ভারতের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের বিপর্যয় কেন
ভারতের পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । এ বছরই গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গোয়া রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তরা মার্চ এবং ফলাফর ঘোষনা করা হয় ৬ই মার্চ।মনিপুর রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২৮ জানুয়ারী এবং ফলাফল ঘোষানা করা হয় ৬ই মার্চ।উত্তরখন্ড ও পাঞ্জাবে ৩০জানুয়ারী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ফলাফল ৬ই মার্চ ঘোষণা করা হয়।উত্তর প্রদেশে সাতটি ধাপে নির্বাচন অনুটিষ্ঠত হয় ফেব্রম্নয়ারী মাসে এবং ৩রা মার্চ তা শেষ হয়।এটির ফলাফলও ৬ই মার্চ ঘোষিত হয় ।মণিপুর রাজ্যে কংগ্রেস সবচেয়ে বেশী আসন পেয়েছে। উত্তর প্রদেশ, গোয়া, পাঞ্জাব ও উত্তরখন্ডে পরাজিত হয়েছে। ৬ মার্চ ভোট গণনার শেষ পর্যায়ে ফল বিশেস্নষনে দেখা যায় কংগ্রেস চতুর্থ স্থানে রয়েছে। সর্বোচচ আসনে জিতে ও এগিয়ে থেকে শীর্ষস্থানটি দখল করেছে সমাজবাদী পার্টি।উত্তর প্রদেশে ৪০৩ টি আসনের মধ্যে সমাজবাদী পার্টি ২২৪টিতে বিজয় অর্জন করেছে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দী ও ক্ষমতায় থাকা বহুজন সমাজবাদী পার্টি ৮০টি আসনে জয়লাভ করেছে। ভারতীয় জনতা পার্টি জিতেছে ৪৭টিতে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জিতেছে ২৮টি টি আসনে। এ ছাড়া অন্যান্য দল ১৪টি আসনে , রাষ্ট্রীয় লোক দল ৯টি আসনে।পাঞ্জাব প্রদেশে ১১৭টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস জিতেছে ৪৬টিতে, শিরোমনি আকালি দল ৫৬টি আসনে, বিজেপি ১২ আসনে এবং নিরপেক্ষ দল তিন আসনে।গোয়ায় ৪০টি আসনের মধ্যে বিজেপি ২৪ আসনে, কংগ্রেস নয় আসনে এবং অন্যান্য দল সাত আসনে।উত্তরখন্ড প্রদেশে ৭০ আসনের মধ্যে বিজেপি ৩১ আসনে বিজয় অর্জন করেছে, । কংগ্রেস ৩২ আসনে । অন্যান্য দল ৭ আসনে বিজয় অর্জন করেছে।মনিপুর প্রদেশে ৬০ আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৪২টিতে, টি এম সি সাত, পি ডি এফ একটিতে এবং অন্যান্য দল ১০টি আসনে বিজয় লাভ করেছে।সমাজবাদী দলের রাজ্য সভাপতি অখিলেশ যাদব বলেন, ’’ নির্বাচনী সাফল্যের জন্য অমরা কঠোর পরিশ্রম করে।।’’
উত্তর প্রদেশ সহ তিনটি রাজ্যেও বিধানসভা নির্বাচনে যে ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসর বিপর্যয় ঘটেছে, এর পিছনে যেসব ভুলত্রম্নটি হয়েছে সভানেত্রী সোনিয়া তা মেনে নিয়েছেন। তিনি আরও বলেন যে সব ভুল ত্রম্নটি হয়েছে সেগুলো সংশোধনের চেষ্টা করা হবে। প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল পরাজয়ের একটি কারণ।জয় পরাজয় যাই হোক প্রতিটিন নির্বচনই আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদেরও সোনিয়ার গান্ধীর রাজনীতি থেকে অনেক শিক্ষা নেয়ার আছে। তারা জনগনের রায়কে কত সাধারনভাবে মেনে নিয়েছেন যা আমাদের সংস্কৃতিতে এখনও হয়ে ওঠেনি।২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে মনমোহন সিংয়ের জায়গায় অন্য কাউকে প্রার্থী করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী বলেন, প্রশ্নই ওঠেনা। বিধানসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের ফলে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের ওপর কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করিনা।তিনি বলেন উত্তর প্রদেশে মানুষ মায়াবতী সরকারের ওপর বিরক্ত হয়ে পড়েছিল, গোয়ায় অনেক ভোটার কংগ্রেস সরকারের প্রতি অসমত্মষ্টু ছিল। এ ছাড়া ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতিও কংগ্রেসের পরাজয়ের কারন।উত্তর প্রদেশের স্থানীয় রাজনৈতিক দল সমাজবাদী পার্টি জয়লাভ করেছে। স্থানীয় দলিত কৃষক ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সমর্থণ অর্জনে সক্ষম হয় দলটি।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোটা সুবিধা বৃদ্ধি নিয়ে কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টি বিবাদের কারনেই উত্তর প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টিকে ভোট দিয়েছেন মুসলমান সম্প্রদায়।উত্তর প্রদেশের গভর্ণর বি এল জোশির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর সাংবাদিকদের মায়াবতী বলেন, ’’ আপনারা জানেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে কংগ্রেস পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটার হার বাড়ানোর অঙ্গীকার করে। বিধানসভা নির্বাচনের ঘোষণা আসার পর পরই তারা এ ঘোষণা করে।বিজেপি কঠোরভাবে এ দাবীর বিরোধিতা করেছিলো।তিনি আরো বলেন, হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় চলে আসতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল মুসলমানদের মধ্যে। দলটি মূলত উচচ বর্ণের ও পিছিয়ে পড়া অন্য শ্রেনীগুলোর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। অন্যদিকে রাজ্যের মুসলমানরা কংগ্রেসকে নানা কারনেই সেভাবে সর্মথন করেনি।নির্বাচনী প্রচারের সময় উত্তর প্রদেশে সরকারী চাকরি ও শিক্ষপ্রতিষ্ঠানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থায় মুসলমানদের জন্য সুবিধা বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছিল। উচচবর্ণের হিন্দুদের ভোট পেতে বিজেপিও একই কৌশল অবলম্বন করে।
ভারতে নিমণবর্ণেও হিন্দু ’ দলিতদের রাণি’ হিসেবে পরিচিত মায়াবতী ৭ই মার্চ পদত্যাগ করেছেন। বহুজন সমাজবাদী পার্টির পরাজয়ের মধ্যে মায়াবতীর বিদায় ঘন্টা বাজল । ভারতের সবচেয়ে ধনী, প্রাক্তন শিক্ষিকা এবং অবিবাহিতা মায়াবতী, আর্থিক দুনীতি, অসংযত আচরণের দায়েও কিছুটা দুষ্ট। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তার সময়ে উত্তর প্রদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে কিন্তু রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিতর্কিত পার্ক নির্মান পার্কে পার্কে নিমণবর্ণের বহু উলেস্নখযোগ্য ব্যক্তির ভাস্কয্যৃ নির্মান এমনকি মায়াবতীর নিজের ভাস্কর্য নির্মাণ সেই অর্থনৈতিক অর্জনকে মস্নান করে দিয়েছে। অচছুত দলিতদের প্রবল সমর্থনের কারণে মায়াবতীর এই ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে জীবনে। তাই পার্কের ভাসক্র্যকে তিনি দলিত জনগোষ্ঠীর ’বাতিঘর’ বলছেন। নয়াদিলিস্নতে ক্ষমতাসীন অভিজাত শ্রেনীর বিরম্নদ্ধে তার লড়াই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে তাকে। ১৯৫৬ সালে দিলিস্নর একপ্রামেত্ম চামার পরিবারে তার জন্ম। আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন মেধাবী এই নারী। তার মেধা চেঅকৃষ্ট করে বি এস পির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাশি রামের। তার প্রেরণাতেই তিনি আশির দশকে রাজনীতিতে আসেন। ১৯৯৩ সালে সর্বকনিষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন উত্তর প্রদেশের।
মায়াবতী ২০০৭ সালের ১৩ মে থেকে চতুর্থবারের মতো মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি ১৯৯৫, ১৯৯৭, ২০০২ সালে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে জাতপাত ও সংখ্যালঘু ভোট সব সময়ই ফ্যাক্টও বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অভিমত। নয়াদিলিস্নর কেন্দ্রীয় সরকারের পার্লামেন্টে ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৮০টির অধিকারী উত্তর প্রদেশ। অতএব দেখা যায় , উত্তর প্রদেশ ভারতের রাজনীতিতে বেশ গুরম্নত্বপূর্ন। রাহুল সাংবাদিকদেওর কাছে দলের দুরবস্থার কথা স্বীকার করেন। শীর্ষনেতারা একে দলের সবার ত্রম্নটি বলে মমত্মব্য করেছেন।
উত্তর প্রদেশ ভারতের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী রাজ্য। এখানে কেন্দ্রীয় সংসদ লোকসভার ৮০টি আসন রয়েছে। উত্তর প্রদেশ বিধানসভায় মোট আসন ৪০৩। এককভাবে সরকার গঠন করতে প্রয়োজন ২০২ অসান, আর পেয়েছে ২২৪আসন। এককভাবে সমজাবাদী পার্টি সরকার গঠন করে মোলায়েম সিং যাদব চতুর্থবরের মতো মুখ্যমন্ত্রী হলেন। তিনি এর পূর্বে ১৯৮৯, ১৯৯৩, ২০০৩ সালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।উত্তর প্রদেশে গত ২২ বছরের মধ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসতে পারেনি। রাজীব-সোনিয়া তনয় ও কংগ্রেস সাধারন সম্পাদক রাহুল গান্ধী এবার রাজ্যটিতে ক্ষমতায় ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।কিন্তু প্রতিশ্রম্নতি রক্ষা করতে পারলেন না। ১৯৮৯সালের ৫ই ডিসেম্বর জাতীয় জনতা দলের কাছে হেরে হাতছাড়া হয় গান্ধী পরিবারের এই নিজ রাজ্য।সময় বলে দিবে কংগ্রেস আবার কবে বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত রাহুল গান্ধীর ব্যাপক প্রচারণা সত্ত্বেও ফলাফলের দেখা গেছে ভোটারদের মন টানতে ব্যার্থ হয়েছেন তিনি। এ রায় রাহুলের নেতৃত্বের যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।এবারের নির্বাচনকে রাহলেরর জন্য একটি পরীক্ষা হিসেবেই দেখা হচিছল।কংগ্রেসের দৃষ্টিতে ২০১৪ সালের সাধান নির্বাচনের আগএেবারের বিধানসভার ভোট ছিল অনেকটা ভিত্তি তৈরির মতো। যে ভিত্তিকে তার ব্যবহার করতে চেয়েছিল রাহুলের প্রধানমন্ত্রী পদে উত্তোরনের সিড়ি হিসেবে। ফলাফল বলে দিচেছ সেই সিড়ি খুব নাজুক বা নড়বড়ে।রাহুল গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর সর্বত্র চষে বেরিযেছিলেন কিন্তু জনগনের মন হয়ত জয় করতে পারেননি।দিলিস্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আর কে মিশ্রা রাহুলের কারিশমা ভোটারদের উদ্ধুদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।কংগ্রেসকে তাদের রাজনৈতিক কৌশলই নয়, রাহুলের নেতৃত্ব ও তাকে জনগনের সামনে তুলে ধরার ব্যাপারেও পরিবর্তন আনতে হবে।রাজনৈতিক বিশেস্নষক পারসা ভেংকটরাও বলেন, ’’ এখন প্রশ্ন হচেছ রাহুল যে উত্তর প্রদেশে যে সময় ও শ্রম দিলেন তা অর্থহীন হয়ে দাড়াবে কিনা।’’
মুহম্মদ মাছুম বিল্লাহঃ কলামিষ্ট।।