ঐতিহাসিক ৭ মার্চ
আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের এইদিনে পাকিস্তানের শাসন-শোষণের হাত থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্তির দিশা দিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) জনসমুদ্রে ঘোষণা করেছিলেন : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আজ পালিত হবে সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার ৪১তম দিবস।
তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আসন্ন হামলা প্রতিরোধের প্রস্ত্ততি গ্রহণের জন্য দেশবাসীকে আহবান জানিয়ে বঙ্গবন্ধুু বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে… প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।’ এই ভাষণ বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপরেখা ঘোষণা তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক হিসেবে বিশবব্যাপী স্বীকৃত হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু তার দীপ্ত কণ্ঠে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে ঘোষণা করেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাংলার মানুষ মুক্তি চায়। বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’
বঙ্গবন্ধুুর এ তেজোদ্দীপ্ত মুক্তির বাণী শোনার জন্য সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ দলে দলে হেঁটে, বাসে-লঞ্চে-ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে নারী-পুরুষের স্রোতে সয়লাব হয়ে যায় ঘোড়দৌড়ের এই বিশাল ময়দান। বয়স, পেশা, সামাজিক মর্যাদা ভুলে সর্বস্তরের মানুষ হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধুু’ ধ্বনি আর চোখে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে নেতার নির্দেশ শোনার জন্য উপস্থিত হয়। বসন্তের পাতাঝরা দিন শেষে বৃক্ষশোভিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শিশু পার্কের যে জায়গায় এখন গাছে গাছে সবুজ কুঁড়ি উঁকি দিচ্ছে, একাত্তরের এইদিনে সেখানেই অঙ্কুরিত হয়েছিল আজকের বাংলাদেশ। শুধু স্বাধীনতাযুদ্ধে নয়, আজও বঙ্গবন্ধুর সেই দৃপ্ত কণ্ঠস্বর বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত অনুপ্রাণিত করে। বঙ্গবন্ধু মাত্র ২০ মিনিটের বক্তৃতায় সেদিন সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির মনের সব কথাই বলে দিয়েছিলেন।
বিকাল সোয়া ৩টায় বঙ্গবন্ধু সভামঞ্চে আসেন। জনতা করতালি ও আকাশ কাঁপানো শ্লোগানে নেতাকে অভিনন্দন জানায়। বঙ্গবন্ধুও হাত নেড়ে অভিনন্দন জানান জনতার সমুদ্রকে। বঙ্গবন্ধু তার প্রায় ২০ মিনিটের ভাষণে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের রূপরেখা তুলে ধরেন জনতার সামনে। স্বগর্বে ঘোষণা করেন বাঙ্গালির হাজার বছরের স্বাধীনতার আকাঙ্খা। মন্ত্রমুদ্ধের মতো লাখ লাখ শ্রোতা বাঙ্গালি শোনেন : ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাঝেই শোনা যায় জনসমুদ্রের গর্জন, আনন্দধ্বনি। জনতার কণ্ঠে ‘জাগো জাগো- বাঙালি জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা- শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধুু’ শ্লোগানে শ্লোগানে ঢাকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছিল তখন। সেদিন বেতার কর্তৃপক্ষের পূর্ব ঘোষণা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার না করার প্রতিবাদে বাঙালি কর্মচারীরা তাৎক্ষণিক ধর্মঘট শুরু করায় বিকাল থেকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। গভীর রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ প্রচারের অনুমতি দেয়। পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধুুর ভাষণ দিয়েই ঢাকা বেতার কেন্দ্র পুনরায় চালু হয়। সন্ধ্যায় ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এয়ার মার্শাল আসগর খান (অব.) সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং অনতিবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদাত্ত আহবান জানান। তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদান সম্পর্কে আওয়ামী লীগ প্রধান রেসকোর্সের জনসভা থেকে যে শর্ত দিয়েছেন তা ন্যায়সঙ্গত, উপযুক্ত, সুষ্ঠু ও বৈধ। রাতে বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্টের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আকস্মিক ও অবাঞ্ছিতভাবে স্থগিত ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত নিরপরাধ বেসামরিক অধিবাসীদের ওপর সামরিক বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করেছে। পরিষদ অধিবেশন খামখেয়ালিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার ফলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণ করতে গিয়ে তারা মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহবান প্রসঙ্গে বলেন, প্রেসিডেন্ট যদি আন্তরিকভাবে মনে করেন জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সার্বভৌম সংস্থা হিসাবে জাতীয় পরিষদকে কার্যকর করা উচিত, তাহলে আমার এসব দাবি অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে।
প্রকৃত অর্থে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সমগ্র ইতিহাসে বিরল। তিনি তার ভাষণের মাধ্যমে এদেশের মানুষের মনে মুক্তির ও স্বাধীনতার ছাপ এমন গভীরভাবে এঁকে দিয়েছিলেন যে, তা আর মুছে ফেলা যাবে না।’ বঙ্গবল্পব্দু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ। অনেকের ধারণা, জিয়াউর রহমান একটি বইয়ে জেনারেল ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক না বলে সর্বাধিনায়ক লিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খাটো করার চেষ্টা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।
মূলত ৭ মার্চ একদিনে আসেনি। এটি ছিল বহু প্রতীক্ষার একটি বিশেষ দিন। এ দিনই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল।
ইতিহাস নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে পাশ^র্নায়ককে নায়ক বানানোর চেষ্টা কোনো দিনই সফল হবে না। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাধ্যমে দেশের আপামর জনসাধারণকে একসূত্রে গেঁথে ফেলেছিলেন। কিন্তু যে বাংলাদেশ সৃষ্টির চেষ্টায় বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাঙ্গালি জাতিকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন, তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতোটা গ্রহণ যোগ্য? ২০০৮ সালের এই দিনে নকশা জালিয়াতির দায়ে জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিকউল্ল্যাহ খান মাসুদকে ৭ বছর সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়েছিল। এ মামলায় রাজউকের সাবেক অথরাইজড অফিসার এসএম আসাদুজ্জামানকেও একই দন্ডে দন্ডিত করা হয়েছিলো। এছাড়া তাদের প্রত্যেককে ৬ কোটি ২ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়েছিলো। জাতীয় সংসদ ভবন সংলগ্ন এমপি হোস্টেলে স্থাপিত ছয় নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক তানজীনা ইসমাইল গত ৬ মার্চ’০৮ (বৃহস্পতিবার) এ রায় ঘোষণা করেছিলেন। এছাড়া জ্ঞাত আয়-বহির্ভূতভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আতিকউল্ল্যাহ খান মাসুদ ও তার স্ত্রী-পুত্রের বিরুদ্ধে অপর একটি মামলায় গত ৫ মাচ’০৮ সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। পুরাতন ঢাকার হোসেনি দালান রোডে ষষ্ঠ তলা ও নবম তলা দুটি ভবনের নকশা জালিয়াতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-সহকারী পরিচালক মাহমুদ হাসান ২০০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এ মামলা করেন। মামলায় অভিযোগে বলা হয়, অনুমোদনের জন্য দুটি ভবনের নকশা রাজউকে দাখিল করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী বিল্ডিং কমিটির সভায় তা অনুমোদন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টি বিল্ডিং কমিটির সভায় উপস্থাপন না করেই অথরাইজড অফিসার আসাদুজ্জামান নিজে সই ও সিলমোহর দিয়ে তা সরবরাহ করেন। আতিকউল্ল্যাহ খান মাসুদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এটা করা হয়। এরপর ভবন নির্মাণ করে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে লাভবান হন তারা। দুঃখজনক হলেও সত্যি এতো অভিযোগে অভিযুক্ত জনাব মাসুদ এখন মুক্ত। বুক ফুলিয়ে তিনি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিশেষ প্রক্রিয়ায় তার শাস্তি শিথীল করা হয়েছে।
এমন অসংখ্য দুর্নীতি পরায়ন ব্যক্তিবর্গের ভারে এ দেশ আজ বড় বেশি ভারাক্রান্ত। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পিলখানার ঘটনায় সারা দেশ এখন শোকাহত। এমন একটি দেশের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু নিশ্চয়ই কল্পনা করেননি। আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মমার্থ উপলদ্ধি করা। নতুন প্রজন্মের কাছে একটি আদর্শ বাংলাদেশের চিত্র উপন্থাপন করাই এখন সময়ের মুখ্য দাবি। আর এ দাবিটি রক্ষা করতে সকলকে হাতে-হাত রেখে সততা ও নিষ্ঠার সাথে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে…।
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।।
jsb.shuvo@gmail.com