আতঙ্কের সঙ্গে বসবাস
সাযযাদ কাদিরঃ
রাজধানী ঢাকায় বিরাজমান আতঙ্কের তালিকায় এখন অনেক নাম। অপরাধমূলক তৎপরতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, যানজট, লোডশেডিং, গ্যাস-পানির সঙ্কট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ছাড়াও গত মে-জুন মাসে নতুন দু’টি নাম যুক্ত হয়েছে ওই তালিকায় – বেগুনবাড়ি ও নিমতলি। রাজধানীর তেজগাঁও ও লালবাগ এলাকার দু’টি অবহেলিত এলাকা। তেজগাঁও এলাকার বেগুনবাড়িতে এক ছ’ তলা ভবন ধসে পড়ায় প্রাণহানি ঘটে ২৫ জন মানুষের। এর পর-পর আরেক ছ’ তলা ভবন হেলে পড়ে মিরপুরের মাজার রোডে। আতঙ্ক ব্যাপক হয়ে ওঠে যখন এরই মধ্যে আরেক বহুতল ভবন হেলে পড়ে তেজগাঁওয়ের হাতিঝিল এলাকায়। সঙ্গে-সঙ্গে খোঁজ-খোঁজ শুরু করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। শনাক্ত করা হয় অনুমোদন ছাড়া অপরিকল্পিত ভাবে নির্মিত ৭২টি বিপজ্জনক ভবন। বলা হয়, সেগুলো ভেঙে ফেলা হবে শিগগিরই। এরই মধ্যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে লালবাগের নিমতলিতে। সেখানে প্রাণ হারান ১২১ জনের বেশি মানুষ। আতঙ্ক এবার ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। নির্মাণ ও তদারকে সমন্বয়হীন এক উন্নয়নের চেহারা নগ্ন হয়ে পড়ে সবার সামনে। এরপর থেকে ঢাকার বেশির ভাগ মানুষ বসবাস করে আসছে মৃত্যুহিম আতঙ্কে সঙ্গে – কখন কোথায় ধসে পড়ে কোন ভবন, কোথায় কখন আগুন লাগে হঠাৎ!
বেগুনবাড়ি ও নিমতলি ট্র্যাজেডির পর কর্তৃপক্ষের যেন ঘুম ভাঙে অবশেষে। আপাতত মনে হয় সে রকমই। দু’টি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করা হয় প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে। বিপজ্জনক ভবন ও অননুমোদিত কাঠামো শনাক্ত করার কাজে সহায়তা করবেন তাঁরা – যাতে ওই সব অবৈধ নির্মাণের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায় দ্রুত। টাস্কফোর্স দু’টিকে আরও দেয়া হয় আবাসিক এলাকায় অবৈধ কারখানা ও রাসায়নিকের দোকান খুঁজে বের করার দায়িত্ব। সেগুলো উচ্ছেদ করার সুপারিশও করবেন তাঁরা।
বেগুনবাড়ির ভবনধস ও নিমতলির অগ্নিগ্রাস – এই যুগল ট্র্যাজেডি এখন দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে ফিরছে নগরবাসীকে। সবাই বুঝতে পারছেন কত বিপন্নতার মধ্যে তাদের বসবাস করতে হচ্ছে এই নগরে। সেই সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এক বিস্ময়কর, এক বেদনাবহ সত্য – বছরের পর বছর ধরে কত অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে আমাদের গর্বের রাজধানী ঢাকা। কত অনিয়ম, অব্যবস্থা, দুর্নীতি জড়িত হয়ে পড়েছে এর রন্ধ্রে-রন্ধ্রে!
বস্তুত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকের অভাবে আর অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে যেখানে সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে অসংখ্য অননুমোদিত ভবন ও কাঠামো। ফলে তছনছ হয়ে গেছে রাজধানীর মূল স্থাপত্যিক পরিকল্পনা। নগরবাসীর জীবনও পড়েছে ঝুঁকির মধ্যে। কিন্তু রাজউক-এরই বা কতখানি কি করার আছে! নীতিমালা মেনে, উন্নত সামগ্রী ব্যবহার করে, প্রকৌশলিক ত্রুটি ছাড়া কোনও ভবন নির্মিত হচ্ছে কিনা তা দেখার মতো প্রয়োজনীয় জনবল বা ব্যবস্থা নেই তাদের। সীমিত তদারক-ক্ষমতা নিয়ে এত ব্যাপক একটা পরিস্থিতি সামাল দেয়া সত্যিই এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। ফলে যা নয় তা-ই হচ্ছে। ক’ দিন আগে জানা গেল রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র পরিবাগের এক বহুতল ভবন সম্পর্কে। এর আদ্যন্ত কিছুই নাকি জানা নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। অথচ সকলের চোখের ওপর নির্মিত হয়েছে একটির পর একটি করে মোট বারোটি তলা!
রাজউক কেবল খোঁজখবর নেয় তাদের অনুমোদিত নকশা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মীয়মান ভবনগুলো সম্পর্কে। তবে ওই সব ভবনে ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রী দুর্বল কিনা বা কোথাও কোনও প্রকৌশলিক ত্রুটি আছে কিনা – সেসবের খোঁজ নেয় না তারা। একের পর এক সরকার ও প্রভাবশালী মহল নিজেদের স্বার্থে, অনেক ক্ষেত্রেই, প্রায় অকার্যকর করে রেখেছে রাজউককে। অপরিকল্পিত নগরায়নের যে বিপদ তার সূচনা এখান থেকেই। রাজউক এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি ভবন শনাক্ত করেছে যেগুলো নির্মিত হয়েছে নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত নকশা ও পরিকল্পনায় ব্যত্যয় ঘটিয়ে। আর ১৫ হাজারেরও বেশি ভবন শনাক্ত করা হয়েছে যেগুলো নির্মাণে কোনও অনুমোদনই নেয়া হয় নি রাজউক থেকে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীর ১০ ভাগের বেশি ভবন নির্মিত হয়েছে নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে।
ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি)-এর হিসাব অনুযায়ী রাজধানীতে ভবনের সংখ্যা ০.২৩ মিলিয়ন। তবে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কমপ্রিহেনসিভ ডিজাসটার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম (সিডিএমপি)-এর এক সমীক্ষা প্রতিবদনে বলা হয়েছে, এ সংখ্যা ০.৩২ মিলিয়নের বেশি।
নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নকশা ও পরিকল্পনায় ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মিত পাঁচ হাজার ভবন শনাক্ত করতে পারলেও সেগুলোর নির্মাতা-মালিকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারে নি রাজউক। এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাঁরা বলেন প্রয়োজনীয় জনবল ও সামগ্রী-সরঞ্জামের অভাবের কথা। তাঁদের এখতিয়ার এলাকা ৫৯০ বর্গ কিলোমিটার। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় নির্মীয়মান শ’-শ’ ভবন ও কাঠামোর কাজকর্ম তদারক করা তাঁদের মাত্র ১০০০ কর্মী দ্বারা সম্ভব নয়। রাজউক-এর কর্মকর্তা পত্রিকান্তরে জানিয়েছেন, অবৈধ ভবন নির্মাণের ব্যাপারে খবর ও ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে আট জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ১৬ জন কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। সমপ্রতি ওই আট ম্যাজিস্ট্রেট ও ১৬ কর্মকর্তা সহ ২০০০ কর্মী বিশিষ্ট এক প্রতিষ্ঠান-ছক (অরগানোগ্রাম)-এর প্রস্তাব তাঁরা জমা দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ে।
এদিকে স্থানীয় ভূতত্ত্বীয় বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন আরও এক বিপদের কথা। রাজধানীর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে দ্রুত। এ অবস্থায় একদা জলাভূমির ওপর গড়ে ওঠা এ নগরে বহুতল ভবনের ধসে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে সবসময়েই। কোনও ভূমিকম্প ছাড়াই দুমড়ে মুচড়ে পড়তে অনেক বহুতল ভবন। দীর্ঘ খরার পর এক-দু’দিনের তুমুল বর্ষণেই ঘটতে পারে তেমন বিপদ। বেগুনবাড়ির ভবনধস ও অন্য ক’টি ভবনের হেলে পড়ার কারণ মওসুমি বৃষ্টিপাত। ক্রমশ নিচে নেমে যাওয়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে হঠাৎ ‘ঊর্ধ্বমুখী পানির চাপ’ সৃষ্টি হওয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। পানির স্তর নেমে গেলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় তার সঙ্গে ভবনের নিচের মাটি একভাবে বিন্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘ দিন শুষ্কতার পর ভারি বর্ষণ হলে ভূগর্ভস্থ পানি ঠেলে উঠিয়ে দেয় ওই বৃষ্টির পানি। এতে কিছু আন্দোলন দেখা দেয় ভূমিতে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কয়েক দিন ধরে তুমুল বৃষ্টিপাত হলে – জলাভূমি ভরাট করা স্থানে দুর্বল ভিত্তির ওপর স্থাপিত বহুতল ভবনগুলো ধসে পড়তেই পারে।
মাঝারি মাত্রার একটা ভূমিকম্প হলে কি অবস্থা হবে ঢাকার? একটি সরকারি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ৬-মাত্রার একটি ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র (এপিসেনটার) যদি ঢাকার মধ্যে হয় তাহলে প্রায় ৭৮,৩২৩টি ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হবে। যদি মধুপুর ফল্ট থেকে ৭.৫-মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি হয় তাহলে রাজধানীর ৭২,৩১৬টি ভবন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হবে, ৫৩,১৬৬টি ভবন হবে আংশিক বিধ্বস্ত। যদি ফল্ট ২-এর প্লেট বাউন্ডারি থেকে ৮.৫-মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে এই অঞ্চলে তাহলে দেশের প্রায় ২৩৮,১৬৪টি ভবন বিধ্বস্ত হবে পুরোপুরি। মারকিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিশ্বের যে সব নগরী রয়েছে প্রবল ভূমিকম্প-ঝুঁকির মধ্যে তার একটি ঢাকা। এর কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ন।
এ অবস্থায় আমাদের ভবিষ্যৎ কি?
বাংলার প্রাচীন রাজধানীগুলোর বেশির ভাগই এখন বিলুপ্ত, কয়েকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত। ঢাকার পরিণামও কি তাই? তবে কি আমাদের ভাবতে হবে পরিকল্পিত নতুন রাজধানীর কথা? মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফরিকা, নেদারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের দৃষ্টান্ত কি অনুসরণ করতে হবে আমাদের? মুহম্মদ বিন তুগলক (শাসনকাল ১৩২৫-৫১)-এর দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর চিন্তা যে দূরদর্শী ছিল তা এখন স্বীকার করেন অনেকেই, আমাদেরও হয়তো মেনে নিতে হবে সে ‘তুগলকি’ চিন্তা। নাহলে কি জীবন কাটাতে হবে আতঙ্কের সঙ্গে বসবাস করে?
সাযযাদ কাদিরঃ সাংবাদিক ও গবেষক।।