ফাল্গুনবিহার
সোহরাব শান্তঃ
আজ পহেলা পাল্গুন। আজ বসন্ত। লাল-হলুদে চোখ জুড়ানোর মাসের শুরু। প্রকৃতির রূপ বদলের পাশপাশি মানুষের মনেও ঘটে লক্ষনীয় পরিবর্তন। তাইতো বসন্ত বরণে এত আয়োজন। পঞ্জিকা অনুযায়ী ফাল্গুন এবং চৈত্র বসন্ত। বাংলাশের জন্য ফাল্গুনেই যেন পাওয়া যায় বসন্তের সঠিক আমেজ। শীত-গরমের মধুর খেলা এ সময়েই জমে ভাল। ঝরঝরে প্রকৃতি, ফুরফুরে মেজাজ, শীতের শেষে কড়কড়ে রোদ! আহারে ফাল্গুন! আমের মুকুলের সোদা গন্ধ! গ্রাম দেশে বাস না করলে কতটা যে মিস হয়। বলে তো বোঝানো যায় না! তাইতো ফাল্গুনের এত গুণগান। জয়জয়কার। শীতের বিদায়ী মুহুর্তে গাছে গাছে যেমন উঁকি দেয় কচি পাতা। তেমনি ফুলে ফুলে ভরে যায় চারদিক। আমাদের মোহিত করে প্রিয় ঋতু বসন্ত। ‘‘নারী হয় লজ্জাতে লাল, ফাল্গুনে লাল শিমুল বন/ এ কোন রঙে রঙিন হলো বাউল মন।’’ কিংবা ‘‘বসন্ত বাতাসে সই লো, বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ, আমার বাড়ি আসে।’’ আকূল বাউলের এমন গাণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ফাল্গুনের সাধারণ এক চিত্র। নানা রঙের ফুল ছাড়া যে ফাল্গুন অসম্পূর্ণ! শিমুল ফুলের লাল রঙে রঙিন পুরো শিমুল গাছ। বহুদূর থেকে দেখা যায় সেই লাল। পুরো ফাল্গুনজুড়ে পুরো গ্রাম বাংলায় এমন দৃশ্য চোখে পড়ে । যদিও আজকাল অপরিকল্পিত নগরায়ন আর গাছ কাটার ফলে এমন দৃশ্য কমে আসছে । শুধু শিমুল নয়। এ সময় যেদিকেই চোখ যায় কেবল ফুল আর ফুল। অপরূপ কৃষ্ণচূড়া গাছ; তো আরো মনোহারী। গাঁদা-ডালিয়ার মতো ফুলগুলোর কথাই বা বাদ যাবে কেন। কত কত ফুল, কত কত রং। রঙিলা বসন্ত। চির যৌবনা ঋতু বসন্তের প্রথম মাস ফাল্গুন। শুধু যে প্রকৃতিতে এর রঙ লাগে তা নয়। ফাগুণের আগুণ ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মনেও। ফাল্গুনের প্রথম দিনটি তাই বহু প্রত্যাশিত। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের কাছে এই দিনের গুরুত্বই আলাদা। পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনে ফাল্গুনের আমেজ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করেন অনেকে। ১৪ ফেব্রুয়ারী ভালবাসা দিবস পালিত হয়। দিনটি পহেলা ফালগুনের পরের দিন। তবু সামগ্রিক ভাবে পহেলা ফাল্গুন তথা বসন্তের আগমনী দিনটির রঙ-রস কমেনি এতটুকুন। এইদিন থেকেই শুরু হয় বসন্তবিহার। শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বসন্তের প্রথম দিনে লাল-সাদা-হলুদ পোশাকে অনন্যরূপে দেখা যায় এদিন। প্রাণোচ্ছল তরুণ প্রেমিক প্রবল ভালবাসায় পেমিকার খোপায় গেঁথে দেয় কোন একাট তাজা ফুল। বসন্তে চুলের খোপায় ফুল- দৃশ্যটা বেশ চিরাচরিত। কি শিক্ষিত, কি অশিক্ষিত সব শ্রেণীর প্রেমিকই ভালবাসা প্রকাশের জন্য মুখ্যম সময় যেন বসন্ত। ইদানিং লাল-সাদা-হলুদ শাড়ি-পাঞ্জাবির প্রচলন শহর ছাড়িয়ে মফস্বল পর্যন্ত। সরল-সোজা রাখাল থেকে শুরু করে মাঠের কৃষক, গ্রামীন নারী থেকে শুরু করে শহুরে মানুষ। আনমনা বাউল থেকে শুরু করে শহুরে গিটারিস্ট প্রাকৃতিক আনুকূল্যে সবার মনেই খেলে যায় আনন্দ ধারা। সেই সঙ্গে এক ধরনের উদাসিনতাও বটে। প্রকৃতি যেমন সাজে নতুন সাজে-মানুষও যেন নিজেকে নতুনরূপে সাজাতে নতুনভাবে সাজানোর অবসর খুঁজে এই ফাল্গুনে। ফাল্গুনের একটি চমৎকার চিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ফাল্গুন’ কবিতায় এঁকেছেন এভাবে।
ফাল্গুনে বিকশিত
কাঞ্চন ফুল ,
ডালে ডালে পুঞ্জিত
আম্রমুকুল ।
চঞ্চল মৌমাছি
গুঞ্জরি গায় ,
বেণুবনে মর্মরে
দক্ষিণবায় ।
স্পন্দিত নদীজল
ঝিলিমিলি করে ,
জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি
বালুকার চরে ।
নৌকা ডাঙায় বাঁধা ,
কান্ডারী জাগে ,
পূর্ণিমারাত্রির
মত্ততা লাগে ।
খেয়াঘাটে ওঠে গান
অশ্বথতলে ,
পান্থ বাজায়ে বাঁশি
আন্মনে চলে ।
ধায় সে বংশীরব
বহুদূর গাঁয় ,
জনহীন প্রান্তর
পার হয়ে যায় ।
দূরে কোন্ শয্যায়
একা কোন্ ছেলে,
বংশীর ধ্বনি শুনে
ভাবে চোখ মেলে।
যেন কোন্ যাত্রী সে ,
রাত্রি অগাধ ,
জ্যোৎস্নাসমুদ্রের
তরী যেন চাঁদ ।
চলে যায় চাঁদে চড়ে
সারা রাত ধরি ,
মেঘেদের ঘাটে ঘাটে
ছুঁয়ে যায় তরী ।
রাত কাটে , ভোর হয় ,
পাখি জাগে বসন্তে
চাঁদের তরণী ঠেকে
ধরণীর কোণে ।
এ ফাল্গুন, এ বসন্ত সবার মনে সুখের ঢেউ তুলুক। আনন্দের রেশ থাকুক সারা বছর। এই হোক আমাদের সবার প্রত্যাশা।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।।
sohrabshanto@gamil.com