লিবিয়া ও ইরাকের শ্রমবাজার হুমকীর সম্মুখিন!

লিবিয়া ও ইরাকের শ্রমবাজার হুমকীর সম্মুখিন!

এসবিডি নিউজ২৪ ডট কম,ডেক্সঃ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দুই শ্রমবাজার লিবিয়া এবং ইরাকে জনশক্তি রফতানির জটিলতা কাটছে না। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দেশ দুটিতে বিদেশি শ্রমিকের চাহিদা বাড়লেও বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে জোরালো কোনো উদ্যোগ এখনও নেয়া হয়নি।

এ কারণে অবৈধভাবে বাংলাদেশি শ্রমিক পাড়ি দিচ্ছে দেশ দুটিতে, হচ্ছেন প্রতারিত। অন্যদিকে ভারত, ফিলিপাইন, পাকিস্তান, নেপালসহ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো ইতোমধ্যে জনশক্তি পাঠানো শুরু করেছে লিবিয়া এবং ইরাকে। ফলে সেখানকার শ্রমবাজার হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।  শক্তিশালী কূটনৈতিক তত্পরতার অভাব ও কিছু অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য লিবিয়া এবং ইরাকে বাংলাদেশের শ্রমবাজার নষ্ট হচ্ছে। ভেস্তে যেতে বসেছে শ্রমবাজার দুটির নতুন সম্ভাবনা। সম্প্রতি অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে ইরাক এবং লিবিয়ায় লোক পাঠানো শুরু হয়েছে। যার সঙ্গে সরকারের কোনো বিভাগ বা কোনো বৈধ জনশক্তি রফতানিকারকরা সম্পৃক্ত নন। মূলত দালাল চক্রের মাধ্যমেই এসব শ্রমিক লিবিয়া এবং ইরাকে গিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন এবং জেল খাটছেন অনেকেই। বাংলাদেশ সরকার এবং বৈধ জনশক্তি রফতানিকারকরা মনে করছেন দেশ দুটিতে এখনও জনশক্তি রফতানি করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। কারণ এখনও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগেই রয়েছে সেখানে। এ পরিস্থিতিতে কোনো শ্রমিক পাঠিয়ে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না কেউই। তবে জনশক্তি বিশ্লেষকরা মনে করেন, যেহেতু বাংলাদেশের অন্যান্য শ্রমবাজার প্রায় একেবারে বন্ধ। এ অবস্থায় ওই বাজার দুটিতে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা যদি ধরা না যায় তাহলে জনশক্তি রফতানি একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকবে।

বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক খুরশীদ আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সার্বক্ষণিক দেশ দুটির সব বিষয় পর্যবেক্ষণ করছি। জনশক্তি রফতানি করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আমরা আর বসে থাকব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিচ্ছিন্নভাবে অবৈধভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা এখন দেশ দুটিতে যাচ্ছেন বা যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন তাদের আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।’ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘দেশ দুটিতে জনশক্তি রফতানির মতো অবস্থা এখনও সৃষ্টি হয়নি এটি যেমন ঠিক, তেমনি যাতে বাজারটি হাতছাড়া না হয় বা দ্রুত সেখানে জনশক্তি রফতানি করা যায় তার জন্য সরকারের তরফ থেকে যে ধরনের উদ্যোগ নেয়া দরকার তেমনটি নেয়া হচ্ছে না। দূতাবাসগুলোতে জনবলের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। সেদিকে কারও নজর নেই। তবে বাজার দুটির সার্বিক পরিস্থিতি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। এজন্য সরকারের পাশাপাশি বায়রার তরফ থেকেও একটি প্রতিনিধি দল পাঠানো হবে দেশ দুটিতে।’
লিবিয়া এবং ইরাক বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ শ্রমবাজার। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিএমইটি এবং বায়রা সূত্রে জানা গেছে, একটি সময় দেশ দুটিতে প্রায় দু’লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করতেন। কিন্তু ইরাকে পশ্চিমা আগ্রাসন এবং লিবিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক সেখান থেকে দেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। এখন লিবিয়ায় মাত্র হাজার দশেক এবং ইরাকে সাত থেকে আট হাজারের মতো বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত। দেশ দুটিতে যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতি বেশ শান্ত হয়ে এসেছে। এখন চলছে পুনর্গঠনের কাজ। লিবিয়া এবং ইরাকে এ মুহূর্তে বিদেশি চিকিত্সক, নার্স, পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং বিদ্যুত্ ও পানি সরবরাহসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের জন্য অসংখ্য কর্মী প্রয়োজন। আর কর্মী হিসেবে তারা বাংলাদেশিদের নিতে আগ্রহী। ইতোমধ্যে কোরিয়ান কোম্পানি ‘দাইয়ু ই অ্যান্ড সি’, ইতালিয়ান কোম্পানি ‘বোনাত্তাই’ এবং লিবিয়ান কোম্পানি ‘ইলিপেও’সহ কয়েকটি বড় কোম্পানি বিদেশি শ্রমিক নেওয়া শুরু করেছে। যেহেতু বাংলাদেশ থেকে এখনও বৈধভাবে দেশ দুটিতে লোক পাঠানো হচ্ছে না, সেহেতু ওই কোম্পানিগুলো ঝুঁকছে অন্য দেশের দিকে। বিশেষ করে প্রতিযোগী দেশ ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন এবং নেপালে থেকে শ্রমিক নেওয়া শুরু করেছে ওইসব কোম্পানিসহ লিবিয়া-ইরাকের স্থানীয় অনেক প্রতিষ্ঠান। এই কারণে বাংলাদেশের শীর্ষ এই দুই শ্রমবাজার হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এদিকে যুদ্ধের আগে যেসব বাংলাদেশি শ্রমিক ওইসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন এবং জীবন বাঁচাতে যারা দেশে ফিরে এসেছিলেন তাদের অনেকেই নিজ উদ্যোগে পাড়ি জমাচ্ছেন লিবিয়া এবং ইরাকে। সরকারিভাবে বৈধ উপায়ে এখনও দেশ দুটিতে জনশক্তি রফতানি শুরু না করায় ওইসব শ্রমিক বাধ্য হয়ে অবৈধভাবে দালালদের মাধ্যমে যাচ্ছেন। এতে করে অনেকেই হচ্ছেন প্রতারিত। বিএমইটি এবং বায়রা সূত্রে জানা গেছে, গত দু’মাসে অবৈধভাবে ২০ বাংলাদেশি শ্রমিক লিবিয়ায় গিয়ে সে দেশের পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। যাদের অনেকেই এখন দেশটির জেলে আটক রয়েছেন। এছাড়া জানুয়ারিতে আরও ১০ বাংলাদেশি শ্রমিক অবৈধভাবে ইরাকে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জনশক্তি রফতানিকারক জানান, ‘গত কয়েক মাসে পাঁচ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক দেশ দুটিতে গেছে। বেশ কিছু অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে এসব শ্রমিক পাঠাচ্ছে। এ ধরনের একেকটি রিক্রুটিং এজেন্সি ২০০ থেকে ৩০০ শ্রমিক পাঠিয়েছে।’ জানা গেছে, এ পর্যন্ত যে পাঁচ হাজার শ্রমিক দেশ দুটিতে গেছে তার মধ্যে মাত্র ৩৮০ জনের রেকর্ড রয়েছে সরকারের খাতায়। কারণ লিবিয়া এবং ইরাকের কিছু কোম্পানি শ্রমিক চেয়ে যে ডিম্যান্ড লেটার দিয়েছিল তার মধ্যে বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে ওই ৩৮০টিতে সত্যায়িত ছিল। বাকিগুলো দূতাবাসের মাধ্যমে সত্যায়িত নয়।

এ বিষয়ে বায়রার সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার বলেন, ‘অবৈধভাবে কোনো বাংলাদেশি শ্রমিক লিবিয়া বা ইরাকে কেন-বিশ্বের কোনো দেশে যাক সেটি আমরা চাই না। কারণ অবৈধভাবে গিয়ে শ্রমিকদের নানাভাবে প্রতারিত হতে হয়। সর্বস্ব খুইয়ে অনেকেই একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, যারা অবৈধ পন্থায় বিদেশে যাচ্ছেন তারা তো হঠাত্ করে গায়েব হয়ে বা হাওয়ায় মিশে যাচ্ছেন না। নিশ্চয়ই বিমানবন্দর বা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। আর টাকা খেয়ে এ কাজে সহায়তা করছে সীমান্তরক্ষী বা বিমানবন্দরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা।’ জানা গেছে, এখন সীমান্ত বা বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে অবৈধভাবে লিবিয়া এবং ইরাকে যাচ্ছেন বাংলাদেশি শ্রমিক। এভাবে অবৈধ পন্থায় লিবিয়া এবং ইরাকে শ্রমিক গিয়ে একদিকে যেমন সরকার হচ্ছে আয় বঞ্চিত, অন্যদিকে ওই দেশ দুটিতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের ব্যাপারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এজন্য লিবিয়ার ত্রিপোলিতে বাংলাদেশ দূতাবাসকে সে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জানিয়ে দিয়েছে, সুশৃঙ্খল এবং বৈধ উপায়ে বিদেশি শ্রমিকদের কাজ দেওয়া হবে। অবৈধভাবে কোনো দেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া হবে না। সে দেশের সরকারের এই মনোভাব ইতোমধ্যেই শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছেন ত্রিপোলির বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা। কিন্তু তারপরও সরকারের তরফ থেকে এখনও এ বিষয়ে জোরালো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

জনশক্তি রফতানিকারকরা জানান, সরকার জোরালো কোনো উদ্যোগ তো নিচ্ছেই না, উল্টো লিবিয়া পুনর্গঠনে কাজ করা বিভিন্ন কোস্পানির কাছ থেকে গত দু’মাসের শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট চেয়েছে, যা লিবিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে নতুন বাধা সৃষ্টি করেছে। জনশক্তি রফতানিকারক ও বিশ্লেষক এবং গ্রিনল্যান্ড ওভারসিজের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বলেন, ‘লিবিয়া এবং ইরাকের বাজার যাতে হাতছাড়া না হয় সে জন্য সবার আগে দরকার সেখানে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসকে আরও সক্রিয় করা। সেখানে লোকবল বৃদ্ধি করা এবং বিভিন্ন কোম্পানি যে ডিম্যান্ড লেটার দিচ্ছে তা দ্রুত সত্যায়িত করা। সর্বোপরি এ ব্যাপারে সরকারের ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা দরকার।

 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।