আমার বাংলা ভাষা
সাযযাদ কাদিরঃ
গত শতকের প্রথম চার দশকে পাঠকপ্রিয়তায় শীর্ষস্থানীয় লেখক ছিলেন পাঁচকড়ি দে (১৮৭৩-১৯৪৫)। তিনি লিখতেন অপরাধ কাহিনী। শরৎচন্দ্রের সামাজিক উপন্যাসের পাশাপাশি তাঁর লেখা কালফণী, কালসর্পী, কুলীনকন্যা, গোবিন্দরাম (১৯০৫), ছদ্মবেশী, জয়-পরাজয় (১৯০৭), জীবন্মৃত-রহস্য, নরবলি, নরাধম, নীলবসনা সুন্দরী (১৯০৪), ভীষণ প্রতিশোধ, ভীষণ প্রতিহিংসা, পরিমল, প্রতিজ্ঞা-পালন (১৯০৭), বিদেশিনী, বিষম-বৈসূচন, মনোরমা, মরিয়ম, মায়াবিনী, মায়াবী, মৃত্যু-বিভীষিকা, মৃত্যুরঙ্গিণী, রঘু ডাকাত, রহস্য-বিপব, লক্ষ-টাকা (১৯০৮), শকদুহিতা, শোণিততর্পণ, সতী সীমন্তিনী, সহধর্ম্মিণী, সুহাসিনী (১৯০৮), সেলিনা সুন্দরী, হত্যাকারী কে?, হত্যা-রহস্য, হরতনের নওলা প্রভৃতি গোয়েন্দা উপন্যাস এবং বাঙ্গালীর বীরত্ব, নন্দবংশোচ্ছেদ, সিরাজদ্দৌলা, কৃষ্ণযাত্রা, ঢপ কীর্ত্তন প্রভৃতি গ্রন্থ বিক্রি হয়েছে দেদার। তাঁর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পাল ব্রাদার্স ও ছাপাখানা বাণী প্রেস থেকে এ সব বইয়ের একের পর এক সংস্করণ ছাপা হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। বস্ত্তত শ্রীকান্ত, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, কাশীনাথ, মহেশ, মহিম, সুরেশ, বিপ্রদাস প্রমুখের পাশাপাশি পাঁচকড়ি দে’র অক্ষয়কুমার, অমরনাথ দে, অরিন্দম বসু, জয়মল, দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র, ধনদাস পাকড়াশী, নগেন্দ্রনাথ, ফতেহ আলি, রাজীবলোচন প্রমুখ গোয়েন্দাও ছিলেন সেকালের পাঠকমহলে বিশেষ ভাবে আলোচিত ব্যক্তিত্ব।
ভাবে ভিন্ন হলেও পাঁচকড়ি দে ভাষা ও নির্মাণে ছিলেন বঙ্কিম-বিদ্যাসাগরের অনুসারী। নমুনা হিসেবে ‘‘হত্যাকারী কে?’’ উপন্যাস থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি এখানে:
‘‘… জ্যোৎস্নাপাবনে নক্ষত্রোজ্জ্বল নির্মেঘ আকাশ কর্পূরকুন্দধবল। অদূরবর্ত্তিনী প্রবহমানা তটিনীর সুমধুর কলগীতি অস্পষ্ট শ্রুত হইতেছিল।… প্রদীপের আলো আসিয়া সেই উপবিষ্টা স্ত্রীলোকের অধিলুলিতচিবুক, প্রকটগন্ডাস্থি অরক্তাধর ম্রিয়মাণ মুখের একপার্শ্বে পড়িয়াছে।… লীলার সেই শরন্মেঘমুক্তচন্দ্রোপম স্মিত মুখমন্ডল রৌদ্রক্লিষ্ট স্থলপদ্মের ন্যায় একান্ত বিবর্ণ এবং একান্ত বিষণ্ণ। সেই ফুলেন্দীবরতুল্য স্নেহপ্রফুল আকর্ণবিশ্রান্ত চক্ষু কালিমাঙ্কিত! বিষাদ-বিদীর্ণ হৃদয়ে লীলাকে দেখিতে লাগিলাম – ক্ষণেকে আমার আপাদমস্তক স্বেদাক্ত হইল।…’’
পাঁচকড়ি দে’র সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় রহস্য উপন্যাস ‘‘মায়াবী’’ থেকেও নমুনা হিসেবে কিছুটা উদ্ধৃত করা যায় এখানে:
‘‘… প্রকোষ্ঠ সকল ভগ্ন, মলিন, আবর্জ্জনাবহুল, মনুষ্যসমাগম-চিহ্নবিরহিত। সেই নির্জ্জন ভাঙাবাড়ীর অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার কোন একটা প্রকোষ্ঠে অনিন্দিতগৌরকান্তি স্নিগ্ধজ্যোতির্ম্ময়রূপিনী অনতীতবাল্যা একটি বালিকা নীরবে অশ্রুবর্ষণ করিতেছিল। মণিষিক্তপদ্মবৎ তাহার মুখ অশ্রুপাবনে একান্ত মলিন; তাহার লাবণ্যোজ্জ্বল দেহ কালিমাবৃত এবং কঙ্কালাবশেষ।… সেই আয়ত চক্ষুর মধুরোজ্জ্বল লীলাচঞ্চল দৃষ্টি সেই মানমুখখানিতে এক অননুভূতপূবর্ব সৌন্দর্য্য বিকাশ করিয়া রাখিয়াছিল।… সেই বিষাদমেঘাচ্ছন্ন মলিন অশ্রুবিবর্ণীকৃত মুখখানি ঢাকিতে লাগিল।… বালিকা একদৃষ্টে দেখিতেছিল, দৃষ্টি-সীমায় স্নিগ্ধোজ্জ্বল রক্তাভ-নীলিমাময় বেলাপ্রান্তে কেমন ধীরে ধীরে আরক্তরবি ক্রমশঃ ডুবিয়া যাইতেছিল; এবং আরও কিছুদূরে কি ভয়ঙ্কর মুর্ত্তিতে নিবিড় মেঘমালা গোধূলির হেমকিরণপরিব্যাপ্ত দিক্চক্রবালে আকাশের সেই মধুর কোমলচ্ছবি ব্যাপিয়া, পুঞ্জীকৃত হইয়া, স্তূপীকৃত হইয়া অল্পে অল্পে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতেছিল। … অদূরস্থিত প্রচুর ভিন্ন জাতীয় সদ্যঃপ্রস্ফুট বন্যকুসুমের স্নিগ্ধ পরিমল একত্রে মিশিয়া, সেই সংমিশ্রণে আরও মধুর হইয়া, এক অপার্থিব উপহারবৎ নিদাঘসায়াহ্নসমীরণ বহিয়া যেখানে সেই রোরুদ্যমানা, ধূলিধূসরিতা, বিগলিতাশ্রুনয়না, বিপদ্-বিহবলা বালিকা প্রস্তরগঠিতের প্রায় একখানি মূর্ত্তিমান্ দুঃখের জীর্ণ ছবিটির মত, নীরবে ঈষদুত্তোলিত মুখে দাঁড়াইয়া ছিল, সেইখানে সেই অলোকসম্ভবারূপিণী কিশোরীর চারিদিকে বিস্তৃত হইতেছিল। দূর বনান্তর হইতে কোন কোন মধুরকণ্ঠ পাখীর অমৃতবর্ষিণী কলকণ্ঠগীতি সেই বালিকার নিকটবর্ত্তী সকল স্থানই মুখরিত করিয়া রাখিয়াছিল।…’’
এক শ’ বছর আগের ‘পপুলার লিটারেচার’-এর ভাষা এই! এর অনেক শব্দ ও শব্দবন্ধ অব্যবহারে অপ্রচলিত এখন। এসবের অর্থ বুঝতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হবে একালের অনেক পাঠকের। আর কেউ যদি কষ্ট করে অভিধান হাতড়াতে যান, তবে ওই খোঁজাখুঁজি ঘাঁটাঘাঁটিই সার হবে তাঁর। এ কারণে পাঁচকড়ি দে’র ব্যবহৃত অনেক শব্দের অর্থ বাক্যে প্রয়োগ দেখে বুঝে নিতে হয়:
ক. রমণী সলজ্জভাবে ভূন্যস্তদৃষ্টিতে দাঁড়াইয়া রহিল। (মাটির দিকে তাকানো, চোখ নিচু করা)
খ. হুজুরীমল বড় বাজারের মধ্যে একজন জানিত লোক। (জানাশোনা, সুপরিচিত)
গ. … নিজের হস্তাবমর্ষণ করিতে করিতে… (হাত কচলানো)
ঘ. … তাঁহার অমোঘ একজ্ঞায়িতার শোচনীয় পরিণাম… (একগুঁয়েমি)
ঙ. … প্রকৃতিস্থ হইয়া দেখিলাম, অয়ষ্কঙ্কণে আমার হস্তদ্বয় শোভিত… (লোহার হাতকড়া, হ্যান্ডকাফ)
চ. অনন্তবিধ চিন্তায় তাঁহার মস্তিষ্ক পূর্ণ হইয়া গেল। (অসংখ্য রকম)
ছ. আকাশে মেঘ, তন্নিম্নে অন্ধকার… (তার নিচে)
জ. অবক্তব্য হইলেও আমি তাহা আপনাকে বলিব। (বলার মতো নয়)
ঝ. … ঘন ঘন উভয় করতল নিষ্পীড়ন করিতে লাগিলেন। (কচলানো)
ঞ. … সেই মনের কথাগুলি স্বহস্তস্থিত লিপির ন্যায় পাঠ করিলেন। (নিজের হাতে থাকা)
ট. … তদুভয়ের মধ্যে কে প্রকৃত মিথ্যাবাদী। (তারা দু’জন)
ঠ. … পশ্চাদ্ভাগে হাত দুইখানি গোট করিয়া … (জোড়)
সেকালের ‘পপুলার’ লেখক থাক, একালের ‘পপুলার’ কবি জীবনানন্দ দাশেরও অবস্থা একই। তাঁর ‘‘রূপসী বাংলা’’ তো বটেই, অন্যান্য কাব্যগ্রন্থেও ব্যবহৃত অনেক শব্দ, শব্দবন্ধ, নাম এখনও, এই এতগুলো বছর পরও, অভিধানে খুঁজে পাওয়া কঠিন। অক্ষান্ত, অবলেশ, উত্তরসামরিকী, কানসোনা, শিশুসূর্য, শাদাছিট, ছুঁয়ে ছেনে, সময়গ্রন্থি, কিন্নরকণ্ঠ, খোড়ো, গিরেবাজ, মচকাফুল, বেরিন, শঙ্খিনীমালা, ধানসিড়ি, উত্তেজ, তনুবাত, তক্ষিত, তুন্ডসমীচীন, থ্যাঁতা, অন্তর্দান, ঊষাপুরুষ, স্বতরুৎসারা, মরখুটে, মনোবীজ, মর্ত্যনারকী, সৃষ্টিবিসারী, নিপল, পুষ্পসেনী, প্রাণরণন, রেণুসূর্যশিখা, ব্রহ্মশব্দ, ফিরেফিরতি, ছাতকুড়ো, জননীতিক, জনমানুষ, পাখিনী, বালিছুট, কর্মোরেন্ট, তলতা, চাপেলী, টেঁশে (যাওয়া), একভিড়, পায়রাচাঁদা, লিঙ্গশরীরী, মিরুজিন, শকুন্ত-ক্রান্তি, পররতিময়, মঞ্জুভাষা, সৎবিজ্ঞাতা, ধ্বক, এঁটিলি, গেৎসিমানি, মধুকূপী, মলয়ালী – এমন অনেক শব্দ কি হারিয়ে যাবে একদিন? এ শব্দগুলি জীবনানন্দের কবিতায় এসেছে ৬০-৭০ বছর আগে, আর ৩০-৪০ বছরের মধ্যে এগুলোও কি ‘জানিত’ থাকবে আর?
সকল কবিই শব্দচয়নে গভীর মনোযোগী, সৃষ্টিশীল। তাঁরা ‘‘শবদে শবদে বিবাহ’’ দিয়ে নতুন-নতুন সাঙ্কেতিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেন ভাব, ভাষা ও নির্মাণের শিল্পে। তাই কেবল জীবনানন্দ নন – মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, সত্যেন্দ্রনাথ, যতীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল, শাহাদাৎ হোসেন, নজরুল, সুধীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী, জসীম উদ্দীন, আবদুল কাদির, বুদ্ধদেব, বিষ্ণু দে, ফররুখ আহমদ প্রমুখ যাঁরা অনেক অবদান রেখেছেন শব্দশিল্পে – তাঁদের সে সব সৃষ্টি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। কিন্তু চর্যাপদ থেকে আজ পর্যন্ত পাওয়া কোনও বাংলা শব্দই হারাতে দিতে রাজি নই আমরা। হাজার বছরের বাংলা কবিতায়, সাহিত্যে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দই তো বাংলা ও বাঙালির সম্পদ, ঐশ্বর্য।
কিন্তু এ সম্পদ আমরা রক্ষা করবো কিভাবে?
অভিধান বা কোষগ্রন্থের কথাই বলবো আমরা। এ ক্ষেত্রে চাইবো খন্ডে-খন্ডে সম্পাদিত বৃহৎ অভিধান। বলবো নানা ধরনের বিশেষায়িত অভিধান প্রণয়নের কথা। রবীন্দ্র-অভিধান, নজরুল-অভিধান, জীবনানন্দ-অভিধান প্রভৃতির কথাও বলবো আমরা।
কিন্তু কাজটি করবেন কে বা কারা?
বছরের একটি মাসে বাংলা ভাষার জন্য যে গর্বিত জনতা প্রভাতফেরি ও গ্রন্থমেলায় যান, শহিদ মিনারে দীর্ঘ সারি বেঁধে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেন, বইপত্র-সঙ্কলন প্রকাশ করেন, অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, পাজামা পানজাবি চাদর পরেন, কেমন একটা ইয়ে হয়ে যান বাংলা-বাঙালি করে-করে – তাঁরা কি ভূমিকা রাখবেন কোনও? কিংবা এ মাসের আবেগকে কাজে লাগিয়ে প্রকাশ ও প্রচার জগতের যাঁরা কোটি-কোটি টাকার বাণিজ্য করছেন, তাঁরা কি কোনও না কোনও ভাবে সহায়তা দেবেন এ কাজে? ‘‘খবরের কাগজের ঔদার্য, প্রভাবশালী বন্ধুগোষ্ঠী, রেডিও-টিভি ইত্যাদির অকৃপণতা এবং পত্রপত্রিকার পিঠচাপড়ানি পেয়ে অনেকেই’’ যাঁরা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি জগতের প্রবাদপুরুষ হয়ে উঠেছেন, এগিয়ে আসবেন কি তাঁরা? বাংলা নাম ধারণকারী যত সংগঠন, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, দপ্তর – তাঁরা কি করবেন কিছু? মাত্র একদিনের কোনও একটি বিশেষ ঘটনার স্মৃতি নিয়ে – সবাই নন, তবে অনেকে যাঁরা আজীবন ভাষাসৈনিক হয়ে আছেন, তাঁরা কি প্রমাণ দেবেন কথায় না কাজে?
আসলে নানা ধরনের অনেক অভিধান দরকার আমাদের। খাঁটি অভিধান দরকার। খাঁটি বাংলা ব্যাকরণ দরকার। বানানে শৃঙ্খলা দরকার। কেজো পরিভাষা দরকার। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ব্যাকরণ, ছন্দ, অলঙ্কার প্রভৃতির কোষগ্রন্থ দরকার। অনুবাদ কেন্দ্র দরকার – আমাদের কীর্তিকর্ম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। আমরা বিদেশ থেকে ভাল-মন্দ অনেক কিছু অনুবাদ করে ছাড়ছি আমাদের বাজারে, কিন্তু আমাদের বাজার থেকে কোনও কিছু পাঠাতে পারছি না বিদেশের বাজারে। তবে প্রশ্ন তো সেই, কাজটি করবেন কে বা কারা?
খাঁটি অভিধানের কথা বলছি, কেমন হবে তা? ২০০০ সালের ২১শে ফেবরুয়ারিতে প্রকাশিত মানবজমিন-এর বিশেষ সংখ্যায় লিখেছিলাম – এ জন্য প্রয়োজন: (১) প্রতিটি ভুক্তির গঠনগত, অন্বয়গত ও বাগর্থগত বিবৃতি; (২) শব্দ-নির্বাচনে হাজার বছরের ঐতিহ্য সন্ধান; (৩) বর্ণক্রমের সমস্যা সমাধান; (৪) অর্থনির্দেশ – প্রতিশব্দ, সংজ্ঞার্থ, ব্যাখ্যা, শব্দার্থ পরিবর্তন, ব্যুৎপত্তিগত অর্থ / বাচ্যার্থ, রূঢ়ি / যোগরূঢ় অর্থ, বাক্যে শব্দের প্রয়োগ; (৫) বানান; (৬) উচ্চারণ (আন্তর্জাতিক ধ্বনিলিপি অনুযায়ী)। অভিধানে ‘‘বিদেশী’’ শব্দের ধারণাটিও স্পষ্ট থাকা দরকার। যে শব্দ বেশির ভাগ বাঙালি বোঝেন তাকে বাংলা শব্দ হিসেবে গ্রহণে আপত্তি থাকার কথা নয় কারও। তবে ‘‘সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে বাংলা অভিধান-প্রণয়নের কতকগুলি সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। ভাষাবিজ্ঞান-চর্চার অগ্রগতির জন্য অভিধান বা শব্দকোষ সম্পর্কে ধারণাও কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। তাই আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের আলোকে অভিধান-প্রণয়নের ব্যাপারটি পর্যালোচনা করে দেখবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বানান, বর্ণক্রম, অর্থনির্দেশ প্রভৃতি বিষয়ে নতুন-নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থিত হয়েছে। সেগুলি সম্পর্কে রীতিমতো অভিনিবেশ দরকার।’’ (সুভাষ ভট্টাচার্য, ‘বাংলাভাষা চর্চা’, ১৯৯২)
খাঁটি বাংলা ব্যাকরণ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা সম্ভব নয় এখানে। তবে একটি উদ্ধৃতি, কিছুটা দীর্ঘ হলেও, দেবো: ‘‘… আক্ষেপের কথা, আজ পর্যন্ত যথার্থ বাংলা ব্যাকরণ একখানিও লেখা হয়ে ওঠে নি।… বহুকাল পর্যন্ত যে সব ব্যাকরণ রচিত হয়েছে সে সবই বলতে গেলে সংস্কৃত ব্যাকরণের আদলে এবং সংস্কৃত ব্যাকরণের আধারে বাংলা ব্যাকরণ। এই ব্যাকরণ বাংলা ভাষার ব্যাকরণ নয়। তা বাংলা ভাষার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলোকে ব্যাখ্যা করতে বা সেগুলোকে বুঝতে কোনও সাহায্যই করে না।… ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ (১৯৩৯) নামে যে ব্যাকরণ-গ্রন্থটি লিখলেন তাতে পুরোপুরি মুখের ভাষার ব্যাকরণই যে পাওয়া গেল তা নয় অবশ্য, তবে এই প্রথম সংস্কৃত ব্যাকরণের আওতা থেকে কিছুটা বেরিয়ে এলো বাংলা ব্যাকরণ – কিছুটা, কিন্তু পুরোপুরি নয়। কতকগুলো ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী প্রথাগত ব্যাকরণকে অনুসরণ করেছেন তিনিও। তবু এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে তাঁর ওই ব্যাকরণই প্রথম পদক্ষেপ। জ্যোতিভূষণ চাকী’র ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ (১৯৯৬) প্রকৃতপক্ষে ব্যাকরণচিন্তার বই।… পবিত্র সরকার ‘পকেট বাংলা ব্যাকরণ’ (১৯৯৪) নামে একখানা অতি কৃশকায় বই লিখেছেন বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ে। বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে এই প্রথম খাঁটি বাংলা ভাষার ব্যাকরণের একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা পাওয়া গেছে। তবে একই সঙ্গে বলবো এটি রূপরেখা মাত্র। এই রূপরেখা অনুসরণ করে তিনি নিজে কিংবা অন্য কোনও যোগ্য ব্যক্তি যদি পূর্ণাঙ্গ বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেন, তবে তাতে বাঙালি মাত্রেই উপকৃত হবেন। বাংলা ভাষার বিধিবদ্ধতার দিকে সেটা হবে এক দীর্ঘ দৃঢ় পদক্ষেপ।’’ (সুভাষ ভট্টাচার্য, ‘‘বাংলা ভাষার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’’, ২০০০)
বাংলা বানান প্রসঙ্গে বলতে হয়, এ নিয়ে সমস্যা এখনও অনেক। আশির দশকের প্রথম দিকে ড. আহমদ শরীফের উদ্যোগে এবং মুহম্মদ হাবিবুলাহ’র তৎপরতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ভাষা সমিতি’। এর আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে এক সেমিনারের আয়োজন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র কেন্দ্রে। ওই সেমিনারে আমি একটি প্রবন্ধ পড়ি। বানান-বিভ্রাট, বানানভেদ, বিকল্প বানানের আধিক্য ইত্যাদি সমস্যা কিভাবে বাংলা ভাষাকে যাবতীয় যথেচ্ছাচারের শিকার করে তুলছে – তা তুলে ধরি তাতে। কিছু অভিন্ন বানান চালু করা নিয়ে কিছু প্রস্তাবও করি প্রসঙ্গত। আলোচকদের মধ্যে আমার বক্তব্য সমর্থন করে এবং প্রস্তাবের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দেন বশীর আলহেলাল ও ড. হুমায়ূন আজাদ। পরে এ ক্ষেত্রে যথোচিত উদ্যোগ নিতে বশীর আলহেলালের নেতৃত্বে এক কমিটি গঠন করে সমিতি। তবে আমার স্থান হয় না ওই কমিটিতে।
যাহোক, এর কয়েক বছর পর পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানে ‘সমতা বিধানের লক্ষ্যে’ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এর উদ্যোগে কুমিলা’য় এক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সালের ২১-২৩ অকটোবর। ওই কর্মশালায় গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ড. আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় ‘‘পাঠ্য বইয়ের বানান’’ (নভেম্বর, ১৯৯২) নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে বোর্ড। ওই পুস্তিকায় নির্দেশিত নিয়ম অনুসারে সেই থেকে ছাপা হচ্ছে বোর্ডের যাবতীয় পাঠ্য বই। পরে বাংলা বানানকে অভিন্ন ও প্রমিত করার উদ্যোগ নেয় বাংলা একাডেমী। তাদের ‘‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে। এর পরিমার্জিত সংস্করণ ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি এবং সংশোধিত সংস্করণ ২০০০ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয়। তবে এ নিয়ম প্রচলনের ক্ষেত্রে কোনও কার্যকর উদ্যোগ নেয় নি একাডেমী। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় দৈনিক ও টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ, প্রকাশক সমিতি এবং সংশিষ্ট অন্যান্য মহলের সঙ্গে তাদের আলোচনা-পরামর্শ হওয়া জরুরি।
বিদেশী নামের বানান কোন নিয়মে লিখবো? প্যারিস, প্রাগ, বেইজিং, সারাজেভো, আলবেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া লিখবো – নাকি লিখবো পারি, প্রাহা, পেইচিং, সারায়েভো, স্কিপেরা, হ্রবস্কা? ঐশ্বর্যা লিখবো না ঐশ্বরিয়া? Jimenez কি জিমেনেজ না হিমেনেথ? Cicero কি সিসেরো না কিকেরো? এ সম্পর্কে পন্ডিতজনের পরামর্শ: ‘‘যে সব বিদেশি নামের তদ্দেশীয় উচ্চারণ আমাদের জানা আছে সেগুলির সেই অনুসারে প্রতিবর্ণীকরণ করে অন্যান্য নাম ইংরেজি উচ্চারণ অনুসারে বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণ করা অন্যায় নয়। এটা কোনও কুনীতিও নয়, এটা স্বাভাবিক। দীর্ঘকাল ধরে বহু দেশে এই রীতিই চলে আসছে।’’ (সুভাষ ভট্টাচার্য, ‘‘বিদেশি নামের উচ্চারণ ও বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ’’, ১৯৯২) এ পরামর্শ নেয়া যায় বলে আমি মনে করি।
তবে বানান প্রমিতকরণের কাজ এখনও বেশ বাকি। কি না কী, কার্তিক না কার্ত্তিক (< কৃত্তিকা), বর্ধন না বর্দ্ধন, বার্ধক্য না বার্দ্ধক্য (দ্বিত্ব নয়), আচার্য (যাতে আচার ধরা থাকে, কাগজ, বই) না আচার্য্য (যাতে আচার্য ধরা থাকে, শিক্ষক) – এ সব ছাড়াও প্রশ্ন আছে অনেক। উজ্জ্বল, উর্ধ্ব, উচ্ছ্বাস প্রভৃতি শব্দে ব-ফলা কি অপরিহার্য? এ রকম তিন অক্ষরে যুক্ত শব্দগুলোকে দু’ অক্ষরে যুক্ত রাখলে দোষ কি? লক্ষ্মণ, লক্ষ্মী তো অন্য ভাষায় লছমন, লছমি হয়ে গেছে; আমরা কি লক্ষণ / লকখন, লক্ষী / লকখি লিখতে পারি না? যক্ষ্মাকে যক্ষা লিখলে কি রক্ষা থাকবে না? পঙ্ক্তি, আকাঙ্ক্ষা, দ্বন্দ্ব, তীক্ষ্ণ, সত্ত্ব, সন্ন্যাসী, সন্ধ্যা, সূক্ষ্ম, বৈশিষ্ট্য, দারিদ্র্য, স্বাতন্ত্র্য – এ সব শব্দ কি ক্রমশ নির্ভার হবে না অন্য অনেক শব্দের মতো? গুণী, মন্ত্রী প্রভৃতি শব্দের দু’ রকম বানান কেন? গুণী লিখতে ঈ-কার, কিন্তু গুণিসম্মাননায় ই-কার। একই ভাবে মন্ত্রী ঈ-কার, কিন্তু মন্ত্রিত্ব, মন্ত্রিপরিষদ, মন্ত্রিবর, মন্ত্রিবৃন্দ, মন্ত্রিমন্ডল, মন্ত্রিসভা – সবখানে ই-কার কেন?
পরিভাষা প্রসঙ্গে বলতে হয়, সরকারি নিয়ম, বিধি, সিদ্ধান্ত, প্রস্তাব প্রভৃতি যে সব ইংরেজিতে ছিল সেগুলো বাংলাতে করে চলেছে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের ‘‘বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ’’। এই কোষে কাজ করেছি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে। সে হিসেবে ধারণা করি, তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গেই তাঁরা শেষ করেছেন ইতিমধ্যে। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক পরিভাষা তৈরি করে নিতে হয়েছে তাঁদের। ‘সাচিবিক’ বাংলা নিয়ে যতই ঠাট্টা-মশকরা করি না কেন ওই কোষের কৃতিত্বকে খাটো করে দেখার উপায় নেই কোনও। তারপরও ‘ইনজাংশন’-এর বাংলা কি? আদেশ, হুকুম, নিষেধাজ্ঞা না আসেধাজ্ঞা? ‘প্রোভোকেশন’ কি উসকানি না উৎক্ষোভন? ‘সাবোটাজ’ না ‘অন্তর্ঘাত’ লিখবো? ‘টিরেসট্রিয়াল’ না ‘স্থজল’ লিখবো? অনেক বিদেশী শব্দকে আমরা বাংলা করে নেবো তা ঠিক, তারপরও পরিভাষা প্রণয়নের প্রয়োজন থেকে যাবে। লেখক-সাংবাদিকদের এ প্রয়োজনে পড়তে হয় প্রতিদিন। ওই প্রয়োজন থেকেই ‘বর্ষপত্র’, ‘সমরপ্রভু’, ‘মাদকপ্রভু’, ‘কূটনীতিক’, ‘লাগসই প্রযুক্তি’, ‘টেকসই উন্নতি’ প্রভৃতি অনেক নতুন শব্দ ও প্রয়োগ উপহার দিয়েছে সাপ্তাহিক বিচিত্রা (১৯৭৬-৮২) – যাতে, বলতেই হয়, বিশেষ ভূমিকা ছিল আমার।
সর্বস্তরে বাংলা চালু করার সোগান রীতিমতো আক্রমণাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল স্বাধীনতার পর-পর, ১৯৭২-৭৩ সালে। ওই উগ্রতার প্রতিবাদ করেছি যথাসাধ্য। তখন আমি করটিয়া’র সা’দত কলেজের অধ্যাপক, পাশাপাশি টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংকেত-এর সম্পাদক। এ পত্রিকাটির প্রকাশক ছিলেন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা সদ্যপ্রয়াত শামসুর রহমান খান শাহজাহান। সম্পাদকীয় লিখে, সভা-সেমিনারে যোগ দিয়ে, ক্লাশে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেও বলেছি: সর্বস্তরে বাংলা চালু করার স্লোগানটি উৎকট জাত্যাভিমানী। এ দেশে অন্যভাষী জাতি আছে আরও। মায়ের ভাষার প্রতি তাঁদের ভালবাসা কম নয় আমাদের চেয়ে। বাংলা অনেক বেশি স্তরে চালু করা প্রয়োজন, কিন্তু সকল স্তরে তা সম্ভব নয় – উচিত নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অন্যান্য ভাষার সহায়তা নিতে হবে আমাদের; স্বদেশেও সহায়তা দিতে হবে অন্যান্য ভাষাকে – বিশেষ করে পিছিয়ে আছে যে সব ভাষা। প্রয়োজনে ওই সব ভাষার জন্য লিপি, বর্ণমালা থেকে ব্যাকরণ পর্যন্ত সবই তৈরি করার কাজে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।
এ প্রতিবাদের অনেক প্রতিবাদ হয়েছে তখন। কঠোর সমালোচনা হয়েছে নানা মহল থেকে। বিস্তর নিন্দা ও কুৎসাও জুটেছে একই সঙ্গে। তবে দমি নি কখনও। এ বিষয়ে বলেছি ও লিখেছি উপলক্ষ পাওয়া মাত্রই। শেষে একদিন কথা বলি বাংলা একাডেমী’র তৎকালীন পরিচালক, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সঙ্গে। বিষয়টি তিনি গ্রহণ করেন গুরুত্বের সঙ্গে। পরে মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এক বিশেষ আয়োজন করে বাংলা একাডেমী। এর উদ্দেশ্য ছিল দেশের অন্যভাষীদের মাতৃভাষা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা, এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার উদ্যোগ নেয়া। সে আয়োজনে যাওয়া হয় নি আমার, ডাক দেন নি কেউ। এর আগে সাহিত্যকোষ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অভিধান প্রভৃতি প্রণয়নের ব্যাপারে প্রস্তাব রেখেছিলাম বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালকের কাছে, তৎকালীন চেয়ারম্যান কবি শামসুর রাহমান তাতে জোর সুপারিশ করেছেন বলে জানিয়েছিলেন। শেষে কিছু একটা হয়েছে বলে শুনেছি, কি হয়েছে তা জানতে পারি নি আর।
বাংলা ভাষার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয় আশির দশকের মধ্যভাগে। ডেস্কটপ পাবলিকেশন (ডিটিপি) রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে প্রকাশনা জগতে। তবে শহীদলিপি, মইনুললিপি থেকে আজকের ‘বিজয়’ পর্যন্ত যে উত্তরণ এর প্রাণপুরুষ অবশ্যই মোস্তাফা জববার, তবে এই উত্তরণের সূচনালগ্নে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করেছে রতনলিপি, উদয়নলিপি ও পাক্ষিক তারকালোক। ডিটিপি’র অবদান হিসেবে মোস্তাফা জববারের ‘আনন্দপত্র’ পথিকৃৎ হলেও এর প্রথম সার্থক ব্যবহার ঘটে ‘তারকালোক’-এ (১লা অকটোবর, ১৯৮৭)। যথোচিত পৃষ্ঠাসজ্জার মাধ্যমে সেই প্রকাশনা রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে ডিটিপিকে। ‘আনন্দপত্রে’র এক সম্পাদকীয়তে এ কৃতিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল, এই সাফল্য ছাড়া সম্ভব ছিল না ডিটিপি’র দ্রুত উত্থান। পরে অবশ্য সবাই বেমালুম চেপে যান বিষয়টি। তাহলেও ‘তারকালোক’ পরিবারের প্রধান আরেফিন বাদলের উদ্যোগ ও আয়োজন, সম্পাদক হিসেবে আমার এবং আমার দুই সহকারী মবিন খান ও নূরজাহান বেগমের শ্রম ও নিষ্ঠা একেবারে অস্বীকৃত থাকবে – তা আমি মনে করি না।
বাংলা ভাষার জন্য কাজ করে তারকাখ্যাতি পেয়ে সাড়া জাগাবেন কেউ – তা সম্ভব নয়। এ বিষয়টিই শোরগোল করার জন্য, এর কাজ নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। এজন্যই অনেক প্রকৃত কর্মোদ্যোগী সংগঠন-সমিতির মতো আমার প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’-এরও উদ্যোগে গত চার-পাঁচ বছর ধরে যত গঠনমূলক কাজকর্ম হয়েছে তা তেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে নি অনেকেরই। অবশ্য মিডিয়া ও পাবলিকের চোখে পড়তে চাইলে ইয়া গোঁফ, দাড়ি, বাবড়ি ও বাঁদরামি দরকার। এর কারণ – ‘‘… শান্ত শমিত পরিকল্পিত জীবনচর্চার মানুষদের আমরা দূর থেকে সম্ভ্রমের চোখে দেখি – অনুসরণ করার কথা ভাবি না। আমাদের পক্ষপাত বিশৃঙ্খল, উড়নচন্ডী, পরিকল্পনাহীন মানুষদের দিকে। শরৎচন্দ্র, নজরুল, ঋত্বিক ঘটক, রামকিঙ্কর, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার সম্পর্কে মানুষের দুর্বলতার অন্ত নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবিতকালে ততটা জনপ্রিয় ছিলেন না, ছিলেন যেন সুদূর নক্ষত্রের মতো। বরং আমজনতার চোখের মণি ছিলেন শরৎচন্দ্র ও নজরুল। অনেকে সত্যজিতের চেয়ে ঋত্বিককে পছন্দ করেন এবং তাঁকে উন্নততর প্রতিভা বলে বিশ্বাস করেন। যে নদী মরুপথে বিলীন হয়ে যায় তাকে কে না ভালবাসে? আমাদের কালেই দেখেছি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের চেয়ে কাব্যপাঠকের বেশি অনুরাগ ছিল সমর সেনের প্রতি – কেননা তাঁর কাব্যধারা ব্যাহত এবং তিনি ছিলেন তির্যক দৃষ্টিকোণের পরিহাসপ্রবণ কবি। নন্দলাল ও বিনোদবিহারীর চেয়ে রামকিঙ্কর অনেক বেশি সমাদৃত তাঁর অদ্ভুত যাপন আর অসামাজিক অবস্থানের কারণে। গায়কদের মধ্যে মান্না দে’র চেয়ে কিশোর কুমার সমকালের শ্রোতাদের মধ্যে অনেক বেশি গৃহীত, কারণ তাঁর ক্ষ্যাপামি ও গানের সঙ্গে গলার কারদানি – অথচ ভাল করে গানবিদ্যাটাই তো তিনি আয়ত্ত করেন নি কোনও দিন। শীর্ষেন্দু ও মতি নন্দী’র চেয়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে অনেকে পছন্দ করতেন, কেননা শ্যামল অদ্ভুত কথা বলতেন, চমৎকার মিশুকে ছিলেন, খারাপ কথা বলতেন নির্বিকারভাবে। কবি হিসেবে সুনীল অনেক ভারসাম্যময়, কিন্তু শক্তিও তুল্যমূল্য বড় কবি – কিন্তু তাঁর দিকেই পালা ভারি। তার কারণ শক্তি সম্পর্কে প্রচুর মিথ বাজারে চালু ছিল, তাঁর মদ্যপানজনিত কান্ডকারখানার পলবিত বিবরণ ব্যাপক প্রচারিত। অনেক সময় তাই মনে হয়, এই মিথের ফলে তাঁর কবিতা তেমন করে পড়া হয় নি। বিনয় মজুমদার কি ততটা পঠিত, যতটা তাঁর অসুস্থতা বা তাঁর মানস বিপর্যয় নিয়ে রটিত?’’ (সুধীর চক্রবর্তী, ‘‘ঘরানা বাহিরানা’’, ২০০৭)
সবশেষে বলি, বাংলা ভাষায় পড়ালেখার জন্য আরও দু’টি -কার দরকার: অ-কার ও অ্যা-কার। অ-কার না থাকায় ‘কেরল’ (Kerala = কের’ল’)-কে ‘কেরালা’ লেখেন অনেকে, যাতে ‘কেরল্’ উচ্চারণ না করেন কেউ। উচ্চারণ জানা না থাকায় অনেকে তারাব, বেলাব, আমলাব, উসলাব প্রভৃতিকে বলেন তারাব্, বেলাব্, আমলাব্, উসলাব্। এ সমস্যা মেটাতে ‘বাসাব’, ‘জিরাব’ হয়েছে ‘বাসাবো’, ‘জিরাবো’। অবসান, অবতার, অবগত, অবহিত, অনিকেত, নরসিংদি, মেঘনাদ, মেঘদূত, প্রস্ত্তত, বস্ত্তত, খড়গ, ওয়াকফ, প্রগলভ, মত, হত প্রভৃতি শব্দের উচ্চারণে বিভ্রান্তি দূর হবে অ-কার থাকলে। আরও উদাহরণ দেয়া যায় এ সমস্যার। এখানে দিচ্ছি না সে সব।্যা-কার সমস্যারও উদাহরণ দেবো না বেশি। য-ফলা (্য)-য় আ-কার (া) দিয়্যো-কার লেখায় সমস্যা হচ্ছে অনেক। এক ‘ব্যাখ্যা’র উদাহরণ থেকেই বোঝা যায় তা। ‘ব্যা’+‘খ্যা’ হলেও আমরা এর উচ্চারণ করি ‘ব্যাক্খা’।
অনেকে বলবেন, এ সব কাজে এগিয়ে আসা চাই সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের । অনেকে বলবেন, একাডেমিক কাজ বাংলা একাডেমীর করা উচিত। কিন্তু এ দেশে যাঁর যা কাজ তিনি কি তা করতে পারেন? বাংলা একাডেমীকে আয়োজন করতে হয় গ্রন্থমেলা, পুরস্কার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং আরও কত কি। অথচ গ্রন্থমেলার জন্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, পদক-পুরস্কারের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে বিশেষ কমিটি আছে, সাংস্কৃতিক আয়োজনের জন্য শিল্পকলা একাডেমী আছে। যে ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কোনও যোগাযোগ নেই – সেই চর্যাপদ আবিষ্কারের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে বর্ণাঢ্য বিশেষ সংখ্যা বের করতে হয় – সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ড প্রচারের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মুখপত্র ‘‘সচিত্র বাংলাদেশ’’কে! (‘‘… ২০০৭ সালে চর্যাপদ আবিষ্কারের শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলায় অনেক কিছুই হতে পারতো। নীরব দেখছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগও। এই প্রেক্ষাপটেই সচিত্র বাংলাদেশ ফেব্রুয়ারি ২০০৮-এর প্রথম পর্বের সংখ্যায় চর্যাপদ আবিষ্কারের ১০০ বছর উপস্থাপনা।…’’) এ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান এর আগে, ২০০৭ সালের ৪ঠা সেপটেম্বর, গোয়েটে ইনস্টিটিউট-ও করেছিল। অথচ এ ধরনের একটি আয়োজনকে প্রকৃত অর্থে অর্থবহ করে তুলতে পারতো প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় জাদুঘর, এসিয়াটিক সোসাইটি, ইতিহাস পরিষদ এবং বলাই বাহুল্য – গত ৮৭ বছর ধরে যাঁদের সোৎসাহ প্রযত্নে পঠনপাঠন চলছে চর্যাপদের – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বাংলা বিভাগ, সেই সঙ্গে সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের বাংলা বিভাগগুলো। মনে হয় ভবিষ্যতে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের ‘‘নিরীক্ষা’’কে ছাপতে হবে কবিতা আর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ‘‘বই’’ পত্রিকায় স্থান পাবে যাবতীয় অর্থনৈতিক সমীক্ষা।
সাযযাদ কাদিরঃ কবি,সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।।