলাকায়। পরিদর্শন দল ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে রিপোর্ট দেয়। রিপোর্টে ৮ এবং ৯ নম্বর পিয়ার, বাঁ পাশের রেলিং, দুই বর্গমিটার ডেক, দুই বর্গমিটার স্লোপ প্রটেকশন, ৬ বর্গমিটার এক্সপানশন জয়েন্ট মেরামত এবং ১২ বর্গমিটার অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণের সুপারিশ করা হলেও শুধু রেলিং এবং এক্সপানশন জয়েন্টের কিছু অংশ সেতু সচল রেখেই মেরামত করা হয়। ২০০৭ সালের অক্টোবরেই সেতুর এক্সপানশন জয়েন্টগুলো খুলে গেলে আবারও মেরামত জরুরি হয়ে পড়ে। মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত হতে প্রায় এক বছর পার হয়ে যায়। শেষে ২০০৮ সালের নভেম্বরে ক্ষতিগ্রস্ত এক্সপানশন জয়েন্টে আবার মেরামত কাজ শুরু হয়। এ সময় যাত্রীবাহী বাস ও সীমিত ওজনের পণ্যবাহী পরিবহন ছাড়া অন্যান্য যানবাহনকে কাঁচপুর ব্রিজ থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক হয়ে ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়নামতি হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে উঠে চলাচল করতে হয়। প্রায় ৩২ দিন মেরামত কাজ চলে। সে সময় শুধু এক্সপানশন জয়েন্ট মেরামত করা হলেও ২০০৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৮ ও ৯ নম্বর পিয়ারে কোনো মেরামত কাজ করা হয়নি। ফলে বর্তমানে এ দুটি পিয়ারের সঙ্গে ৭ নম্বর পিয়ারটিও অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে চলে এসেছে। এ ব্যাপারে একজন প্রকৌশলী জানান, এ সেতুর ওপর দিয়ে অতিরিক্ত মালবাহী ট্রাক চলাচলের কারণে এক্সপানশন জয়েন্ট যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি নদী দিয়ে অতিরিক্ত ওজনবাহী ট্রলার চলার কারণে পিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে তিনটি পিয়ার মেরামতের জন্য যা খরচ হবে তা দিয়ে এ সেতুর অর্ধেক সমান একটি সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। বিকল্প ফেরি সার্ভিস নিয়ে সংশয় গত সোমবার মেঘনা সেতু এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, মেঘনা নিউ টাউন থেকে ফেরিঘাট পর্যন্ত সংযোগ সড়কের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। তবে ঘাটে বসেনি পন্টুন। নদীতীর ঘেঁষে সড়ক ও জনপথের দুটি ফেরি সচল করার কাজ চলছে। এখানে কর্তব্যরত উপ-সহকারী প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেন জানান, অন্য চারটি স্থান থেকে চারটি ফেরি নিয়ে আসা হয়েছে। সোমবার দুপুর পর্যন্ত দুটি ফেরির ইঞ্জিন লাগানো হয়েছে। অপর দুটি ফেরির ইঞ্জিন লাগানোর কাজও চলছে। তবে বিআইডবি্লউটিসির ফেরি এখন পর্যন্ত আসেনি। বিআইডবি্লউটিএর দুটি পন্টুন এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিআইডবি্লউটিসির ফেরির ভাড়া নিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ার কারণেই ওই ফেরি আসেনি। বিআইডবি্লউটিসির চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা কামাল বলেন, ৯ ফেব্রুয়ারির আগেই একটি ফেরি যাবে। ভবিষ্যতে বেশি প্রয়োজন হলে দেওয়া হবে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী আমিনুর রহমান লস্কর বলেন, আমরা এরই মধ্যে বিকল্প ফেরি সার্ভিসের জন্য ঘাট প্রস্তুত করেছি। আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে শুধু অতিরিক্ত ওজনবাহী যানবাহনের জন্য ফেরি সার্ভিস চালু হবে। পরে পর্যাপ্ত ফেরি পাওয়া গেলে অন্যান্য যানবাহনও ফেরিতে পারাপারের ব্যবস্থা করা হবে।