যে কোনো দেশে বিপ্লব হলে তার বিপরীতে প্রতিবিপ্লব অবসম্ভাবী
শিখা ব্যানার্জিঃ
বাংলাদেশ একটি বিপ্লব। ত্রিশ লাখ শহীদ পৌনে তিন লাখ নারীর সম্ভ্রম, কোটি কোটি মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয়ের মধ্য দিয়ে। কেউ কেউ নয় মাসের যুদ্ধটিকেই আমাদের স্বাধীনতার একমাত্র বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত সেই ‘৭২ সাল থেকে। তারা বারবার বলে এটি প্রমাণ করতে চায় বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ জাতিকে অপ্রস্তুত অবস্থায় একটি অসম যুদ্ধে ফেলে দিয়েছেন। একধাপ এগিয়ে জাতির জনকের ওপর স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণের দোষ চাপাতে চায়। তারা ইচ্ছা করেই একথা বুঝতে চায় না, মুক্তিযুদ্ধের জন্য ধীরে ধীরে জাতিকে প্রস্তুত করা হয়েছে, আর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশের সব মানুষকে জানিয়ে করা যায় না, এর জন্য অত্যনত্দ গোপনীয়তা রৰা করতে হয়। পাকিস্তান একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। তার একটি অংশকে আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা অবশ্যই গোপনীয়তার সঙ্গে না করলে বিপ্লবী না হয়ে ফাঁসির কাষ্টে ঝোলা ছাড়া অন্য কোনো রাসত্দা খোলা থাকে না এবং এত গোপনীয়তার পরও বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াতে হয়েছে। পূর্ব প্রস্তুতি না থাকলে ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সম্ভব হতো না, বঙ্গবন্ধুও মুক্তি পেত না, ‘৭০-এর নির্বাচনও হতো না, তার রায় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধেও যাওয়া সম্ভব হতো না। যুদ্ধ শুরু হলে কোটি মানুষ বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া গেল আর তারা জায়গা দিয়ে দিল? আগে থেকে কোনো যোগাযোগ ছাড়া সব হয়ে গেল? পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন হয়ে গেল আবার সেই সরকার বৈদ্যনাথ তলা বর্তমান মুজিব নগরে শপথ নিল? মুজিব নগর সরকার গঠিত না হলে সারা বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়ে দিত? বাংলাদেশ সৃষ্টি কোনো ব্যক্তির বাঁশি বাজানোর ফলে হয়ে যায়নি। দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ। বিশ্ব ইতিহাস বলে যে কোনো দেশে বিপ্লব হলে তার বিপরীতে প্রতিবিপ্লব অবসম্ভাবী। বাংলাদেশেও একই ঘটনা ঘটেছে। বিপস্নবীরা অসতর্ক ও অনভিজ্ঞ হওয়ায় প্রতি-বিপস্নবীরা এখানে বিজয়ী হয়েছে এবং অত্যনত্দ অল্প সময়ে। জাতীর জনক সাধারণ ৰমায় কোনো যুদ্ধাপরাধীকে ৰমা করেননি, ৭০ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মামলা বিচারাধীন ছিল। ১১ হাজার মামলার রায় হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আরেকটি পলাশী মঞ্চস্থ করে মোশতাককে ৰমতায় আনা হলো, অল্প সময়ের মধ্যে মঞ্চে এলেন লর্ড ক্লাইভরম্নপি জিয়া। জিয়া সামরিক ফরমান বলে দালাল আইন ‘৭৩ রহিত করে যুদ্ধাপরাধীদের জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে তাদের বিচারের রাসত্দা বন্ধ করে তাদের নিয়ে দল গঠন করে দেশে হীনমন্যতার রাজনীতি শুরম্ন করেন। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি জিয়াউর রহমানকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে আবার পাকিসত্দান বানানোর ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করে। বাংলাদেশকে বোমাবাজি, সন্ত্রাসের রাজত্ব বানিয়ে ছাড়ে। অপপ্রচার চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র অব্যাহতভাবে চালিয়ে আসছে। জেনারেল জিয়া ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি দুর্বিষহ করে দিয়েছেন। রাজনীতিকে কেনাবেচা আর ব্যবসায় পরিণত করেছেন। তারপর থেকে এখন পর্যনত্দ এ দেশের রাজনীতি একই পথে হাঁটছে। এখান থেকে ফিরে আসা অত্যনত্দ কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। আজ বাংলাদেশ একটি নীতিহীন ৰমতালিপ্সু লাম্পট্যের ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। বর্তমান অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দল আছে বলে মনে হয় না, এখানে কিছু ৰমতা লি. কোম্পানি ক্রীয়াশীল। এরকম একটি পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে যে কঠিন দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হবে, তার জন্য যে ত্যাগ ও সংযমের পথে এগোতে হবে সেটি আমরা দেখছি না। দেখছি উল্টোটি। দেশবাসী আশাবাদী হয়ে মহাজোটকে ৰমতায় এনেছিল সেই আশাবাদ আজ মহাজোটের প্রধান শরিকের আত্মঅহমিকা আর কাউকে ছাড় না দেয়ার মানসিকতার কারণে নৈরাশ্যের দিকেই অধঃপতিত হচ্ছে। যদিও বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও সরকারের অর্জন খুব কম নয়, তার পরও স্বীকার করতে হবে ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার আকাঙ্ৰার কাছে সামষ্টিক অর্জন ধূলিসাৎ হচ্ছে। মহাজোটের প্রধান শরিক ৰমতায় আসার জন্য যাদের সহযোগিতা নেয়, ৰমতায় এলে তাদের কথা ভুলে একলা চলো নীতি গ্রহণ করে। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যারা একসঙ্গে যুদ্ধ করল, স্বাধীনতা অর্জনের পর মুক্তির সংগ্রামে তাদের সঙ্গে রাখার প্রয়োজনীয়তা মনে করল না। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সরকারে থাকল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সিপিবি ন্যাপ ভাসানী, ন্যাপ মোজাফফর আর কংগ্রেস কিন্তু দেশ স্বাধীন হলে সরকার হয়ে গেল শুধুই আওয়ামী লীগের আর এটাই প্রতিবিপস্নবকে সফল হতে সাহায্য করল। আজ ৰমতার তিন বছর পার করে পরিস্থিতি ঘোলা করে মহাজোটের স্মরণাপন্ন হলেন প্রধানমন্ত্রী। বিরাজনীতিকরণের রাসত্দায় হাঁটছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক এবং নির্বাচিত নেতাদের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বানিয়ে তাদের মাথার ওপর অনির্বাচিত আমলা-উপদেষ্টাদের বসিয়ে দিয়ে চমক দেখাতে গিয়ে জননেত্রী যে অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছেন, সেখান থেকে এ দুই বছরে বের হয়ে আসা আদৌ সম্ভব কিনা জানি না। তবে দেশকে হীনমন্যতার রাজনীতি থেকে বের করে আনা বর্তমান অবস্থায় একমাত্র শেখ হাসিনার পৰেই সম্ভব। না পারলেও উদ্যোগটা শুরম্ন হতে পারে এবং শত ব্যর্থতার পরও তিনি সেটা শুরম্ন করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান ক’জনের বিচার কাজ নতুন বছরের মধ্যে শেষ করতে হবে। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা দ্রম্নত শেষ করা জাতির জন্য অত্যনত্দ জরম্নরি। আর এ জন্য মুক্তিযুদ্ধের পৰ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এ ঐক্য সুদৃঢ় করতে আওয়ামী লীগকেই মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে। আওয়ামী লীগের ছোট ছোট ভুলের কারণে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তি আজ নতুন করে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা এবং সক্রিয়তা একদম নেই বললে চলে। প্রতিদিন পত্রিকা খুললে কোনো না কোনো দলীয় কর্মীর প্রতিপৰের হাতে নিহতের সংবাদ দেশ বা আওয়ামী লীগের জন্য মোটেই সুখের বিষয় নয়। দলকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হলে এসব ঘটনাই দলের পতনের জন্য যথেষ্ট বলে গণ্য হবে। বাংলাদেশে ওয়ান ইলেভেনের চেয়ে ভয়াবহ অবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্রে আমরা গন্ধ পাচ্ছি। বিএনপি চেয়ারপারসন এবং জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা এখন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। লংমার্চ দিয়ে তিনি সরাসরি যুদ্ধাপরাধীদের পৰ নিচ্ছেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ব্যক্তিগত রাগের কারণে সাঈদী বড় যুদ্ধাপরাধী, না আসিকুর রহমান বড় সেই বিতর্ক তুলছেন। কাদের ভাই, আপনি যখন আওয়ামী লীগে ছিলেন তখনও আসিকুর রহমান বর্তমান পদে ছিলেন, তখনতো কোনোদিনও বলেননি? কে আপনাকে রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধী বললো শুধু এ রাগের কারণে আপনি নিজামী-সাঈদীদের পৰ নেবেন? কারণ এবং ঘোষণা ছাড়া হঠাৎ করে যখন ককটেল ফুটিয়ে এবং বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মারা হয়, তখন অবশ্যই তার পিছনের কারণ খুঁজে বের করে অপরাধীদের বিচারের সামনে দাঁড় করা সরকারের দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তৃতা করে বলে অপরাধীদের পার পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন না। সরকার ষড়যন্ত্র উন্মোচন করে ষড়যন্ত্রকারীদের জনগণের সামনে তুুলে ধরম্নন_ এটিই জনগণের প্রত্যাশা। আজ মানুষের মধ্যে দুই নেত্রীকে বাদ দেয়ার প্রচারণা চলছে এবং মানুষ সেটি আলোচনা করছে, এটিও যেমন প্রমাণ করে ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবরা এখনো সক্রিয় তেমনি দেশবরেণ্য বিশিষ্টজনদের মুখে যখন তৃতীয় শক্তির কথা শুনি, তখনো ভয় হয়; কারণ এ দেশের জনগণের কাছে সেনাবাহিনী ছাড়া কোনো তৃতীয় শক্তির অসত্দিত্ব নেই। রাজনৈতিক পরিভাষায় তৃতীয় শক্তি বলে কিছুই থাকতে পারে না। যদি হয় অশুভ শক্তির বিকল্প শক্তি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে প্রথম/দ্বিতীয় শক্তি ধরে যদি তৃতীয় শক্তির উত্থান চান ধৈর্যের সঙ্গে সঠিক রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে যে কেউ জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে বিকল্প হিসেবে প্রমাণ করতে পারেন এবং দেশে নিয়ন্ত্রিত হলেও একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই সেটি সম্ভব। যারা তৃতীয় শক্তির কামনা করেন, তারা অতিদ্রম্নত ৰমতায় যাওয়ার মতলববাজি করেন বলে আমার বিশ্বাস। বারবার সামরিক শাসকরা দল গঠন করে কিছু লোকের রাজনৈতিক উত্থান ঘটিয়েছেন বলে যারা অতিদ্রম্নত ৰমতা পেতে চান, তারাই তথাকথিত তৃতীয় শক্তি খোঁজেন এবং তারাই কোনো অন্ধকারের শক্তির ইশারায় দেশে প্রতিনিয়ত অপপ্রচার, গুঞ্জন এবং অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চান। বর্তমান বিরোধী দল সত্যিকার বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণেও অন্ধকারের শক্তি উৎসাহিত হচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরম্নল সাহেবসহ বিএনপি নেতারা বক্তব্য দেন সরকার গণতন্ত্রকে পুলিশ দিয়ে অবরম্নদ্ধ করে রেখেছে। তারা আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখেন না। ২০০১-০৬ পর্যনত্দ ব্যারিকেড দিয়ে আওয়ামী লীগ অফিস আটকে রেখেছিলেন। মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন, মো. নাসিম, সদ্যপ্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহম্মদ, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ_ এমন কেউ নেই আপনাদের আমলে রাজপথে মার খাননি। একথা দিয়ে আমি এটি বোঝাতে চাইনি, আপনারা করেছেন বলে বর্তমান সরকারেরটিও বৈধ। তবে ২০০১ থেকে আপনাদের শাসন আমলে অসংখ্য নারীর সম্মানহানি, ঘরবাড়ি, ব্যবসা দখল আপনারা ভুলে গেলেও এ দেশের জনগণ ভুলবে না। সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে গণতন্ত্রমনস্ক দল ও নেতাকর্মী প্রয়োজন। দেশে যে নেতৃত্ব সঙ্কট চলছে, এর থেকে মুক্তি পেতে হলে বিকল্প রাজনৈতিক শক্ত ভীত রচনা করা দরকার আর এ দরকার পূরণ করতে গিয়ে যুদ্ধাপরাধ, অস্ত্র চোরাচালান ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারকাজ বাধাগ্রস্থ হয়, এমন কোনো কর্মসূচি দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
শিখা ব্যানার্জিঃ প্রকাশক,এসবিডি নিউজ২৪ ডট কম।