ক্রেতার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক
পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে এর গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রতিটি ক্রেতার জন্য অত্যাবশ্যক। জানা যায়, ১৯৬০ সালের আগে পর্যন্ত সারা বিশ্বে এমনকি আমেরিকাতেও পণ্য বিপণনে ছিল সীমাহীন প্রতারণা, পণ্যে ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, ভেজাল। পণ্যের দেয়া হতো না বিষদ কোন তথ্য। ফলে ব্যবসায়ীদের গড়ে উঠেছিল একচেটিয়া কারবার। তারা তাদের খেয়াল খুশি মতো ভেজাল জাতীয় পণ্য বাজারজাত করতো। অপরদিকে ক্রেতারা ছিল অনেকাংশে তাদেরই কাছে জিম্মি। এসব অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে ক্রেতারা সোচ্চার হতে থাকে। গড়ে ওঠতে থাকে নানাবিধ আন্দোলন। প্রতারিত ভোক্তা ক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণে উদ্ভব হয় ভোক্তাবাদ বা কনজুমারিজম। এরূপ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে হেগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, অষ্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের ক্রেতা সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সভায় গঠিত হয় আর্ন্তজাতিক ক্রেতা সংগঠন (আই ও সি ইউ)। ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ক্রেতার ৪টি অধিকার সম্মিলিত এক ঘোষণা দেন, যার ঐতিহাসিক বিল মার্কিন কংগ্রেসে অনুমোদিত হয়। ক্রেতা অধিকার সংরক্ষণের এই আনুষ্ঠানিক যাত্রার পরিপূর্ণতা অর্জিত হয় ১৯৮৫ সালে। মূলত ১৯৮৫ সালের ১৬ এপ্রিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত এক প্রস্তাবে কার্যকরভাবে ক্রেতা সাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ৭টি মূলনীতি গ্রহণ এবং সকল সদস্য রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের সকল সংগঠনকে ক্রেতা স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বিস্তারিত কর্মসূচি প্রণয়ণের অনুরোধ জানানো হয়। আর জন এফ কেনেডির ক্রেতা অধিকার ঘোষণার দিন ১৫ মার্চ পালিত হয় ‘বিশ্ব ক্রেতা অধিকার দিবস’ হিসেবে।
বাংলাদেশে ক্রেতা-স্বার্থ সংরক্ষণ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৭৮ সালে গঠিত হয় প্রথম ক্রেতা সংগঠন কনজুমারস্ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। পরবর্ত্তীকালে ক্রেতা-স্বার্থ সংরক্ষণ সমিতি, সবার জন্য স্বাস্থ্য, ধূমপান নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সমিতি সহ অন্যান্য সংগঠনের আর্বিভাব ঘটে। এই সব ক্রেতা সংগঠন বিশেষত ক্যাব নাগরিকদের ব্যাপক সচেতনতার প্রচেষ্টা চালায়। তাদের এই প্রচেষ্টার ফলশ্রোতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ণ করে সরকার। উদাহরণ সরূপ বলা যায় ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৮২। বিশ্ব ক্রেতা অধিকার দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে জন এফ কেনেডি ঘোষিত ৪টি অধিকার। যথাঃ (১) প্রত্যেক ক্রেতার অধিকার রয়েছে ক্ষতিকারক পণ্য থেকে নিজেকে রক্ষা করা। তাই এমন কোন পণ্য বিবনন করা যাবে না যা জনস্বাস্থ্য ও জীবনের প্রতি হুমকী সৃষ্টি করে। (২) প্রতিটি পণ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে প্রতিটি ক্রেতার জানার অধিকার রয়েছে। পণ্যের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে ভোক্তা-ক্রেতা উভয়কেই অবহিত থাকতে হবে। (৩) প্রতিটি ক্রেতার ন্যায্য মূল্যে নিজস্ব পছন্দ ও প্রয়োজন মাফিক পণ্য ক্রয় করার অধিকার আছে। একচিটিয়া কারবারী ব্যবস্থা নিয়ে কোন কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টি করে ক্রেতার এই অধিকার ক্ষুণ্ণ করা যাবে না। (৪) ক্রেতা স্বার্থ পরিপন্থি যে কোন বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করার অধিকার থাকবে। সেই সাথে যেসমস্ত পর্যায়ে ক্রেতা স্বার্থ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় সেসব পর্যায়ে ক্রেতা প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বলা বাহুল্য যে আজ পৃথিবীর সর্বত্র কোটি কোটি ক্রেতা-ভোক্তা তাদের স্বার্থের পরিপন্থি বিভিন্ন ধরণের আপত্তিকর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সংগ্রামে আত্ননিয়োগ করছে। আর্ন্তজাতিক ক্রেতা সংগঠন আইওসিইউ এর সঙ্গে সংহতি রেখে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশের প্রতিনিধিত্বকারী ক্রেতা সংগঠন ক্রেতার অধিকার নিয়ে গড়ে তুলছে ভিন্ন ধর্মী আন্দোলন। বর্তমান বিশ্বে ক্রেতাবাদ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সত্যিকার অর্থে বিশ্ব ব্যাপী ক্রেতার ৮টি অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এগুলো হলো; জীবন ধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার, জ্ঞাত হওয়ার অধিকার, অভিযোগ করার এবং প্রতিনিধিত্বের অধিকার, ন্যায্যমূল্যে পছন্দসই পণ্য বাছাই করার অধিকার, ক্ষতিপূরণ পাবার অধিকার, ক্রেতা শিক্ষা লাভের অধিকার ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অধিকার। বাংলাদেশে স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে কনজুমা্রস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ক্রেতা অধিকার ও দ্বায়িত্ব সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত ও সক্রিয় এবং ক্রেতা স্বার্থ সংরক্ষণে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা প্রদান করছে। ক্যাব তাদের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাজার দরে মনিটরিং, ধুমপান বিরোধী প্রচারণা, ১২টি ক্ষতিকার কীটনাশক ব্যবহারের নিয়মনীতি প্রচার, ওষুধ নীতি বাস্তবায়ন, মায়ের দুধের পক্ষে প্রচারণা, পরিবেশ সংরক্ষণ, নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠা এবং প্রবঞ্চিত প্রতারিত ক্রেতা-ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষেণের আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
প্রকৃত পক্ষে, ক্রেতার অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার। সকল মানুষ-ই ভোক্তা, সকলেই ক্রেতা। এই অধিকার সার্বজনীন। এই অধিকার প্রতিষ্ঠা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আর্ন্তজাতিক ইস্যু। বর্তমানে বাজারজাত পণ্যের অধিকাংশই ভেজাল। বিএসটিআই এর মতো একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান এই ভেজাল জাতীয় পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটির একদিকে যেমন অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, অপরদিকে তেমনি কর্মকর্তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণেরও অভাব রয়েছে। তাছাড়া তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রায়ই পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। একই অভিযোগ রয়েছে ক্যাব এর প্রতিও। যাদের উপর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মান নির্ধারণ এবং সঠিক মূল্যে তা বাজারজাত হচ্ছে কি না তা দেখার দ্বায়িত্ব, তাদের বিরুদ্ধেই যদি দূর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তাহলে এর চেয়ে বড় দুঃখের বিষয় আর কি হতে পারে? আজ বিশ্ব ক্রেতা অধিকার দিবস। সকলকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে, ভেজাল জাতীয় পণ্য বর্জন করার। পাশাপাশি সরকারের সুষ্ঠু নজরদারিতে ক্রেতাগণ যাতে ন্যায্য মূল্যে মান সম্মত জিনিস ক্রয় করতে পারে সে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। তাহলেই ক্রেতা অধিকার দিবসটি পালনের স্বার্থকতা তাৎপর্যপূর্ণ হবে। ক্রেতাগণ তাদের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় করতে সোচ্চার হোক, সেটাই কাম্য…!
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।