সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সিলেট
সিলেট যেমন একটি প্রাচীন জনপদ তেমনি ভাবে সিলেট অঞ্চলের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসও প্রাচীন। ইতিহাস ঐতিহ্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী সিলেট অঞ্চল সাহিত্য সংস্কৃতিতেও স্বতন্ত্রতার স্বাক্ষর রাখে। সিলেটের নিজস্ব বর্ণমালা নাগরী লিপিতে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান, কবিতা, রাগ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে বৈষ্ণব বা পদাবলী সাহিত্য, মুসলিম সাহিত্য, লোক সাহিত্য ও আধুনিক সাহিত্যে সিলেটের অবদান রয়েছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য সংস্কৃতিতে আগ্রগামী এই প্রাচীন জনপদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম সহ অনেক কবি সাহিত্যিকগণের পদধূলিতে মুখরিত হয়েছে একাধিকবার এবং এখনো এই প্রাচীন জনপদটি সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় অগ্রগামী এক মুখরিত জনপদ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর বুকে।
সিলেটের নাগরী লিপি ও সাহিত্যঃ
পৃথিবীর অনেক অনেক সমৃদ্ধশালী ও শক্তিমান ভাষারও নিজস্ব লিপি বা বর্ণমালা নেই কিন্তু সিলেটের আঞ্চলিক বা কথ্য ভাষার রয়েছে বিজ্ঞানসম্মত বর্ণমালা যা নাগরী লিপি নামেই পরিচিত। সিলেট অঞ্চলের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উজ্জ্বলতম দলিল নাগরী লিপি। নাগরী লিপিতে রচিত হয়েছে তৎকালীন বা আদি সিলেটের উন্নত সাহিত্য। গবেষক ও ভাষা বিজ্ঞানীদের কাছে সিলেটের নাগরী লিপি রীতিমত বিস্ময়কর। নাগরী লিপিতে রয়েছে মাত্র ৩২টি বর্ণ বা অক্ষর, নাগরীতে সাধারণত যুক্তাক্ষর বা যুক্তবর্ণ ব্যবহার করা হয়না তাই নাগরী শেখাটা ছিলো খুব সহজ, মাত্র আড়াই দিনে শেখা যায়। একারণে মহিলাদের মধ্যে নাগরীর প্রচার ও প্রসার ছিলো প্রবল। এখনো অনেক মহিলা নাগরী বর্ণমালা ব্যবহার করে লেখতে ও পড়তে পারেন। নাগরী লিপি মূলত সিলেটের মুসলমানদের সম্পদ তাই নাগরীতে রচিত বইয়ের প্রাধানত বিষয়বস্তু ছিলো নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, ইসলামী ইতিহাস, ঐতিহ্য, কাহিনী, রাগ, বাউল ও মরমী সঙ্গীত। এ পর্যন্ত নাগরী লিপিতে ৮৮টি মুদ্রিত গ্রন্থসহ ১৪৪টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। নাগরী বর্ণমালায় মুদ্রিত গ্রন্থের মধ্যে ছাদেক আলী রচিত হালতুন নবী, রদ্দে কুফর, হাসর মিছিল, মহব্বত নামা, শীতালং শাহের হাসর তরান, রাগ বাউল, কিয়ামতনামা, সৈয়দ শাহ নূরের নূর নসিহত, আরকুম শাহের কবিনামা, হকিকতে সিতারা প্রভৃতি গ্রন্থ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। নাগরী সাহিত্যে ছাদেক আলীই ছিলেন সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি । তিনি ১৭৯৮ সালে কুলাউড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হিন্দু ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আগে তার নাম ছিলো গৌর কিশোর সেন। নাগরী সাহিত্য এ পর্যন্ত ৫৬ জনের পরিচিতি পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন গোলাম হুছন, মুন্সী ইরফান আলী, দৈখুরা মুন্সী, আব্দুল ওহাব চৌধুরী, আমান উল্লাহ, ওয়াজিদ উল্লাহ, শাহ হরমুজ আলী, হাজী ইয়াসিন প্রমূখ। গোলাম হুছনের “তালিব হুছন”-কে নাগরী লিপির প্রথম গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দিতে নাগরী লিপির প্রচলন ঘটে। কেউ কেউ মনে করেন ষোড়শ শতাব্দিতে মোগলদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে সিলেটে আশ্রয় নেয়া আফগান পাঠানরা নাগরী লিপির সৃষ্টি করেন। আবার কারো কারো মতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ সৃষ্ট সংস্কৃতবহুল বাংলার বিকল্পরূপে সিলেটীরা নাগরী লিপি ও সাহিত্যের জন্ম দান করেন। নাগরী লিপিতে সাহিত্য সৃষ্টির অনেক পর এর মুদ্রণ শুরু হয়। প্রথম দিকে টাইপ ও ছাপাখার অভাবে হাতে লিখেই নাগরীর প্রসার ঘটে। ১৮৬০ সালের পর নাগরী বহুল প্রসার লাভ করে। কারণ ওই সময়ে সিলেট শহরের হাওয়া পাড়ার মৌলভী আব্দুল করিম ইউরোপ সফর শেষ করে দেশে ফেরত আসেন। তিনিই প্রথম নাগরী লিপি টাইপ তৈরী করিয়ে ছাপাখানা চালু করেন। বন্দর বাজারে স্থাপিত তার ছাপাখানার নাম ছিলো ইসলামীয়া প্রেস। মুক্তিযুদ্ধের সময় বোমার আঘাতে প্রেসটি ধ্বংস হয়ে যায়। ইসলামীয়া প্রেসের পর সিলেট শহরের নাইওরপুলে সারদা প্রেস নামে আরো একটি নাগরী ছাপাখানা স্থাপিত হয়। ১৯৪৭ এর আগে কলকাতা ও শিয়ালদহেও নাগরী লিপির প্রেস ছিলো। বৃহত্তর সিলেট ছাড়াও, কাছাড়, করিমগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, প্রভৃতি অঞ্চলে নাগরী লিপি ও সাহিত্যের প্রভাব, প্রচার ও সমাদর ছিলো বিস্তৃত। বর্তমান সময়ে নাগরী চর্চার আয়তন কমে আসলেও একবারে হারিয়ে যায়নি। সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্য যতদিন পৃথিবীতে টিকে থাকবে ততদিন সিলেটের স্বতন্ত্র বর্ণমালা নাগরী লিপিও টিকে থাকে উজ্জ্বলতম ইতিহাসের অংশ হিসেবেই।
চর্যাপদে সিলেটঃ
চর্যাপদই হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন। ষষ্ঠ থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ চর্যাপদ রচনা করেন। চর্যার শব্দাবলীর সাথে সিলেট ও আসাম বেল্টের কথ্য ভাষার বা আঞ্চলিক শব্দের যথেষ্ট মিল রয়েছে। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার বেশ কিছু শব্দ চর্যাপদ রচনায় হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে। চর্যার ব্যাকরণের সাথেও সিলেটী ভাষার ব্যাকরণের রয়েছে বিস্ময়কর মিল। চর্যার শব্দ, ব্যাকরণ ও পরিবেশ বিশ্লেষণ করে গবেষক অধ্যাপক আসাদ্দর আলী প্রমাণ করেছেন যে চর্যার এক বা একাধিক কবি ছিলেন সিলেট অঞ্চলের লোক। আমাদের প্রচলিত বাংলা ভাষারও আগে সিলেটী ভাষা ছিলো সাবলীল ও পরিপূর্ণ একটি ভাষা। সিলেটী শব্দের সমন্বয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয় চর্যাপদ আর সংস্কৃত ভাষার গর্ভে জন্ম লাভ করে বাংলা ভাষা। তাই বাংলা ভাষার উৎপত্তিতেও সিলেটী ভাষার অবদান নেহায়েত কম ছিলোনা।
বৈষ্ণব বা পদাবলী সাহিত্যঃ
বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্য ১৪৮৬ সালে নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতৃভূমি ছিলো সিলেটে। বাবা-মা সিলেটী হওয়ার সুবাদে সিলেটের সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিলো নিয়মিত। বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যকে কেন্দ্র করে যে পদাবলী সাহিত্যের সূচনা হয় বাংলা সাহিত্যে তাঁর গুরুত্ব অপরিসীম। এই পদাবলী সাহিত্যে এককভাবে সিলেটের অবদান সর্বাধিক। শ্রীচৈতন্যের প্রধান প্রধান পার্ষদ ছিলেন সিলেটী। চৈতন্য বিষয়ক প্রথম পদকর্তা অদ্বৈত আচার্য, মুরারী গুপ্ত, মাধব দাস, শ্রীবাস পন্ডিত, রঘুনন্দন ভট্টাচার্য প্রমূখ বিখ্যাত বৈষ্ণব অবতার। সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানার ঢাকাদক্ষিণের যদুনাথ কবিচন্দ্র গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদাবলীর জন্য বিখ্যাত। অদ্বৈত জীবন কাব্যের রচয়িতা হরিচরণও ছিলেন সিলেটের সন্তান। ভবানন্দের হরিবংশের সব পুঁথি পাওয়া গেছে সিলেটে। ১৩১৩ বাঙ্গাব্দে হরিবংশের সঙ্গীতাংশের একটি সংস্করণ সিলেটী নাগরী লিপিতে “মজমারাগ হরিবংশ” শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে হরিবংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সতীশ চন্দ্র রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও বৈষ্ণব ধর্ম সম্পর্কিত অসংখ্য বই সিলেটে রচিত হয়েছে।
শৈব শাক্ত, মঙ্গল কাব্য ও অন্যান্য শৈব শাক্ত সাহিত্যে সিলেটের অবদান অনেক। অনুবাদে সিলেটী সাহিত্যিকদের অবদান কম নয়, মহাভারতের আদি অনুবাদক সঞ্জয় গৌর ছিলেন সিলেটী। মনসা মঙ্গলের প্রথম ও দ্বিতীয় জনপ্রিয় কবি যথাক্রমে নারায়ণ দেব ও ষষ্ঠীবর দত্ত ছিলেন সিলেটের অধিবাসী।
লোক সাহিত্যে সিলেটঃ
সাহিত্যের লিখিত পর্যায় শুরুর আগে লোক সাহিত্যই ছিলো মানুষের মনন ও সৃজনশীল বৃত্তি চর্চার অবলম্বন। মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে লোক সাহিত্যের উৎপত্তি। সিলেট অঞ্চল সাহিত্যের এই আদি শাখাতেও ছিলো অত্যান্ত সমৃদ্ধশালী। তাই সিলেটকে লোক সাহিত্যের খনি বলা হয়ে থাকে, লোক সাহিত্যের এই খনি থেকে এখনো মূল্যবান সম্পদ সংগ্রহের কাজ চলছে। গুরু সদয় দত্ত আই.সি.এস সংগৃহীত ১৯৬৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত “শ্রীহট্টের লোক সংগীত”, শশীমোহন চক্রবর্তী সংগৃহীত “শ্রীহট্টীয় প্রবাদ প্রবচন”, অধ্যাপক পদ্মনাথ ভট্টাচার্যের “শ্রীহট্ট ভট্টসঙ্গীত”, চৌধুরী গোলাম আকবর সংগৃহীত ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত “সিলেট গীতিকা” প্রথম খন্ড প্রভৃতি গ্রন্থ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
সিলেটী লোক সাহিত্য সংগ্রহের প্রাথমিক পর্যায়ে মোহাম্মদ আশরাফ হোসেনকে পথ প্রদর্শকের মর্যাদা দেয়া হয়। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় তিনি বারমাসী, পালা গান, গীতিকা, মারফতী, বাউল ইত্যাদি সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন। চৌধুরী গোলাম আকবর আজীবন লোক সাহিত্য সংগ্রহে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তিনি দীর্ঘদিন বাংলা একাডেমীর লোক সাহিত্য সংগ্রাহক সিলেট গীতিকা ছাড়াও তাঁর “লোক সাহিত্যে ইসলাম”, “লোক সাহিত্যের কথা”, “সাধক কবি ভবানন্দ”, “সিলেটী নাগরী পরিক্রমা” ইত্যাদি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে লোক সাহিত্য সংগ্রহে অধ্যাপক মোহাম্মদ আসদ্দর আলী বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি গবেষণামূলক কাজের পাশা-পাশি লোক সাহিত্য সংগ্রহ করছেন এবং তাঁর সংগ্রহ বিক্ষিপ্ত ভাবে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি ইতিমধ্যে দশ হাজারেরও অধিক প্রবাদ প্রবচন সংগ্রহ করেছেন। “ময়মনসিংহ গীতিকার” দশটি গীতের সাতটিই বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বলে তিনি প্রমাণ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে “মহাকবি সুলতান” ও চর্চাপদে সিলেটী ভাষা অন্যতম। লোক সাহিত্যে গোলাম মর্তুজার অবদানও বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য, তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ “লোকায়ত পালা পার্বন”, “গৈ গেরামের গল্পের আসর” উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও লোক সাহিত্য সংগ্রহ ও চর্চায় মোহাম্মদ নুরুল হক, মোহাম্মদ আব্দুল বারী, অচ্যুৎচরণ চৌধুরী, রাজমোহন নাথ, ডঃ গোলাম কাদির, আব্দুল মতিন চৌধুরী, সৈয়দ মোস্তফা কামাল প্রমুখের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
উল্লেখিত সাহিত্য ছাড়াও সিলেটে ব্যাপক ভাবে সংস্কৃত, উর্দু, আরবী ও ফরাসী ভাষা সাহিত্যের চর্চা ছিলো এবং এখনো হচ্ছে। আধুনিক সাহিত্যের ভান্ডারও সিলেটে অত্যান্ত উজ্জ্বল। সিলেটের প্রকৃতিক সৌন্দয্যের মতোই যেমন সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধশালী ঠিক তেমনিভাবে সিলেটের সাহিত্য ও সংস্কৃতিও সিলেটকে করেছে পরিপূর্ণ এবং বাংলা সাহিত্যকেও করেছে অত্যান্ত সমৃদ্ধশালী।
জবরুল আলম সুমনঃ গবেষক ও প্রাবন্ধিক।।