চুপ-চুপ! থাপ্পড় মারবো!

চুপ-চুপ! থাপ্পড় মারবো!

সাযযাদ কাদিরঃ বাঙালি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে বিয়েবাড়ির ধুমধাম। তাই বাঙালির পরিবার, সমাজ ও সংস্কৃতি-জীবনে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বিয়েবাড়ির আনন্দ শুধু বর্ণাঢ্য আয়োজন-অনুষ্ঠান, আলোকসজ্জা, বাহারি সাজপোশাক, সুস্বাদু চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয়’র ভূরিভোজ, সুগন্ধিতে মউ-মউ সুরভিত পরিবেশ, নম্র শান্ত ললিতলবঙ্গলতা লজ্জাবতী ললনাদের রসরগড়ে রঙিলা রূপ নয় ? বর ও কনে দুই পক্ষের পরস্পরকে জব্দ ও হেনস্তা করে, ভাঙানি দিয়ে হেয় বানিয়ে গুষ্ঠি উদ্ধারের বেপরোয়া পালটাপালটি। এই প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা বকাঝকা, গালাগালি, হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায় কখনও-সখনও। গেট আটকানো, ধাঁধা ধরা, বুদ্ধি পরীক্ষা থেকে পানের মধ্যে মরিচের গুঁড়া, শরবতে চিনির বদলে লবণ ? এগুলো মামুলি রসিকতা। তবে বহু রসিকতা মধুরতা হারিয়ে দুঃসহও হয়ে ওঠে কখনও। একবার কাইলান (কালিয়ান?) গ্রামে বরযাত্রী হয়ে গিয়ে পরনের জামা-কাপড় হারিয়ে খালি গায়ে পায়জামা-প্যান্ট পরে টাঙ্গাইল ফিরতে হয়েছিল আমাদের। রাতে ঘুমাবার সময় পাহারা থাকা সত্বেও কোন ফাঁকে পোশাক-আশাক লোপাট করেছিল বরপক্ষের লোকজন। সেকালে তো লেঠেল নিয়ে বিয়েবাড়ি যেতে হতো বরপক্ষকে। কনেপক্ষের লেঠেলদের নানা কসরতের খেলায় হারিয়ে তবেই ঢুকতে হতো বিয়ের আসরে। শুধু তাই নয় যেতে-আসতে কোনও-কোনও গ্রামের লেঠেলদের চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হতো তাদের। এ পাল্লাপাল্লি ছিল ঐতিহ্যিক। গত শতকের চল্লিশ দশকের শেষের দিকে আমার মা-বাবার বিয়েতেও ঘটেছিল এমন। মিরের বেতকা থেকে কনে নিয়ে দেলদুয়ার যেতে পথে সাত গ্রাম পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত তিন গ্রামের লেঠেলদের আচ্ছামতো শিক্ষা দিতে হয়েছিল বরপক্ষের লেঠেলদের। একালে বীর্যবত্তার অমন প্রকাশ্য গৌরব প্রদর্শনের সুযোগ নেই, তবে বিয়ের আসরে কথা চালাচালি, নানা হিসাবের ঠেলাঠেলি নিয়ে রাত কাবারের উত্তেজনা আছে অনেক। আর রস-রসিকতা শ্লীলতার সীমা ছাড়িয়ে কখনও ইতরতায় পৌঁছে যায় বর-কনের বাসরঘরে। সেই ১৮৮৩ (?) সালে প্রকাশিত ‘কামিনীমালা’ সঙ্কলনে ‘বাসর রহস্য’ শীর্ষক নিবন্ধে শ্রীমতী বসন্তকুমারী লিখেছেন, “… হে বঙ্গভগ্নীগণ! চিরদিন পিঞ্জরাবদ্ধ সাধের পাখির ন্যায় সংসারে বাস করিয়া স্বাধীনতার নামে অগ্নিবৎ হইয়া উঠ, অথচ সমাজকে শাসন করিতেও কোমর বাঁধিয়া লাগ, তবে কেন তোমরা একজন অপরিচিত যুবার সম্মুখে নানা প্রকার অশ্লীল ব্যবহার করিয়া থাক।… যে লক্ষ্মীরা সম্পূর্ণ অপরিচিত পুরুষের সম্মুখে প্রথম দর্শনেই এত বাচালতা এবং বেহায়ার পরিচয় দেখাইতে পারেন, তাঁহারা স্বাধীনতা পেলে না জানি কি করেন? সত্য বটে বাঁধা গরু একবার দড়া ছিঁড়িলে খুব ছুটিতে আরম্ভ করিয়া থাকে। চিরআবদ্ধেরা যে খানিক স্বাধীনতায় একেবারে উন্মত্ত হইবেন এ আর বিচিত্র নহে।… বাসরে কোনও প্রকার ভদ্রতা কি সভ্যতা, কি লজ্জাশীলতার পরিচয় রক্ষা হয় না। আমার বিবেচনায় সমাজ হইতে এই প্রথাটি শীঘ্র উঠিয়া যাওয়াই মঙ্গল।…”
ছোটবেলায় ধুমধামে বেশি মাতলেও বিয়েবাড়িতে দুই পক্ষের কষাকষি উপভোগ করেছি কমবেশি। এ সংস্কৃতির প্রতিফলন দেখেছি প্রায় সকল ক্ষেত্রে। স্কুলে কোনও আয়োজন-অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে যেতো অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া এবং না পাওয়াদের দুই পক্ষ। অনুষ্ঠান পণ্ড করতে এবং তা ঠেকাতে কত কটুকাটব্য, দুয়ো-দুয়ো, পচা ডিম, ছেঁড়া জুতা, দেয়াল লিখন! খেলার মাঠেও একই দৃশ্য। দুই দলের গোলবার ঘিরে ভিড় করতো দুই পক্ষ ? নানা কথা বলে গোলকিপারকে ভড়কে দিতো তারা। মাঝমাঠের দু’ পাশ থেকে উঠতো নানারকম বিচ্ছিরি আওয়াজ। মাঝেমধ্যে ক্ষেপে গিয়ে খেলোয়াড়রা চড়াও হতেন দর্শকদের ওপর। মঞ্চ-অনুষ্ঠানেও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার বহু আয়োজন দেখেছি। পচা ডিম, দুয়ো-দুয়ো ছাড়াও বেদম চুলকানি সৃষ্টিকারী বিলাইশুঙশুঙি বা চৈতরা পাতার গুঁড়ো ছড়িয়ে দেয়া হতো শিল্পীদের লক্ষ্য করে। এরপর ভেস্তে যেতো অনুষ্ঠান। ১৯৭৬ সালে চম্পক নাট্যগোষ্ঠী গঠন করে ‘স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা’ মঞ্চস্থ করতে গিয়ে পড়েছিলাম সব ধরনের জটিলতায়। প্রস্তুতিপর্বে একের পর এক অভিনেতা ভাগিয়ে নেয়ার পর একেবারে পরদা ওঠার আগ মুহূর্তে নায়িকাকে ভাগিয়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র ঠেকাতে হয়েছিল তখন। তারপরও কিভাবে যেন টাঙ্গাইল নাট্যোৎসবে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মাননা জুটেছিল আমার!
এভাবে বিয়েবাড়ির সংস্কৃতি এখন বাঙালি জীবনের সকল ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে একমাত্র আদর্শ। ব্যবসা, চাকরি, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, মেলা, উৎসব, সম্মেলন, নির্বাচন, রাজনীতি ? সবখানে দেখি পক্ষে-পক্ষে ঠেলাঠেলি, কাদা ছোড়াছুড়ি। এ ঐতিহ্য আমাদের সনাতন। এ আমাদের জাতীয় গর্ব, গৌরব।
এর বেশি বলবো না আর। কে আবার তেড়েমেরে আসে, “চুপ-চুপ! থাপ্পড় মারবো!” কিছু তো বলা যাবে না তাকে। ঐতিহ্য বলে কথা!

লেখকঃ সাংবাদিক।।

বিভাগীয় প্রধান

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।