অনুবাদ সাহিত্যের পথিকৃৎ কবীর চৌধুরী এবং বিদেশি সাহিত্য
মোমিন মেহেদীঃ
কবীর চৌধুরী। একটি ইতিহাস, একটি ইন্সটিটিউট এবং একটি নক্ষত্র। তাঁর হাত ধরে অনুবাদ সাহিত্য এগিয়েছিল বহুদূর। তিনি ছিলেন বলেই বাংলাদেশে বিদেশি সাহিত্য পড়ার একটি সুযোগ দক্ষিণা হাওয়ার মত করে এসেছিল বারবার। তিনি জাতীয় অধ্যাপক নিছকই লেখক ছিলেন না; ছিলেন অনমত্ম সম্ভাবনার দরোজা। যেখানে তিনি জীবন, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি নানা বিষয় নিয়ে ভেবেছেন, তা নিয়ে লিখেছেন। ভাবনাকে তিনি প্রকাশ করে গেছেন জীবনের মধ্য দিয়ে। একজন অনবদ্য অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ ছিলেন তিনি। অনুবাদ সাহিত্যের অনবদ্য পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন তিনি দীর্ঘকাল। উপহার দিয়েছেন কবি ও কথাশিল্পী নাগিব মাহ্ফুজের উপন্যাস আখেনাতেন-এর বাংলা অনুবাদ। ডয়েলার ইন ট্রুথ নামক এই উপন্যাসটিই নয় বাংলা ভাষায় কবীর চৌধুরী অনুবাদ করেছেন অসংখ্য গল্প, উপন্যাস ও শিশু সাহিত্য। কবিতার বা ছড়ার কথাতো আর বলার অপেক্ষাই রাখে না। নোবেল পুরস্কার (১৯৮৮) বিজয়ী মিসরীয় ঔপন্যাসিক নাগিব মাহফুজ তাঁর রচিত সেরা এই উপন্যাসে তুলে এনেছিলেন চেতনার রোদ। যেই রোদ উঠেছে বলে অন্ধকার বিদায় নিয়েছে আপন তালে। আখেনাতেন বা ডয়েলার ইন ট্রুথ-এর অনুবাদ করে কবীর চোধুরী বাঙালিকে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন আরব্য সাহিত্যের বর্তমান ধারার সাথে। আখেনাতেন-এর অর্থ দাঁড়িয়েছে সত্যে বসবাসকারী নামে। উপন্যাসটির একটি বিশেষত হলো, এর রচনা শৈলী। ১৪৪ পৃষ্ঠার এ উপন্যাস জুড়ে শুধু একজন লোক সম্পর্কেই প্রশ্ন করে গেছেন সত্যানুসন্ধানী মেরিয়ামুন। মেরিয়ামুন আসলে এ উপন্যাসের কথক। এ উপন্যাসের কোনো চরিত্রই সরাসরি গল্পে অংশ গ্রহণ করে না। মূল চরিত্র খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের ফারাও সম্রাট আখেনাতেন, যিনি ফারাও সম্রাট তৃতীয় আমেনহোতেপের দ্বিতীয় পুত্র। সম্রাটের প্রথম পুত্রের মৃত্যু হলে তিনি রাজ্যের সম্রাট হওয়ার উত্তরাধিকারী হন। উপন্যাসটিতে তাকেই আমরা পেয়েছি নায়ক হিসেবে। তাঁর সম্পর্কে অপরাপর চরিত্রগুলোর বক্তব্যই হলো এ উপন্যাসের টোটাল বক্তব্য। নিজেদের চিন্তা ও অভিজ্ঞতা মতো তারা এক একজন এক একরকম কথা বলেছেন। আর তাদের বক্তব্য থেকেই আমারা বুঝতে পারি কে কতটা সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী। কার চরিত্র কেমন। সাবলিল অনুবাদের কারনে পাঠ হয়ে উঠেছে সহজ ও সুন্দর। কবীর চৌধুরী অনূদিত এই উপন্যাসটির মূল কাহিনী এগিয়েছে এভাবে- সম্রাট আখেনাতেন তার ছেলে বেলা থেকেই ভিন্ন প্রকৃতির। রাজ-রাজাদের যে অহঙ্কারী ভোগ-বিলাসি লাম্পট্যপূর্ণ চরিত্র থাকে, আখেনাতেন তেমন না। তিনি বরং তাদের বিপরীত। প্রাচীন রাজসভাগুলোতে জড়ো হওয়া চাটুকারদের তিনি সহ্য করতে পারতেন না। সাধারণ মানুষেরা যে রাজা এবং রাজার লোকদের দ্বারা নানান কারণে অহরহ নির্যাতিত হতো তিনি ছিলেন এমন নির্যাতনের ঘোর বিরোধী। বিশেষ করে ফারাও রাজারা নিজেদের শুধু রাজ্যের একছত্র অধিপতিই ভাবতেন না তারা নিজেদের দেবতার সবচেয়ে অনুগ্রহভাজন সেবকও ভাবতেন। আর রাষ্ট্রের পোষা পুরোহিততন্ত্র সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করত নিজেদের স্বার্থে। আখেনাতেন ক্ষমতায় আসার আগেই এসব অনাচারের বিরুদ্ধে লড়ার মানসিকতা লাভ করেন। এমনই একদিন তিনি এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের ডাক শুনতে পান। এবং ক্ষমতা গ্রহণের পর পিতৃপুরুষদের বহু বছরের লালিত দেবতাতন্ত্রের পথ পরিহার করে একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রচার শুরু করেন। এতে তাকে অবিশ্বাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে রাজ্যের সুবিধাভোগী, অত্যাচারি একটা শ্রেণী, যদিও বেশিরভাগ মানুষ তাকে শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করল। কিন্তু সম্রাট শুধু তার নিজের ধর্মই প্রচার করলেন না তিনি সব শাস্তির বিধান বিলোপ ঘোষণা করলেন। একই সঙ্গে সব রকম রক্তপাত বন্ধের নির্দেশও দান করলেন। তিনি ঘোষণা দিলেন, শাস্তি নয় ভালোবাসা দিয়েই জয় করতে হবে সব রকম প্রতিকূলতা, হিংসা আর শত্রুতা। কিন্তু সম্রাটের শেষের সিদ্ধান্তগুলো ছিল ভুল। ওসবের সঙ্গে আরও দুটি ভুল যোগ হলো, যখন তিনি সকল ধমের্র স্বাধীনতা খর্ব করলেন। মন্দিরগুলো বন্ধ করে দিলেন। অবশ্য মন্দির থেকে বাজেয়াপ্ত করা সকল অর্থ-সম্পদ তিনি দেশের গরীবদের মধ্যে বন্টন করে দিলেন। সম্রাটের এ রকম শাস্তি বিলোপ নীতি গ্রহণের সুযোগে ক্ষমতালোভী দুষ্টুলোকেরা দ্রুত মাথা চাড়া দিয়ে ওঠল। তারা সংবদ্ধ হয়ে রাজার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলো। তারা রাজাকে ধর্মদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করল। এভাবেই চতুর্থ ফারাও সম্রাট আখেনাতেনের রাজত্বে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলো যা শেষত রূপ নিলো গৃহযুদ্ধের। প্রাসাদে বন্দী হলেন আখেনাতেন। তাঁর স্ত্রী নেফারতিতি তাঁকে ত্যাগ করে চলে গেলেন। এভাবে কবছর বন্দি থাকার পর ক্ষমতাসীনরা ঘোষণা করল যে, সম্রাট আখেনাতেনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ তা বিশ্বাস করল না। তারা ধরে নিলো, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। যদিও লোক চক্ষুর অন্তরালে সমাহিত করা হলো তাঁকে, দেয়া হলো রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মেরিয়ামুন পনেরো জন লোকের সঙ্গে কথা বলে তাদের অভিমত নিরপেক্ষভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। এ পনেরো জনের মধ্যে কেউ আখেনাতেনের ছেলেবেলার বন্ধু (কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজকর্মচারী), কেউ শিক্ষাগুরু (এবং পরে রাজনৈতিক উপদেষ্টা), কেউ মাতৃতুল্য নারী, কেউ মন্ত্রী, কেউ সেনাবাহিনীর প্রধান। কেউ আবার পুলিশের প্রধান থেকে চাকরি চ্যুৎ। কিন্তু তারা সকলেই বিভিন্ন সময় কোনো না কোনো যোগসূত্রে আখেনাতেনের খুব কাছাকাছি ছিলেন। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এ সব লোকেরাই আখেনাতেন সম্পর্কে অসংখ্য পরস্পর বিরোধী বক্তব্য প্রদান করল। একজনের বক্তব্যের সঙ্গে আরেকজনের বক্তব্য খুব একটা মিলে না। একটু আগে একজন হয়তো বললেন, তাঁর চেহারায় একটা মেয়েলি দুর্বলতার ছাপ দেখা গেলেও দুর্বল চিত্তের মানুষ তিনি ছিলেন না। প্রচলিত পুরোহিততন্ত্রকে ভন্ডামি আখ্যায়িত করে তিনি একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। কিন্তু কিছু ভুলের কারণে তিনি সফল হতে পারেন নি। তিনিই প্রথম ফারাও সম্রাট যিনি সিংহাসন থেকে মাটিতে নেমে এসেছিলেন, মানুষের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন রাজসভাকে। তিনিই মানুষে মানুষে সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শাস্তি দানের নীতি বাতিল করে ভালোবাসার শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই হয়তো আরেকজন বলল, আখেনাতেন ছিলেন ভন্ড, ফারাওদের উত্তারাধিকারী হওয়ার সম্পূর্ণ অযোগ্য। তিনি নিজের দুর্বলতা লুকোতে এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের ধর্ম প্রচারের নামে সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করেছেন। এমনই পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায় আখেনাতেনের সুন্দরী স্ত্রী নেফারতিতি সম্পর্কেও। সারা উপন্যাসে একদল মানুষ তাঁকে চিত্রিত করেছে বহুপুরুষের বাহুলগ্না রূপে, বলেছে তাঁর ছটি সন্তান ভিন্ন ভিন্ন পুরুষের। আবার একদল মানুষ তাঁকে চিত্রিত করেছে বিদ্বুষী, ধার্মিক, স্বামী অনুরাগী স্ত্রী এবং রাজ্য পরিচালনায় পারদর্শী নারী হিসেবে। উপন্যাসের শেষে দেখা গেল তিনি তাঁর স্বামীকে ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকের কাছে ওটা বড় রহস্য। কেউ বলেছেন পাপীষ্ঠা, পর পুরুষের সঙ্গ লাভ করার উদ্দেশ্যেই নপুংসক স্বামীকে ত্যাগ করেছেন। কিন্তু আসলে তিনি তাঁর স্বামীকে বাঁচানোর জন্যই তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। পরে যখন বুঝতে পারলেন যে কাজটি ঠিক হয়নি, সর্বাবস্থাতেই স্বামীর সঙ্গে থাকা উচিত ছিল, তিনি প্রাসাদের ফিরতে চেয়েছেন, কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শক্তি তাঁকে সে সুযোগ দেয় নি। এবার আখেনাতেন ও নেফারতিতি সম্পর্কে আমরা এমন দুজন মানুষের কথা শুনব যাদের পরিচয় এ উপন্যাসের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন তে, আখেনাতেনের শাশুড়ি, অর্থাৎ নেফারতিতির সৎ মা, প্রাজ্ঞ আই-এর ৭০ বছর বয়স্ক স্ত্রী। আর আই আখেনাতেনের শিক্ষাগুরু। নেফারতিতি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ও ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমতি এক তরুণী, প্রাণবন্ত এবং আবেগদীপ্ত সৌন্দর্য দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং ধর্মে মরমীয়া দিকগুলোর দ্বারা গভীরভাবে আকৃষ্ট। বয়সের তুলনায় তাঁকে এত বেশি পরিপক্ক মনে হত যে আমি একদিন আইকে বলি যে, তোমার এই মেয়ে যাজিকা হবে। তে-এর সততার আরও প্রমাণ মিলে দুবোন সম্পর্কে তার বক্তব্য থেকে। নেফারতিতি আর মুতনেজমেট কখনো কখনো জগড়াঝাটি করত, বোনেরা যেমন করে। তবে নেফরাতিতির অবস্থানই সব সময় সঠিক হতো।… সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে মুতনেজমনেটের সঙ্গে তার ঝগড়া মিটিয়ে ফেলত, বড়ো বোন হিসেবে যা তার কাছ থেকে প্রত্যাশিত ছিল। এখানে বলে রাখা আবশ্যক যে, পুরোহিত আই যখন তে-কে বিয়ে করেন নেফারতিতি তখন দুবছরের মেয়ে মাত্র। কিন্তু প্রচলিত বিমাতাদের মতো নেফারতিতির সঙ্গে তিনি কখনোই বিমাতাসুলভ আচরণ করেন নি। কিন্তু তারই ঔরসজাত সন্তান মুতনেজমেট, নেফারতিতি এবং আখেনাতেন সম্পর্কে তার মনোভাব সম্পূর্ণ বিপরীত। এক সঙ্গে এ দুজন সম্পর্কে তার বক্তব্য আমরা পাই। মেরিয়ামুনকে সে তার বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছে, আমার স্বীকার করতেই যে হবে যে, আখেনাতেন ছিলেন উন্মাদ, আমাদের সকলের দুর্ভাগ্য যে তিনি মিসরের সিংহাসনের উত্তারাধিকারী হন। এবং অসুস্থ প্রণোদনাসমূহ চরিতার্থ করার জন্য তাঁর ক্ষমতাকে ব্যবহার করেন। আমি বেশি দোষ দিই নেফারতিতিকে, কারণ, তাঁর মধ্যে বুদ্ধ-যুক্তির অভাব ছিল না। কিন্তু ও সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে ওর উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং অধিকতর ক্ষমতা প্রয়োগ নিয়ে। আখেনাতেনের ক্ষমতা ও গৌরব মিলিয়ে যেতে না যেতেই সে তাঁকে ত্যাগ করে চলে যায়। সে তাঁর বিরোধীদের সঙ্গে যোগদানের চেষ্টাও করে।… সেও তার ধর্মদ্রোহী, নিষ্কর্মা স্বামীর মতোই নির্বোধ। এ উপন্যাসের পাঠক হিসেবে আমরাও একটা ধারণায় পৌঁছতে পারি যে, সুন্দরী নেফারতিনি সম্পর্কে পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে যে সব মিথ্যাচার ছড়ানো আছে নাগিব মাহফুজের এ উপন্যাস পাঠের পর সে সব বিভ্রান্তির অবসান ঘটবে। মি. মাহফুজও হয়তো এই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই এমন চমতকার একটি শৈলীতে এ কাহিনীটিকে উপস্থাপন করেছেন। যাতে উপন্যাসটি সব ধরনের পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। হয়তো এর মাধ্যমে তিনি আখেনাতেন ও নেফারতিতি সম্পর্কে শেষ বার্তাটি বিশ্ববাসীকে দিতে চেয়েছেন। এখন আমরা আখেনাতেন: সত্যে বসবাসকারী উপন্যাসের মূল বার্তাহুলো খুঁজে দেখব। অসত্য ও অধমের্র যেখানে জয়জয়কার, যেখানে তারা রাজত্ব করে অপ্রতিদ্বনি্দ্বরূপে সেখানে অসত্যই সত্য আর অধর্মই গভীর বিশ্বাসরূপে মগজে মগজে প্রোথিত হয়। এমন পরিস্থিতিতে সেখানে সত্য আর প্রকৃত ধমের্র বাণী যত উত্তমরূপেই পরিবেশিত হোক কেউ তা গ্রহণ করে না, করতে চায় না। সাধারণ মানুষ তখন প্রকৃত সত্যকে সন্দেহের চোখে দেখে, আর তার প্রচারকারীকে পাগল বলে বিদ্রুপ করে। এটা শুধু সত্য আর ধমের্র ক্ষেত্রেই নয় বিশ্বর তাবৎ প্রচলিত ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রচলিত মতে বিশ্বাসী পুরোহিত বা যাজকদের সংখ্যা যেখানে যত বেশি হবে সেখানে সত্যের বা প্রকৃত ধমের্র প্রতিষ্ঠা তত কঠিন হবে। বার বার বিশ্বাস ভেঙে যাওয়া মানুষেরা যখন একটি সত্যে উপণিত হয়, তখন তারা সম্ভাব্য দুটি অবস্থার মধ্যে যে কোনো একটিকে গ্রহণ করে। হয় তারা অবিশ্বাসীতে পরিণত হয়, অথবা মৃত্যু পর্যন্ত নিজের বিশ্বাসে অটল থাকে। তবে চরম পথটাই বেশির ভাগ মানুষ বেছে নেয়। আর তা হলো, কোনো কিছুতেই বিশ্বাস না রাখা। কিন্তু তাই বলে এই অবিশ্বাসী হয়ে উঠাটাও বিশ্বাসী হয়ে টিকে থাকার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আবার বার বার বিশ্বাস ভেঙে যাওয়া মানুষ যে পরম অভিজ্ঞতা লাভ করে তা পাথরের মতো শক্ত হলেও হতে পারে কিন্তু তা কখনো পাথরের মতো নিরেট হয় না। কিছু না কিছু সত্যের দ্যুতি ওখান থেকে উৎসারিত হয়। যেমন মেরিয়ামুন যখন আখেনাতেনের শাসন আমলের প্রধান পুলিশ কর্মকর্তার কাছে যান, তার সঙ্গে কথা বলেন, এক পর্যায়ে বড় বিভ্রান্ত পড়েন তিনি। তিনি জানতে চাইলেন, নেফারতিতি কেন রাজাকে একা প্রাসাদে রেখে চলে গেলেন?
মাহো উত্তরে বললেন, এ রহস্য আমি উদ্ধার করতে পারিনি।
:আমার মনে হয় আপনি এখন আর আপনার রাজার দেবতাকে বিশ্বাস করেন না?
:এখন আমি কোনো দেবতাকেই বিশ্বাস করি না।
মাহোর এ বক্তব্যই আমার উপর্যুক্ত বক্তব্যকে সমর্থন করে। তাই বলা যায়, সেই প্রাচীনকালের ফারাও সম্রাট আখেনাতেনের পরিণতি থেকে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের অনেককিছু শেখার আছে। হাজার হাজার বছর আগের মতোই এখনো এ উপন্যাসের পাঠ সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। শেখার অনমত্ম দরোজাগুচ্ছর নির্মাতা আমাদের কাব্যজ মানুষ, সাহিত্যপ্রান পুরম্নষ কবীর চৌধুরীর এই আখেনাতেন: ডয়েলার ইন ট্রুথ আরবি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয় কায়রো থেকে ১৯৮৫ সালে, নাগিব মাহফুজ নিজে প্রকাশ করেছিলেন। পরে তাগ্রিদ আবু-হাসাবোর অনুবাদে ১৯৯৮ সালে, কায়রোর আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়। পরে ২০০০ সালে একই অনুবাদকের অনুবাদে তা প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক থেকে। কবীর চৌধুরী এ বাংলা অনুবাদটি করেছেন অনুবাদকের ১৯৯৮ সালের সংস্করণ থেকে। অনমত্ম সম্ভাবনার বাতিঘর শিক্ষাবিদ ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব কবীর চৌধুরীর জীবন কথা বলতে গেলে বলা যায় হাজার হাজার পৃষ্টা ব্যাপী। কিন্তু তার উপায় নেই। কর্পোরেট সময়ের হাত ধরে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের কোলে দাঁড়িয়ে যেটুকু বলা যায়, সেটুকু হলো-১৯২৩ সালের ৯ই ফেব্রৃয়ারি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় আমাদের আলোকিত সমাজ গড়ার এই মহান কারিগর জন্মগ্রহন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে ১৯৪৩ সালে অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন কবীর চৌধুরী। ১৯৪৪ সালে সণাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক পান একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৫৭ সালে ফুলব্রাইট বৃত্তি পেয়ে মার্কিন সাহিত্যের ওপর লেখাপড়া করতে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসনে উচ্চতর গবেষণা শেষ করেন ১৯৬৫ সালে। ১৯৪৪ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ইংরেজির অস্থায়ী অধ্যাপক হিসেবে কবীর চৌধুরীর কর্মজীবন শুরু হয় এরপর ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে দেশের বিভিন্ন কলেজে শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যান। একই দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান হিসেবেও। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ দেওয়ার আগে তিনি বাংলা একাডেমীর প্রধান, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য-সচিব এবং বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা সচিব হিসেবেও কাজ করেন। সরকার ১৯৯৮ সালে কবীর চৌধুরীকে জাতীয় অধ্যাপক মনোনীত করে। বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারেও উলেস্নখযোগ্য অবদান রেখেছেন তিনি। মানবতা আর যুক্তির পক্ষে সব সময় সোচ্চার ছিলেন শিক্ষক কবীর চৌধুরী। পাকিসত্মানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে তার ছোট ভাই মুনীর চৌধুরীকে হত্যা করে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হিসেবেও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন কবীর চৌধুরী। বাংলাদেশের কবিতাকে বিশ্বে পরিচিত করার ক্ষেত্রে কবীর চৌধুরীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। পাশাপাশি বিদেশি কবিতা, নাটক ও গল্প অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। ইউরোপীয় সাহিত্যের সমালোচনা ও বিশেস্নষণ পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছেন। বিদেশি সাহিত্যের প্রধান লেখকের সঙ্গে এ দেশের পাঠকদের পরিচিত করার দায়িত্বও পালন করেছেন। বাংলা ও ইংরেজিতে মেŠলিক রচনা ও অনুবাদ মিলিয়ে কবীর চৌধুরীর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দেড়শতরও বেশি। তার বেশ কিছু প্রবন্ধ ও অনূদিত গল্প-কবিতা ভারত, রাশিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার পত্র-পত্রিকা এবং সংকলন-গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে৷ সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি গভর্নর স্বর্ণ পদক, হাবিব সাহিত্য পুরস্কার, ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, কাজী মাহবুবউলস্নাহ পুরস্কার, সাউন্ডবাংলা সাহিত্য পুরস্কার, নাসির উদ্দিন সাহিত্য পুরস্কার, লোকনাট্যদল স্বর্ণপদক, বঙ্গবন্ধু জাতীয় পুরস্কার, শেরে বাংলা জাতীয় পুরস্কার, একুশে পদক এবং ভারতের উইলিয়াম কেরি পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। পথের শেষ না দেখেই ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃত্ব প্রদান করেও তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যেতে পারেননি। আগামীর আলোকিত বাংলাশের জন্য কবীর চৌধুরীর চেতনায় আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাসত্মবায়ন চাই…
লেখকঃ সম্পাদক, banglareport24.com; email: mominmahadi@gmail.com